সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

                        

লাল-নীল-পেন্সিল



(৪৩)

কখন জ্ঞান এল টের পায়নি লিপিকা। তারও অনেক পরে উঠে বসল, মাথা টলমল করছে। হাত দিয়ে মাথা সামলাতে গিয়ে অনুভব করল কপালের কাছটা ফুলে উঠেছে। হাত ছোঁয়ানোমাত্র টনটনিয়ে উঠল জায়গাটা। গলা শুকনো, কেমন অস্বস্তি, বমির ভাব। ধীরে ধীরে চেতনায় ফিরল। অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চোখ পড়ামাত্র বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল আবারও। একইভাবে স্থির হয়ে আছে সলমন। লেজ নাড়ছে না, পাখনা নেড়ে ঢেউ তুলছে না। অন্য মাছেরা এসে তার চারপাশে জমা হয়েছে। মৃত বুঝলে হয়ত ঠুকরে খেতে শুরু করবে। ওকে এখুনি সরিয়ে নেওয়া দরকার, মনে মনে বলে লিপিকা। মাছ বলে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। এক ছোট্ট প্রাণী, সংসারে জুড়ে-থাকা দীর্ঘদিনের এক সদস্য। সে শব্দ না করে অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা সরাল। সূক্ষ্ম তরঙ্গ টের পেয়ে সরে গেল অন্য মাছেরা। লিপিকা আলগোছে তুলে নেয় সলমনকে। সোফায় বসে কোলের ওপর রাখে মাছটিকে। হাতদেড়েক লম্বা মাছটা ওইভাবে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছে। বিশ্রী লাগছে দেখতে। মাছের চোখের ঢাকনা না থাকায় চোখ বন্ধ হয়নি। তাকে স্পর্শ করে লিপিকা, মৃতদেহ শক্ত।

আগে কোনওদিন এভাবে ছোঁয়া যায়নি মাছটিকে, আদর করা যায়নি। দুর্বোধ্য অনুভূতি একটা। অ্যাকোয়ারিয়মটার দিকে চেয়ে ভাবল, আর রাখার মানে হয় না। মুখ ভেঙেচুরে, গলা বিকৃত হয়ে কষ্ট উঠে আসছে। অন্ধকারে চোখ বেয়ে অঝোর জল নামছে কোলের ওপরে রাখা মাছের গায়ে।

অনেকক্ষণ পর ঘড়ি দেখল – চারটে পঁচিশ। আকাশে আলোর রেখা স্পষ্ট হয়ে ফুটছে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে সারাদিনের কাজে। তাদের চেঁচামিচিতে শোক নেই, দুঃখ নেই। তারা ব্যস্ত সংগ্রাহক, দিনের শেষ সূর্যকে বিদায় দিয়ে এমনি করে ফিরে আসে। কত বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, লিপিকা ফ্ল্যাটের পশ্চিমের ব্যালকনিতে বসে অদূরের রাস্তা, অস্ত-যাওয়া সূর্য, ফিরে-আসা পাখিদের সহজ তালমেল দেখতে পায়। কিন্তু এত ভোরে ওঠার অভ্যেস ছেড়ে গেছে অনেকদিন। শোভন ইদানিং ওষুধের প্রভাবে বেলা সাড়ে আটটা, নটার আগে জাগে না। মাছ হাতে সে উঠে দাঁড়াল। কোথায় কেমন করে রাখবে ভাবছিল। বাজার থেকে জ্যান্ত মাছ সামনে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে এনে রান্না করেছে। কতবার অ্যাকোয়ারিয়মে কত মাছ মরে গেছে, কাগজ মুড়ে ময়লা ফেলার বালতিতে ফেলেছে। কিন্তু এখন ওসব ভাবতে পারছে না। সে কিচেনে ঢুকে একটুকরো পরিষ্কার কাপড় আর কালোরঙের প্লাস্টিক বের করল। সিঙ্কে রেখে কাপড় মুড়ে, প্লাস্টিকে ভরে সলমনকে তুলে রাখল ফ্রিজে। কী করা উচিত মন স্থির করে উঠতে পারল না। কী ভেবে শোওয়ার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। পর্দা একটু সরিয়ে দেখল, মশারির মধ্যে ওদিকে পাশ ফিরে শোভন ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করল সে, শোভনের পিঠ ওঠাপড়া করছে তো? নাকি সে-ও থেমে গেছে?

আয়া মেয়েটি আসা পর্যন্ত লিপিকা শোভনকে লিভিংরুমে আসতে দিল না। ঠিক দশটায় ময়না এলে তার কাছে শোভনকে রেখে গাড়ি নিয়ে সে বেরোল। সকালে শোভনের সঙ্গে বসে এক কাপ চা খেয়েছে শুধু। কালকের ঘটনার অভিঘাতে বড্ড ক্লান্ত। চাপা মানসিক অবসাদে শরীর চলতে চাইছে না। পছন্দমতো জায়গায় অন্ত্যেষ্টি করার উদ্দেশ্যে একটা ব্যাগে নিয়েছে সলমনকে। তার এলাকা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল অনেকটা। এদিকে পরপর মাছের ভেড়ি। জায়গাটা সুন্দর, মনোরম। অনেকে হেঁটে বেড়ায়, পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ভেড়ির পাড় ধরে বাঁধানো ফুটপাত, গাছগাছালি। ছায়াময় এলাকাটি। বড়ো রাস্তার অন্যদিকে ছোটো চায়ের দোকান বা অন্য ইট-আউট। লিপিকা গাড়ি ঘুরিয়ে নিরিবিলি দেখে দাঁড় করাল। কাপড়-জড়ানো মাছ বের করে এল জলের ধারে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, পুলিশ আপাতত নেই। সামান্য নীচু হয়ে একটি গাছের নীচে হাত বাড়িয়ে ভাসিয়ে দিল মাছ। জলের ওপর ঝুঁকে-থাকা গাছ বেশ কিছু পাতা ঝরিয়ে দিল জলের ওপরে। তারপর অনির্দেশে তাকিয়ে রইল কয়েক মিনিট। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুটে বলল,

ভালো থাকিস বাবু।

চোখ-মুখ ওড়না দিয়ে ঘষে মুছে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির কাছাকাছি অ্যাকোয়ারিয়ামের দোকানে এল। ছেলেটি পরিচিত। বাবুলের কাছে যাওয়ার সময় এরই জিম্মায় মাছদের রেখে গিয়েছিল। কয়েকটি মাছ বাঁচেনি। নন্দন বলে ছেলেটি আপত্তিমাখা সঙ্কোচে বলল,

ম্যাডাম বলুন!”

শুনুন নন্দন, একটা উপকার করতে হবে আমার।

মাছ রেখে যাবেন? কিন্তু আমার পক্ষে সময় দেওয়া, মরে-টরে গেলে আবার!”

না সেটা নয়। আমার বাড়ি থেকে অ্যাকোয়ারিয়মটা এখানে নিয়ে আসবেন।

মুশকিল আছে ম্যাডাম, এত বড়ো জিনিসবলছি তো যত্ন করার টাইম নেই আমার। ক-দিন থাকবেন না?”

না তা নয়। অ্যাকোরিয়ামটা আপনাকে দিয়ে দিতে চাই মাছ-সমেত।

ছেলেটি অবাক হল, কিছু বলল না। লিপিকা জোর দিয়ে বলল,

যদি পারেন আপনার হিসেবে কিছু একটা দাম দিয়ে দেবেন। না হলে জিনিসটা বিক্রি হলে তখন!”

ছেলেটি হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।

লিপিকা গাড়ির দিকে যেতে যেতে গলাতে জোর এনে অনুরোধ করল,

আমি আর রাখতে চাইছি না। বিকেলের দিকে বা সন্ধের সময়ে অতি অবশ্য আসবেন।

ছেলেটি কী বলছে না শুনেই পা চালিয়ে গাড়ির দিকে এগোল লিপিকা। কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে কাটাবে বলে মোবাইল সায়লেন্টে রেখেছিল। ব্যাগ থেকে বের করে অন করে দেখল, আধঘন্টার মধ্যে তেরো-চোদ্দটা মিসড্‌ কল ময়নার। চমকে উঠল সে। শিরদাঁড়া বেয়ে তিরতির স্রোত উঠল, নামল।

কল-ব্যাক করা মাত্র ময়না চেঁচিয়ে উঠল,

কোথায় ছিলেন কাকিমা? এতবার ফোন করলাম!”

এই তো ফিরছি এক্ষুণি। কী হয়েছে বলো?”

শিগগীর আসুন! কাকাবাবু! আমি অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে দিয়েছি।

ময়নার গলা প্রচণ্ডভাবে কাঁপছিল। লিপিকার পা মাটিতে আটকে গেছে। ঘষটে ঘষটে গাড়িতে ঢুকে স্টিয়ারিং-এ বসল। সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক অভ্যস্ত হাত বাড়িয়ে গাড়ির ইগ্নিশন স্যুইচ অন করল।

(ক্রমশঃ)

 

 


৪টি মন্তব্য:

  1. হিমাদ্রি শেখর দত্ত২ আগস্ট, ২০২৪ এ ২:১২ PM

    ঝরঝরে লেখা। পড়ার সময় গতি বাধা পায় না। আর বর্ননা তো সব লাল নীল পেন্সিলে আঁকা ছবির মত। আগের পর্ব গুলি কোথায় পাব?

    উত্তরমুছুন
  2. খুবই ভাল লিখেছ ।এটাই ত আরম্ভ?

    উত্তরমুছুন
  3. খুবই ভাল লিখেছ ।এটাই ত আরম্ভ?

    উত্তরমুছুন