কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৭ |
৯টা ২৮এর ব্যান্ডেল লোকাল
ভদ্রমহিলা শ্রীরামপুর থেকে ট্রেনে উঠে দুটো সিট ছেড়ে ঠিক আমার মুখোমুখি বসলেন। গলায় হাল্কা গোলাপি আভা মুক্তোমালা। মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগে কারো জন্য সমুদ্রের নিচে ডুব মেরে অনেকগুলো মুক্তো তুলে এনেছিলাম, শ্বাস ফেলার আগে একে একে গেঁথে তার গলায়। ঠিক এইরকম।
ভদ্রমহিলার থেকে চোখ সরাতে পারছি না। উনিও হয়ত বুঝেছেন, দু’একবার আমার দিকে আড়চোখে দেখে, অস্বস্তির গলা খাঁখারি। পরনে সাদা ছাপাশাড়ি, গোলাপি ব্লাউজ, গলায় গোলাপি মুক্তো। দেখে মনে হল মাঝ-চল্লিশ, বিগত যৌবনের ঢলঢল লাবণ্য সারা গায়ে এখনো মাখামাখি। নিশ্চই কোনো স্কুলটিচার। খুব হাল্কা গলায় মোবাইলে কথা বলছেন, কথাগুলো যেন ভেসে হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। ট্রেন শেওড়াফুলি ছাড়িয়ে বদ্যিবাটীর একটু পরে, খালপাড়ে। পশ্চিমদিকের বাড়িগুলোর পরেই একটা ভাঙ্গা ব্রীজ, গিয়ে খালের মধ্যে মিশেছে। এখান দিয়ে গেলেই ইচ্ছে হয় ওখানে পা ছড়িয়ে বসি, সূর্যাস্তে। এই গোলাপি মহিলা হয়ত রোজ রাতে ঘোড়ায় চড়ে একটা সাদা গাউন পরে ওখানে গিয়ে চাঁদের আলোয় বসেন। চাঁদ ওনার ফর্সা গা-হাত- পা নিজের আলোয় ধুইয়ে দেয়। আরেকটু চকচকে করে দেয় গলার মুক্তোমালা। ইচ্ছে হল, ওনার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, আপনি মিষ্টিকে চেনেন?
মিষ্টি একদিন হঠাৎ দুর্গাপুর হয়ে কমলপুর ছাড়িয়ে সোনাঝুরির জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। আমার দেওয়া মুক্তোমালাটা টুকরো করে ছড়িয়ে। আমার সামনে দিয়ে। ধরতে পারিনি। ও আসলে অনেকদিন একটা পাহাড় খুঁজছিল, নৈঃশব্দ খুঁজছিল – কেন বুঝিনি? আমি কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো ডাম্ব হয়ে যাচ্ছি?
তারপর আজ। এই ভদ্রমহিলার মধ্যে, ঠিক সেই লাবণ্য। ট্রেন ভদ্রেশ্বর ছাড়ল, আশেপাশে সারিসারি আমবাগান, মানকুন্ডু আসছে। ডানহাত দিয়ে কানের লতির পাশের একসারি চুল সরিয়ে এবার উনি সরাসরি, আমার দিকে। চোখে প্রশ্ন। আমারো। ও কি বুঝেছে আমি কাউকে খুঁজছি? মনে হল কয়েকপলক সময় থেমে গেল। আবার ফ্লাশব্যাক।
‘ঘাম কখনো মুক্তোবিন্দু হতে পারে?’
কত বছর আগের লেখা লাইন, আজো যেন মনের মধ্যে জ্বলজ্বল। সম্নাম্বুলিস্ট শব্দটা আমার
অভিধান থেকে এবার মুছে দিতে হবে। ট্রেন চুঁচড়ো ঢুকছে। একে একে অনেকে উঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা
ব্যাগের মধ্যে তন্নতন্ন করে কিছু একটা খুঁজছেন। ছাতা? রুমাল? চশমা? ট্রেন ব্রেক মারতে
শুরু করল। উনিও ব্যাগের চেন দিতে শুরু করলেন। নেমে যেতে চায়? আমার মনে আরো কয়েকটা প্রশ্ন
উঠে আসছে। কাগজ পেন চাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন