সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


যে মূহূর্ত শেষ হয়ে যায়...

‘আজ শুক্লা একাদশী হেরো নিদ্রাহারা শশী, ওই স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি’- আম্রকুঞ্জের লাভার্স লেনে পার্থ’র সঙ্গে দেখা করতে এসে গুনগুন গাইছিল যাজ্ঞসেনী। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা পার্থ পেছন থেকে ওকে চমকে দিয়ে বললো - চাঁদেরও স্বপ্ন!

-স্বপ্ন তো সকলেরই থাকে পার্থ! প্রতি মূহূর্তে পূরণে্র দিকে যেতে যেতে বেঁচে থাকার আনন্দ!

-তোমারও স্বপ্ন আছে যাজ্ঞসেনী?

-নাঃ। থাকতে নেই। কিন্তু ভীষণভাবে আছে। তারা সমস্ত সময় আমায় হন্ট করে, দগ্ধায়। আম্রকুঞ্জের লাভার্স লেনে আমার সর্বস্ব নিয়ে লুকিয়ে এসেছি তো তোমায় এতদিন পরে দেখবো বলে পার্থ! তোমার হাত আমার পারমিশন ছাড়াই আমার শরীরে তার কারিকুরি চালিয়ে বিবশ করে দিচ্ছে আমায়, আর আমি গ্লানির অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি।

-গ্লানি! কেন? আমাকে তুমি ভালোবাসো না যাজ্ঞ?

-বাসি। আমার সকল দিয়ে বাসি। আর সেইজন্যেই তো গ্লানি। আমার বৈধ স্বামীর সঙ্গে আমায় লুকিয়ে দেখা করতে হচ্ছে, এই চরম গ্লানি আমি রাখবো কোথায় পার্থ! তোমার হাতের বেহিসেবী মুদ্রায় তুমি আমায় যতই বিবশ করছো, তার দ্বিগুণ ঘৃণা আমার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ঠিকরে বেরোচ্ছে।

-ঘৃণা! আমার প্রতি!

-হ্যাঁ। পার্থ। আমাকে ডেকে এনে তুমি নিজেকে পরিতৃপ্ত করছো। আরো কিছু তৃষ্ণাসাথী তোমার আছে। তবুও...

-চলো যাজ্ঞসেনী, আমরা পালিয়ে যাই পৃথিবীর নির্জণ কোনো প্রান্তে। শুধু তুমি আর আমি।

-কেন? পালাবো কেন! সাহস থাকে তো ঘোষণা কর, যাজ্ঞসেনী তোমার। শুধুই তোমার!

-তা হয় না রে যাজ্ঞ। মায়ের কথা...

-অমান্য করলে পাপ হবে, তাই না? একজন নারীকে পাঁচজনে ভোগ করবার আদেশ দিয়ে তিনি পাপ করেননি? নারী হয়ে নারীর মনের কথা তিনি বোঝেন না? আসলে এই আদেশ তাঁর পূর্বপরিকল্পিত! আসলে  বহুগামিনী বলে আমি যাতে কোনোদিন তাঁর দিকে আঙুল তুলতে না পারি তাই পরিকল্পনা করে এই আদেশ। আমি কি বুঝিনি!

-কি বলছো তুমি যাজ্ঞসেনী!

-যা বলছি তা তুমিও ভাল করেই জান। তোমার মা কুমারী এমনকি বিবাহোত্তর জীবনেও কত পুরুষের অঙ্কশায়িণী হয়েছিলেন, তোমরা জানো না?

-সে তো পুত্রলাভের জন্য! বাবার আদেশে!

-পুত্রলাভ আর রাজত্বলাভই বড় হলো তাঁর কাছে! তোমার বাবা কেমন পুরুষ যে নিজের স্ত্রীকে নিজের স্বার্থে বহুগামিণী হবার আদেশ দেন! নিজের নারীকে প্রকৃত ভালোবাসলে কেউ এরকম ঘৃণ্য আদেশ দিতে পারেন? মা-বাবার হয়ে কোনো বাজেকথা বলতে এসো না আমার কছে। আসলে দুজনের কেউই পরস্পরকে ভালোবাসেননি। ভালোবাসলে কুন্তী থাকতেও তিনি মাদ্রীকে বিয়ে করতে পারতেন না। আর স্বামীর বীর্যহীনতার সুযোগে তোমার মা যথেচ্ছো পুরুষসংসর্গে মেতে উঠেছিলেন। কুন্তীমাতার সম্বন্ধে আর কিছু বলতে এসো না আমায়। ইতিহাস বিকৃত করে আজ যাঁরা তাঁকে সতী নাম দিয়েছেন, ধিক তাদের! আমি যাতে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারি তাই একটি আদেশেই চালাকি করে আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন।

-চুপ কর এবার।

-না। চুপ করে থেকে আমি এতগুলো বছর কাটিয়েছি, তোমাকে পাইনি কাছে এখনো পর্যন্ত, কতজনের হাত ঘুরে আমি তোমার কাছে পৌঁছাব বলো! যাকে ভালোবেসেছি তার সাথে আমাকে লুকিয়ে দেখা করতে হচ্ছে! কেন পার্থ! এর জন্য কি তোমার মা দায়ী নন? তুমি আমি দুজনেই বৈধ ভাবে জন্মাইনি। দুজনেই জানি সেকথা। জেনেও আমরা পরস্পরকে ঘৃণা করিনি। গ্রহণ করেছি। তুমি তো তোমার বাবার মতো বীর্যহীন নও  পার্থ! তবুও আমাকে অন্য পুরুষের কাছে যেতে হয় কোন যুক্তিতে? আমি একমাত্র তোমারই সন্তানের মা হতে চেয়েছিলাম পার্থ!

এভাবে পালিয়ে নয়। আজ সবার সামনে মাথা উঁচু করে আমাকে নিয়ে চলে যেতে পারো যদি, তবেই, নাহ’লে কোনোদিনও নয় পার্থ! আর যদি পারো, তবে এই মূহূর্তেই...

যে মুহূর্ত শেষ হয়ে যায়, তা মরে যায়...  

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন