সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(৩৩)            

 

মেহুলী খুব অকপটভাবেই কথাগুলি বলেছিল। যত দিন যাচ্ছে, অতলান্তের সঙ্গে ওর দূরত্ব বাড়ছে। কোম্পানির ভেতরেও ও কিছুটা একঘরে হয়ে গেছে। নীচে নামার রাস্তাটা ও নিজেও ভালো চেনে। কিন্তু অতলান্তের মতো অত নিখুঁৎ হিসেব ওর নেই।  

অনির্বেদ তখন ভাবছিল হৃদয়ের পাশাপাশি বেদপর্ণার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। কী চমৎকার মানাত ওদের। সাঁঝ পরে শ্রমণকে বলেছিল, ফুলের বাগানে যারা যারা এসেছিল, অতলান্ত ছিল সবার চেয়ে আলাদা। খুব নিশপাপ একটা ভাবমূর্তি নিয়ে সে এসেছিল। কিন্তু চলে গেছিল সবার মধ্যে লোভ জাগিয়ে। ওকে দেখে, ওর সাফল্য দেখে, সবাই কেমন লোভী হয়ে উঠেছিল। ভাবতে শুরু করেছিল, এটাই বোধহয় সাফল্যের রাস্তা। অর্থাৎ নিজেকে বিক্রি করতে হবে। হৃদয় যাকে পুজোর জায়গা উপাসনালয় হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল সবাই তাকে বাজার হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। দেখার চোখ যে এইভাবে বদলে গিয়েছিল, অতলান্তই ছিল তার কারণ। গোটা আয়োজনের মধ্যে যে একটা উচ্চতা, মর্যাদা আর পবিত্রতা ছিল, অতপ্লান্ত তাকে নষ্ট করে দিয়ে গেছিল। বাকিরা শুধু হৃদয়ের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। অতলান্ত হৃদয়কে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

আর তোকে? শ্রমণ জানতে চেয়েছিল। অবশ্য বলতে যদি তোর আপত্তি না থাকে...

না, আমাকে ধ্বংস করতে পারেনি। ও সব সময়েধনী পরিবারের মেয়েদের সঙ্গী হিসেবে বাছত। এটা ওর স্টেটাসের জন্য দরকার ছিল। ওর নিজের জীবনে অভাব ছিল। সেই অভাবকে ও আড়াল করতে চাইত। মেয়েটির সম্পদ দিয়ে, যাতে ওকে কেউ তাচ্ছিল্য করতে না পারে গরীব বলে, নিজের উচ্চতাকে ও লোকের চোখে তুলে ধরতে পারে। এইভাবে মেয়েটির সম্পদকে ও নিজের সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইত, লোকেও ওকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হত। ও আমাকে ভালোবাসেনি, আমার সম্পদকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু আমার সম্পদের তুলনায় ওর সাফল্যটা একটু বেশী হয়ে গেল। বেদপর্ণা আমার চেয়ে বেশী ধনী নয় হয়ত, কিন্তু বেশী সুন্দরী, কেরিয়ারের দিক থেকে বেশী সফল, ডিগ্রিও বেশী, তাছাড়া কানেকশনের দিক থেকেও এগিয়ে। ওর বাবা, তুই তো জানিসই, এরপর আর কী বলার থাকে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁঝ। তারপর বলে অতলান্তর চাতুরিই আজ ওকে এত সফল করে তুলেছে। কোনও মেয়ে ওর প্রতি আকৃষ্ট হবে কেন? কী আছে ওর? ওর উচ্চতা, শরীরের গঠন দেখলে মেয়েরা পিছিয়ে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। ওর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার পর অনেকেই আমাকে সাবধান করেছিল। আমার পরিবারে ঘোর আপত্তি ছিল। অনেকেই ভাবত ও অক্ষম। ওই দুর্বলতা ও অসুস্থতা নিয়ে কোনও মেয়েকেই ও সুখী করতে পারবে না। কিন্তু মেয়েদের চোখে ও নিজেকে অন্য মানুষ করে তুলতে জানে। নিজের সাফল্যে মেয়েদেরও চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ওর চাতুরি আর প্রতারণা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আর তাই তো আমি তোকে খুঁজে পেয়েছি। ওর সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন সরল, উদার, আত্মভোলা, পরোপকারী মানুষ। অতলান্ত নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবে না। আর তুই নিজেকে বাদ দিয়ে গোটা দুনিয়া নিয়ে ভাবিস। ওকে এত ঘেন্না করি বলেই আজ আমি নিজের পুজোর জায়গাটা খুঁজে পেয়েছি...

কেস স্টাডি ৫ 

There is a fundamental stupidity in mankind which is an eternal as life itself.

Gustave Flaubert

সমিধার জীবনটা কেটে যাচ্ছিল নিতান্ত সাদামাটা ভাবে। বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। প্রাসাদোপম তিনতলা বাড়িতে বড়ো হয়েছে। কিন্তু সে বাড়িতে সব কিছুই ছিল, শুধু আনন্দ ছিল না। তার বদলে ছিল ভয়াবহ একাকিত্ব। বাবা সফল ব্যবসায়ী। সব সময়ে কাজে ব্যস্ত। মা-র দিকে তার কোনও খেয়ালই নেই। মা ঘরের কাজকর্ম করেন। আর অবসর সময়ে সেতার বাজান। সেতারই তাঁর জীবনের সব সময়ের সঙ্গী। আর মেয়ে। তিনিই মেয়েকে গড়েপিটে বড়ো করে তুলেছেন। মেয়ের মনকে তৈরি করেছেন। সেই মন নরম, সংবেদনশীল, মেধাবী। ছোটোবেলা থেকে সমিধা মাকেই চেনে। বাবাকে তার সেভাবে চেনা হয়নি। যদিও তাদের স্বাচ্ছন্দ্য-স্বচ্ছলতার ব্যাপারে বাবা কোনও ত্রুটি রাখেন নি। কিন্তু তিনি তো সব সময়েই প্রায় অনুপস্থিত।

একদিন সমিধার মা বাইরে গেছেন। বাড়িতে বহু পুরোনো বৃদ্ধা পরিচারিকা মানদা দাসী। সমিধাকে কোলে বসিয়ে হঠাৎ সে বলে উঠেছিল, তোর মায়ের মনে খুব দুঃখ রে মেয়ে।

কেন গো মাসী? জানতে চেয়েছিল সমিধা। মা যে সুখী নয়, সে তা অনুভব করত। কিন্তু ঠিক যেন ধরতে পারত না ব্যাপারটা। মা-র তো কোনও কিছুর অভাব নেই। বরং অঢেল আছে। সেই অঢেলের চেয়েও মা যাকে বেশী ভালোবাসেন, সেই সেতার আছে। তার সেতারের চেয়েও বেশী...। সমিধার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। 

তোর বাবা তোর মায়ের ব্যাপারে বড্ড উদাসীন রে। তাঁর জীবনে অন্য মেয়ে আছে...

সেইদিন থেকে জীবনটা পালটে গিয়েছিল সমিধার। মাঝে মাঝে মা যে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যান, তাঁর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াতে থাকে। সমিধাকে খুব জোরে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেন, তার কারণ বুঝতে পারে সে। মা-র জীবনে সব আছে, শুধু ভালোবাসা নেই। বড়ো দুর্ভাগা সে। সেদিন থেকেই নিজের

বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করে সমিধা।

সমিধাকে ফুলের বাগানে নিয়ে আসে মেহুলী। দুজনে স্কুলের বন্ধু। ছোটোবেলা থেকেই নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। সমিধা তখন হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলছে। আগ্নেয়র কানে কানে বলে মেহুলী, খুব মালদার ফ্যামিলির মেয়ে। একটু বোকা গোছের। আর খুব ভাবপ্রবণ। টাকাপয়সা নিয়ে তোদের আর টানাটানি থাকবে না। ওর পকেট সবসময়ে ভারী। যত পারিস খিঁচে নে।

কিন্তু কথাটা হৃদয়কে বলিস না। আগ্নেয় একটু সতর্ক হয়ে যায়।

সমিধা কিন্তু সত্যিই নিজেকে উজাড় করে অর্থব্যয় করতে থাকে। অসম্ভব রূপবান পুরুষ হৃদয়। প্রচণ্ড মেধাবী। মনে মনে তাকে ভালোবেসে ফেলে সমিধা। হৃদয়ের কথা মুগ্ধ হয়ে শোনে। প্রতিটা শব্দ মনের মধ্যে গেঁথে নেয়। হৃদয়ের প্রতিটা নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ছোটোবেলা থেকেই কত বই সে পড়েছে। কত গান শুনেছে। কত ছবি দেখেছে। কত সিনেমা দেখেছে। আর মনের মধ্যে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে তার স্বপ্নের পুরুষ। সেই পুরুষটিই হৃদয়। হৃদয়কে দেখার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকে। হৃদয়কে দেখবে বলে নানা ছুতোয় ফুলের বাগানের সবাইকে সে নিজের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে। এলাহী খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে। সবাই হৈচৈ করে, হৃদয় মশগুল থাকে তার স্বপ্ন নিয়ে। আর সমিধার চোখ সেই ভিড়ভাট্টার মধ্যেও ঠিক খুঁজে নিতে থাকে হৃদয়কে। তার রূপগুণের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

সমধার বাবার এখন বয়স হয়েছে। মেয়ের সব আবদারই তিনি মেটান। মেয়ের কাছ থেকে তিনি কত দূরে সরে গেছেন তিনি জানেন। এই অভাব তার ভেতরে আছে। মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে উন্মুখ হয়ে থাকেন। মেয়ে কোনও আবদার করলে ফেরাতে পারেন না। বাইরে কঠোর মুখচোখ করে থাকেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পান। সমিধার তখন খুব ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে।

কিন্তু সেই অভ্যাসটাই তার গড়ে ওঠেনি। যখন সে বাবাকে কাছে পেতে চেয়েছিল, তার বাবা তখন দূরে দূরেই থেকেছেন। এখন আর বাবাকে কিছুতেই নিজের কাছের মানুষ ভাবতে পারেনা সমিধা। দূরের মানুষ মনে হয় তাকে। খুব দূরের মানুষ। পুরুষহীণ জগতে তার বেড়ে ওঠা। মা আর মেয়ে দুই নিঃসঙ্গ নারী। পুরুষকে নিয়ে তাই খুব কৌতূহল সমিধার মনে। বাবাকে তার আর প্রয়োজন নেই। নিজের স্বপ্নের পুরুষটিকে সে নিজের ভেতরে গড়ে নিয়েছে। হৃদয়কে পাবার জন্য এখন বাবার কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায় করে নিতে চায় সমিধা। বাবাকে তার এটুকুই প্রয়োজন। বাবার ভেতরে যে মেয়েকে পাবার তীব্র আর্তি রয়েছে, তাকে মেটানোর কোনও দায় সে বোধ করে না।

এর কিছুদিন পরেই হৃদয়কে প্রপোজ করে সমিধা। হৃদয় সেদিন সমিধার দ্বীপে গিয়েছিল। সমধা সেটা জানত। সকাল থেকেই সে বারবার ফোন করতে থাকে। জানতে চায়, কখন সে সমিধার বাড়ি আসবে। হৃদয় বুঝতেই পারেনি, সমিধা কেন এতটা উতলা হয়ে উঠেছে। তার কাজ শেষ হতে অনেকটাই দেরী হয়ে যায়। দুপুরে সমিধার বাড়িতেই খাওয়ার কথা। সমিধা ভেবেছিল, বারোটার মধ্যেই হৃদয় পৌঁছে যাবে। কিন্তু হৃদয়ের পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা দুটো বেজে যায়। আকাশে তখন চড়া রোদ। হৃদয়ের গলা শুকিয়ে আছে। খিদে পেয়েছে খুব। গেট দিয়ে ঢূকতে ঢুকতে দেখে, তিনতলার বারান্দায় সমিধা পায়চারি করছে। বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত সে হাঁটছে, খুব দ্রুত, দেওয়ালের কাছে গিয়ে ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসছে। ঘোরার সময়ে একবার দ্রুত গেটের দিকে তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সমধার চুল এলোমেলো। সারা মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কালো হয়ে আছে সেই মুখ। সেই মুখ তেল চিটচিটে। দেখে মনে হয় কাল সারারাত ঘুম হয়নি। ঘুম থেকে উঠেও স্বস্তিতে নেই। সমিধার মুখে কোনও সৌন্দর্য নেই। বরং ওর দিকে তাকালে প্রথমেই কেমন একটা বিকর্ষণ হয়। ওর বাবার মতৈ দেখতে ওকে। সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা নেই। এমন কিছু আছে, যা ঠিক কদর্যতা নয়, বরং ব্যাখ্যা করা যায় না এমন এক শূন্যতা, যার দিকে তাকালে কোনও অনুভূতিই জাগে না মনে। এখন সেই মুখ দুর্ভাবনায়, অস্থিরতায়, ভেতরের কোনও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় কেমন অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। হৃদয়ের সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সে বাড়ির ভেতরে ঢোকে।

(ক্রমশঃ) 

  


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন