কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৭ |
বাজারের ফর্দ আর একটা শিমুল গাছ
বাড়ি থেকে বেরিয়েই রাস্তার ধারে একটা শিমুল গাছ গজিয়েছে। বেশিদিন হয়নি তবে গাছ বলে কথা, এরই ভেতর দোতলা ছাড়িয়ে গেছে সে। আর যার জন্য এটার দিকে নজর আপনা থেকেই চলে যাচ্ছে তা হলো ফুল। এখন চৈত্র মাসের শুরু, শিমুল ফোটার সময়। এই গাছটি দেখছি কাঁচা বয়সেই ফুল ফুটিয়ে ফেলেছে! গাছের রংটা সাদাটে, আর তার ওপর লালফুল। পাতা নেই বললেই হয়। অন্য গাছের তুলনায় একটু যেন ভিন্ন ধরনের। কিছু একটা দেখলেই মানুষ আজকাল পকেটে হাত দেয়। ফোন বার করে কচ করে ফটো তোলে। আমিও অভ্যাস মতো তাই করলাম।
সেদিন সাড়ে চারটে নাগাদ ভীষণ ঝড় এলো। বেশ শক্তিশালী গোছের কালবৈশাখী। মিনিট পনেরো জোর হাওয়ায় বাড়ির পরদা, জানলার পাল্লা, বারান্দায় রাখা ফুলের টব সব লণ্ডভণ্ড। মেঝেতে কিচকিচে ধুলো। তারপর এল মুষলধারায় বৃষ্টি। কদিন গরম চলছিল – ভারি আরাম লাগলো। ‘কালবৈশাখী’ কবিতার লাইন মনে পড়ছিল – “এত যে ভীষণ, তবু তারে হেরি ধরায় ধরে না হর্ষ / ওরই মাঝে আছে কালপুরুষের সুগভীর পরামর্শ।”
পরের দিন। ঝড়বৃষ্টিতে গরম কমেছে, সকালের দিকে বেরিয়েছিলাম। রাস্তায় ছড়িয়ে আছে গাছের পাতা, প্রশাখা। দুএকটা গাছ ঝড়ে পড়েও গেছে। আরে, সেই শিমুল গাছটাও দেখছি একেবারে ভূলুণ্ঠিত! শেকড় সমেত উপড়ে গেছে বেচারি। ফুল সে যত্ন করে ওপরের ডালে ফুটিয়েছিল যাতে কেউ ছুঁতে না পারে। এখন সে ফুল দুটো গরুর নাগালে। তারা বেশ মৌজ করে ফুল ছিঁড়ছে আর খাচ্ছে।
কদিন পরে বেরিয়েছি, দেখি মিউনিসিপালিটির লোক এসেছে ট্রাক নিয়ে। গাছের গুড়িটা তিন টুকরো করে তোলা হয়ে গেছে। সরুসরু ডালপালা কেটেছেঁটে বাণ্ডিল বাঁধছে, হয়ে গেলে ট্রাকে তুলবে। ওদের জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো কী হবে ভাই?” কাজ করতে করতে লোকটা বলল যে, গুড়ির কাঠ আড়তে বিক্রি হবে। সরু ডালগুলো জ্বালানি কাঠ হিসেবে লোকে কিনে নিয়ে যাবে।
আরও কয়েকটা দিন কেটে গেছে। বাজারের দিকে যাব, ওই জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী আশ্চর্য! ফোন বার করে শিমুল গাছের ছবিটা দেখলাম। তাজা গাছ, এইবারই প্রথম ফুল ফুটিয়েছিল সে। এই ছবিটা ছাড়া সে আর নেই, তার চিহ্ন মাত্র নেই। ফেলে যাওয়া ফাঁকা জায়গাটা পড়ে রয়েছে।
গাছ একদিন ছিল তাই সে ছিল। এখন সে নেই তাই সে নেই। এই ‘থাকা-না-থাকা ব্যাপারটার হয়তো কোন মানেই নেই। না কি ‘থাকা আর না-থাকা’ই সত্যিকারের সার কথা! এসব আমি জানি না তবে এ প্রশ্নটা আজ এমন ভাবে মাথায় ঢুকেছে যে বেরোতে চাইছে না মোটে।
ইস, ভাবতে ভাবতে দেরি হয়ে গেল রে! দোকানটা বন্ধ না হয়ে যায়। গিন্নীর ফোন এলো – রসুন আনবে, একটুও নেই।
হুঁ, তাহলে নারকেলঝাঁটা, ঘর পোঁছার ন্যাতা, মশা মারার ধূপ এসব কিনে সবজির দিকটাও যেতে হবে। শিমুল গাছ কেন কাল-ছিল-আজ-নেই তা ভেবে চুল পাকিয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং বাজারের ফর্দই ভালো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন