সমকালীন ছোটগল্প |
পাখিটা
হেমন্ত-ও কি ফুরিয়ে এলো! সামনে ছড়িয়ে থাকা সবুজ, ডানদিকে
সামান্য এক টুকরো জলা। আর এই প্রাচীন কাঠের বেঞ্চে বাবাকে নিয়ে আজ সকালে বসে থাকতে
থাকতে হঠাৎ মনে এলো প্রশ্নটা। হেমন্ত-ও কি ফুরিয়ে এলো!
ফ্ল্যাটের খুব কাছেই এই পার্ক। সময় পেলেই রুমা বাবাকে নিয়ে
এখানে এসে বসে। বাবার আঠাত্তর আর ওর বিয়াল্লিশের কাছাকাছি। ওদের আর কেউ আছে বলে রুমার
মনে পড়ে না। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন বাবাকে ও করে না। আর সারাদিনে বাবা ক’টা কথাই বা
বলেন! বোধহয় একুশটা। নেহাৎ প্রয়োজনে। কথা
বলানোর চেষ্টা রুমাও খুব একটা করে না। যেহেতু অফিসে কথা বলতে হয় প্রচুর,
অনিচ্ছাতেই। আর মনশরীর নিছক সাদা এখন। সাদা শরীরে কথা কম আসে। রুমা মেনে নিয়েছে এ
তথ্য।
এই মুহূর্তে ওর হাতে অফিসের বার্ষিক ফিনান্সিয়াল রিপোর্ট।
সোমবার মিটিং আছে। মাঝামাঝি চেয়ারে থাকায় কিছু দায়, কিছু কথা বলার দায়িত্ব সেখানে ওর
থাকেই। যেটুকু করতে হয়, সেটুকুই ঠিকঠাকভাবে করতে রুমা পছন্দ করে। এখন খেয়াল করে,
রিপোর্টে কিছু ত্রুটি আছে।
এক ঝলক বাবার দিকে তাকালো। হাঁটুর উপরে হাত, প্রায় ছ’ফুটের
মানুষটা এখন ঈষৎ কুঁজো, সামনে তাকিয়ে চুপচাপ। কী ভাবছেন! হাতের রিপোর্টের দিকে
আবার চোখ টেনে নিয়ে আসে রুমা।
-ওটা কী?
বাবার আঙুল যেদিকে, সেদিকে একা একটা দোয়েল।
-ও তো দোয়েল।
টুপটাপ পাতা ঝরছে সামনের গোটা কয়েক আকাশমণি থেকে। আর কোনো
শব্দ নেই। সামান্য দূরে তিনটে কিশোরী সাইকেল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বোধহয় টিউশন শেষে।
রিপোর্টটা পড়তে পড়তে রুমা ক্রমে বিরক্ত হচ্ছিল। সৌমেনকে একটু বকতে হবে।
এই ত্রিশ পাতার ম্যাটারে এতো ভুল হবে কেন!
-ওটা কী?
বাবার গলা খুব শান্ত।
রুমা দেখে, দোয়েলটা নেমে এসেছে কাছের ডালে। লেজ নাচাচ্ছে। ও
একা।
-দোয়েল।
হালকা বাতাস। কোথাও কোন তাড়া নেই। যাওয়া নেই। রুমার কি আছে!
অনি সেই যে স্টেট্সে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। তারপর থেকেই তার আর কোন তাড়া
নেই। তা-ও তো প্রায় বাইশ বছর হ’ল। ‘অপেক্ষা’ শব্দটা কী অর্থহীন!
-ওটা কী?
কেন জানে না, সকাল থেকেই রুমার মনটা ভালো নেই। যেন কী একটা
হারিয়েছে তার। মনে করতে পারছে না কিছুতেই। মুখের ত্বক এখনো টানটান, শুধু ভ্রু দুটো
আজ স্বাভাবিক হচ্ছে না।
রুমা চোখ তুলে দেখে, দোয়েলটা নেমে এসেছে মাটিতে। প্রায়
বাবার পায়ের কাছাকাছি। যেন এ মানুষটাকে আর ভয় পেতে নেই।
-বলছি তো, ওটা দোয়েল। একটু চুপচাপ বসতে পারো না কেন বলো তো!
দেখছো, আমি একটা জিনিস পড়ছি। আর তার মধ্যে সেই এক কথা। আজকাল কি তুমি কানে কম
শুনছো? কি হয়েছে তোমার, বলো তো?
এতো ঝাঁঝ থাকবে শব্দগুলোয়, রুমা নিজেও ভাবে নি।
বাবা অবাক চোখে রুমাকে দেখলো। উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে শুরু
করলো ঘরের দিকে। কাছেই ফ্ল্যাট। তবু রুমা অবাক হ’ল।
-কোথায় যাচ্ছো! একা যাবে না তুমি।
তবু রুমাকে অবাক করে বাবা চলে গেল।
রুমাকেও উঠতে হবে তা’হলে। মেজাজটা আরো তিতো হয়ে গেল। অফিসের
কাজটা এখন আর হবে না। পাখিটা এখনো বসে। একলা। লেজ নেড়েই চলেছে। আর কী সুরেলা শিষ! ও কি নাচছে!
ডাকছে কাউকে!
বাবা ফিরে আসছে। হাতে
খুব পুরনো একটা ডাইরী।
পাশে বসে নিঃশব্দে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। দুটো পাতার মাঝখানে
আঙুল। রুমার কৌতূহল হ’ল।
বেগুনি কালিতে লেখা।
“…অফিসে খুব ঝামেলা চলছে। এর মধ্যেই আজ আমার রুমা মায়ের তিন বছর হ’ল। সকাল থেকেই খুব
বৃষ্টি। এতক্ষণে ছেড়েছে। ওর মা আজ থাকলে বাড়িতে নিশ্চয়ই খুব উৎসব হ’ত। আমাকে বাজারে
যেতেই হ’ত। এখন কে আর ওকে পায়েস করে দেবে! রাত্রে ওকে আজ আইসক্রিম খাওয়াবো। একটু আগে
ওকে নিয়ে সামনের পার্কটায় বসেছিলাম। সব ব্যাপারে ওর যে কতো প্রশ্ন! একটা দোয়েলকে দেখেছিল।
ওর মতোই ছোট্ট। সেটাকে দেখে ওর কী আনন্দ! পাখিটাও যেন মজা পেয়েছিল। আর ওর সেই এক প্রশ্ন।–ওটা
কি? আমি কিন্তু একটুও বিরক্ত হইনি। আমি তো জানি, এ ভাবেই ও কথা বলতে শিখবে, জানবে ওর
পৃথিবীটাকে। খিলখিল হাসি আর একটু পরে পরেই সেই এক প্রশ্ন। আমিও যেন ওর সঙ্গে সঙ্গে
আনন্দ কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম। সকাল থেকে মনটা ভালো ছিল না। এখন কেন যেন আর অতো খারাপ লাগছে
না। এই-ই কি বেঁচে থাকা! …’ ।
আরও অনেকটা লেখা।
রুমা আর পড়তে পারছিলো
না। বাবাকে জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে দিল। চোখদুটো
ভেসে যাচ্ছে অনাবিল অশ্রুতে।
বিয়াল্লিশের রুমা এই মুহূর্তে সেই সকালে, যখন ওর তিন সবে পূর্ণ
হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন