সব-ই মনে হয় যাদু। কিসের যাদু, কে দেখাচ্ছে, ওকেই বা কেন, ও জানে না। ও শুধু দেখে। মন
খারাপের কুয়াশার মধ্যে ও একা একা ঘরে বসে থাকে। দিন গড়িয়ে যায়। পোষা বিড়ালটা কোন
আদর না পেয়ে বিরক্ত হয়ে সরে যায়। অন্য কোথাও। জানলা দিয়ে আসা রোদ্দুরটুকু
ক্রমে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। ও হাতের তালু দ্যাখে, পুরনো বইগুলোর মলাটের দিকে
তাকায়। মায়ের ছবির পিছন থেকে একটা টিকটিকি বেড়িয়ে আসে চটা ওঠা দেয়ালে। আর
ঘরটা, নয় বাই দশ, ক্রমে অস্পষ্ট হতে থাকে। সেদিন ওর আর খাওয়া হয় না, পড়া হয়
না।
আর ঘোর কেটে গেলে নির্জন রাস্তায়, অন্ধকার পথে হাঁটতে হাঁটতে
হাসে। ওর কেন জানে না, হাসি পায়। এই যে সেদিন বিকেল বিকেল আলোয়। দূর থেকে
দোকানটা দেখে ওর মনে হয়েছিল, নানান ফল বিক্রি করার একটা রঙিন দোকান। এগিয়ে গেল।
সামনে দাঁড়াতেই পালটে গেল চিত্রপট। কেবলই ফুলের মেলা। শীত আসছে। আর এ যেন এক
অলীক সম্ভার! ফুলের, স্যাকুলেন্টের, ক্লাইম্বারের। সব নাম ও
জানে না। ভালবাসে, এ টুকুই। তবে ফুল ও নেবে না। ও নেয় না। ওর জায়গা
কোথায়! ও শুধু অচেনা ফুলগুলোর, স্যাকুলেন্টের নাম জিজ্ঞেস করে। কি সুন্দর সুন্দর নাম!
আলিসাম, জারবেরা, ঝিন্টি, ক্লিওম স্পিনোসা, কসমস, পিটুনিয়া, আরও কত কি!
ও দাম জিজ্ঞেস করে। দোকানি বিরক্ত হয়। বলে, এখন ভীড় আছে। আগে কাস্টমার
সামলাই। রবিবার দুপুরের দিকে আসুন। এমনভাবে বলে, ও মজা পায়। একটি মেয়ে, বছর সতেরোর হবে, কিন্তু রেগে যায়।
-অমন করে বলছেন কেন! উনি-ও তো একজন কাস্টমার। আগে
ওকে দিন। আমরা অপেক্ষা করছি।
ও মেয়েটির দিকে তাকায়।
-না না ঠিক আছে। আপনারা নিন। পরে আসবো।
হাসে, নেমে আসে। ও হাঁটতে থাকে। মেয়েটার চোখ দুটো
কী মায়াবী! আহা! ওর ভালো হোক। পছন্দের গাছ ও পেয়ে যাক। ওর মনটা ভালো হয়ে গেল। তো
এটা যাদু নয়! মেয়েটার কথায় কথায় কি চমৎকার এক সন্ধ্যা ওর চারপাশে নেমে এল যে!
এমন তো আশাই করেনি।
সেদিন দুপুরে কি করবো কি করবো এমন মন খারাপ নিয়ে
এলোমেলো ভাবে ও চলে এসেছিল সুমির বাড়িতে। সুমি কলেজে এডুকেশনে থার্ড ইয়ার। তবু
বাড়িতে ফ্রক জাতীয় কিছু একটা। সাদা লাল ফুল ফুল। বেশ চোখে পড়ার মতো চেহারা।
সব সময়েই টেনশনে। কি নিয়ে, ও বোধহয় নিজেও জানে না। ওকে দেখে সুমি কিন্তু মোটেই
খুশি হ'ল না।
-এ সময়ে! দুপুরের ঘুমের কি হ'ল?
ও হাসলো।
-নোট খুঁজে পাচ্ছিস না? নাকি মোবাইল?
-তাতে তোর কি! মেলা ভ্যাজভ্যাজ করিস না তো। যা, বাড়ি গিয়ে নেট-এর ফর্ম
ফিলাপ কর।
সুমি আঙুল মোচরাচ্ছে। তার মানে যথেষ্ট টেনশনে। ও
হাসলো। সুমিকে রেগে যেতে দেখলে ওর খুব হাসি পায়। ও শুধু বললো, বাথরুমটা দেখে আয় তো। আর
বইয়ের র্যাকের তিন নম্বর খোপটা।
সুমি বাধ্য মেয়ের মতো দৌড়ে গেল। যেন ছোট্ট
বার্বি। তারপরেই হাতে মোবাইল। র্যাক থেকে নোটগুলো। দৌড়ে এলো আবার। দাঁড়ালো ওর
সামনে। ও ৫-১০। সুমি ৫-৩ হবে। হাসলো। বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে টপাস করে একটা চুমু
খেল ওর ঠোঁটে।
-তুই কি করে জানলি রে! কিছু না বলে চুমু-র সঙ্গে
মন ভালো হয়ে যাওয়াটুকু নিয়ে হাসতে হাসতে ও বেরিয়ে এল।
একে কি ও ম্যাজিক বলবে না! দুপুর ফুরিয়ে সে
বৃন্দাবনী আমগাছটার নিচে চাতালে এসে বসলো। বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। চারপাশটা বেশ
ফাঁকা ফাঁকা। ও এদিকওদিক তাকালো। এমন কি পুরনো স্নিকারের দিকে। ওর কেমন যেন
ঘুম পাচ্ছে। শ্বেতপাথরের চাতাল। চৈতন্যদেব বিশালকায় ছিলেন। আঙুলগুলো কি সরু
সরু! দুহাত উপরে, যেন ওই উপরের সবটুকু আলো উনি নিয়ে এক্ষুনি ছড়িয়ে দেবেন
ওর জন্য। ধ্যাৎ! কি সব ভাবছে!
দাদাটা সাতদিনের জ্বরে দুম করে চলে গেল। বাবা
বিছানা ছেড়ে আর উঠতেই পারেন না। ওরও রোজগারের এখনো কিছু ঠিক নেই। টিউশন আর
কতটুকু দেয়! ওর জন্য আলো কোথায়! হঠাৎ চৈতন্যদেব ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন।
চমকে উঠলো ও। ইউক্যালিপটাসের পাতা ঝরছে। একটা হাল্কা সুগন্ধ। ও আবার তাকালো
চৈতন্যদেবের মুখের দিকে। কি ক্ষমাশীল চোখ! না:! ওর কি কোনদিন চৈতন্য হবে!
অঘ্রাণের শেষ। কুয়াশা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। এখানে বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।
ধীর পায়ে ও নদীর দিকে। রাস্তায় লোকজন খুব কিছু
না। নদী কিছু দেরী আছে। ঢালাই রাস্তা ক্রমে ফাঁকা হয়ে আসছে। খুব শব্দ করে একটা
মোটরসাইকেল পাশ দিয়ে চলে গেল। এতো জোরে যে রাস্তার পাশের কালকাসুন্দির ঝোপগুলো
যেন হাততালি দিয়ে উঠলো। ছেলেটার নিশ্চয়ই খুব তাড়া আছে। কেউ বোধহয় অপেক্ষা
করছে। ওর জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে না। তুলি বলেছিল। তুলি এখন হৃদয়পুরে। তিনতলা
বাড়িতে থাকে। একদিন ও এমন কিছু করবে, সারা শহর ওকে দেখবে বলে অপেক্ষা করবে। হেসে ফেললো ও।
সামনে নদী। নির্বিকার, নিরবচ্ছিন্ন। আকাশের দিকে
তাকালো। কেমন যেন লাল লাল মনে হচ্ছে। ঝড়ের কথা মনে পড়লো। লালদেদের কথা। পঙ্কজকুমার
চট্টোপাধ্যায় ওকে শুনিয়েছেন। 'তাদের কটূক্তি আর থুতু যেন আমার মুকুট/কুৎসা আমার প্রতি
পদক্ষেপকে তাড়া করে/ আমি লাল, আমি অবিচলিত থাকি আমি কি বোকা, ওদের রাখার জায়গা কোথায়?’
এই নদী, এই বাবলা বন, ভেজা বালি ওকে যে কত কি দিয়েছে, দেয়! অসময়ে নুন-ও দেয়। ও
কিছু চায় না। এমনিতেই ওরা দেয়। এখন যেমন। ও সেদিনের দোকানের ফুলগুলোর কথা,
মেয়েটার চোখদুটো ভাবছিলো।
দুটো পা-ই জলে। ফুলগুলো কি সুন্দর! হঠাৎ ও দেখলো
আকাশ জুড়ে ফুলের মেলা। একটা একটা পাঁপড়ি ঝরে পড়ছে। তারপর বৃষ্টির মতো। ও
দুপাশে তাকালো। নির্জন, নি:শব্দ। জলে ভেসে যাচ্ছে ফুল। দু'একটা ওর পা ছুঁয়ে যাচ্ছে।
ক্রমশ সারা শরীর। ওর সারা শরীরে এখন ফুলের পাঁপড়ি। তুলি এসে একটা তুলে নিল। তুলি
কোত্থেকে এলো এখানে! অলৌকিক, নগ্ন, যেন পরী। ও স্পষ্ট দেখতে পেল তুলির ডান
জঙ্ঘায় সেই লাল তিল। এক শীতের দুপুরে ঐ তিলে ও চুমু খেয়েছিল। তুলি তখন
কাঁপছিল। তীব্র আকাঙ্ক্ষায়। ও জানালা দিয়ে দেখেছিল একটা দোয়েল। ও উঠে এসেছিল।
আর কোনদিন ও দোয়েল দেখেনি। আর কোনদিন ও তুলির কাছে যা পারাপারের ব্রিজটা আর
দেখা যাচ্ছে না। শহর টেরই পেল না, আজ শহরে ফুলের শ্রাবণ নেমেছে। ও এক পা দু পা করে উঠে
এলো। ওকে যেতে হবে। তুলি, সুমি, ওর বাবা, এমন কি একটা শহর অপেক্ষা করছে। শুধু
ওর জন্য। ভেজা পোষাক ও খুলতে শুরু করলো। ওকে যেতে হবে।
|
অপূর্ব। আহা ! ফুলের শ্রাবণ-- কবি ছাড়া এ সুশ্রুষা মানুষ আর কার কাছে পাবে !!...প্রণব
উত্তরমুছুন