মদমত্তা মোহিনীমায়া
মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে ফরসা অশ্বারোহী জনজাতির লোকজন খেপে খেপে পূর্বদিকে আসতে শুরু করে প্রায় চারহাজার বছর আগে থেকে। আজকের দিনে যে জায়গাগুলো নিয়ে উক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান নামের দেশগুলি তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে। সিন্ধুসভ্যতার তখন শেষ অবস্থা। বহিরাগত এই সব গোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষরা সংখ্যায় ছিলো বেশি। তারা স্থানীয় আদি অধিবাসী নারীদের সঙ্গে বসবাস ও সন্তান উৎপাদন করতে শুরু করে। নিজেদের গোষ্ঠীর নারীদের নিয়ে বিশেষ অধিকারপ্রবণ ছিলো তারা। স্থানীয় অধিবাসীদের সংস্পর্শ থেকে তাদের দূরে রাখতে চাইতো। প্রথম যুগে তাদের সামাজিক পরিচয় ছিলো যাযাবর, অর্ধসভ্য জাতি। ইন্দো-ইরানিয় ভাষায় কথা বলতো। অন্যদিকে এদেশে তখন স্থানীয় অধিবাসীদের সভ্যতা ছিলো বিশেষ ভাবে আলোকপ্রাপ্ত। ভূমি দখলের লড়াইতে বহিরাগত জনজাতিরা তাঁদের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো। অশ্বের ব্যবহার জানার ফলে নবাগতদের সামরিকশক্তি ছিলো স্থানীয় লোকজনদের থেকে বেশ খানিকটা বেশি । যদিও এদেশীয় রাজাদের বিক্রম কোনও অংশে কম ছিলো না। যেমন, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরভ্রাতা ছিলেন একটি রাজ্যের একছত্র অধীশ্বর। তাঁরা ছিলেন বীর্যবান ও পরাক্রমশালী রাজা। পরম তপস্বী হিসেবেও তাঁদের খ্যাতি ছিলো। বলা হয়, তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাঁদের বর দান করেছিলেন। যদিও হিসেব মতো 'ব্রহ্মা' তাঁদের দেবতা ছিলেন না। দেবতার বর অনুযায়ী কোনও মানব, দেবতা বা দানব তাঁদের সংহার করতে পারতেন না। এই গুণী রাজা দেবী পার্বতীর রূপমুগ্ধ হয়ে পড়েন। লক্ষণীয়, সব অসুর রাজাদের সম্বন্ধেই আর্যমূলের কবিরা এই 'ত্রুটি'টির উল্লেখ করেছেন। তেজস্বী অসুররাজদের আর্যমূলের নারীদের প্রতি 'দুর্বলতা', কালক্রমে তাঁদের বিনাশের কারণ হতে দেখা যায়। মনে হয় বহিরাগত আর্য সংস্কৃতির লোকজনই এদেশে প্রথম উদ্দিষ্ট পুরুষদের চরিত্রহনন করতে 'নারীঘটিত' স্খলনের অভিযোগ আনা শুরু করে। শুম্ভ-নিশুম্ভও কোনও ব্যতিক্রম ছিলেন না। যুদ্ধের মাধ্যমে পার্বতীকে অধিকার করার প্রয়াসে রাজা শুম্ভ ক্রমান্বয়ে তাঁর সেনাপতি চণ্ড আর মুণ্ড, সুগ্রীব, ধূম্রলোচন, রক্তবীজ এবং ভাই নিশুম্ভকে হারান। ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত শুম্ভকে বিনাশ করার জন্য ‘নতুন দেবী'র প্রয়োজন হওয়ায় পুরাণকাররা পার্বতীর দেহ-কোষ থেকে 'কৌষিকী' নামের দেবীকে সৃজন করার কল্পনা করেন। অন্যমতে, আজকের হিমাচল বা কাশ্মীরের অধিবাসী 'কুষিক' জনজাতির আরাধ্যা ছিলেন দেবী কৌষিকী। ঘটনা যাইহোক, 'দেবীমাহাত্ম্যম' অনুযায়ী দেবী কৌষিকী অসুররাজ শুম্ভকে বধ করেছিলেন। তারপর এই দেবী আবার পার্বতী বা দুর্গার দেহে বিলীন হয়ে যান।
বিভিন্ন রাজ্যের স্থানীয় রাজাদের মধ্যে রাজা মহিষ ছিলেন তিনভুবনের সেরা পুরুষ। সুপুরুষ, বীর্যবান, সৎ, স্বাভাবিক একজন মানুষ। এতোগুলো গুণ যাঁর থাকে, তিনি বহিরাগতদের অভিযোগ মতো স্রেফ 'চরিত্রহীন' হতে পারেন না। না হয় তিনি এদেশেরই ভূমিপুত্র। না হয় বিশ্বাস করতেন, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। তাঁকে বাহ্লীক, হিন্দুকুশ পেরিয়ে এদেশে প্রতাপ বিস্তার করতে আসতে হয়নি। গায়ের রংটা একটু শ্যামলা। কোত্থেকে ঘোড়ায় চড়ে একগাদা ফর্সা লোকজন এসে এদেশে এন আর সি চালু করার ঢের আগে থেকেই তিনি মস্তো রাজা। এই বহিরাগতের দল তখন নিজেদের 'দেবতা' বলতে শুরু করেছেন। যতক্ষণ তাঁরা ঝামেলা করেননি ততক্ষণ মহিষ তাঁদের কিছু বলেননি। কিন্তু নাল্পে সুখমস্তি। ফর্সা জনতা সিন্ধুসরস্বতী পেরিয়ে এসে মহিষকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে দেন। তখন মহিষ তাঁদের এমন মার দিলেন, তাঁরা রীতিমতো কেঁদেকেটে পালালেন পাহাড়পর্বতের দিকে। যতোরকম গালাগালি ছিলো তাঁদের ভাষায়, সব কিছু দাগতে লাগলেন মহিষের নামে। কিন্তু বৃহৎ বৃহৎ দেবতারা, যেমন, ইন্দ্র, বিষ্ণু, যম, বরুণ, ব্রহ্মা, বিশ্বামিত্র ইত্যাদি এমন নাকাল হয়েছিলেন যে সবাই মিলেও আবার রাজা মহিষের সঙ্গে লড়াই করার হিম্মত করেননি। শেষে একজন জাঁদরেল সুন্দরী, বীর্যবতী নারী, যিনি ফর্সা দেবতাদের নিজের জাতেরও ন'ন, সবাই মিলে তাঁকে ধরে পড়লেন।
“তত্র ত্বিষা ব্যপ্ত লোকত্রয়ম অতুলং
সর্ব্বদেবশরীরজং তৎ তেজঃ একস্থং
নারী অভূৎ।"
যদিও এই দেবী নবাগতদের এদেশে আসার আগে থেকেই রাজত্ব করতেন। দেবতাদের নিরুপায় অনুরোধে রীতিমতো দ্বিধার পড়ে শেষপর্যন্ত রাজিও হয়ে গেলেন। সেই নারীর মধ্যে নাকি সব দেবতার তেজ। তিনি শর্ত দিলেন নিজের নারীসেনাদের নিয়েই যুদ্ধু করবেন। অপদার্থ পুরুষ দেবতারা যেন এর মধ্যে না পড়েন। পুরুষ দেবতারা তো খুব বেঁচে গেলেন। নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জাম সবকিছু ঐ সুন্দরী, বীর্যবতী কন্যাকে সোপর্দ করে সোমরস পান করতে করতে লম্বা ঘুম দিতে গেলেন। সে নারী আবার মধুপান না করলে লড়তে পারেন না। কুবেরদেবতা তখন এমন একটা কলস সাপ্লাই করলেন যার থেকে সুরা কখনও ফুরোবে না।
এই নারীর রূপ আর ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে রাজা মহিষ তাঁকে বলেছিলেন, হে নারী, আমি কখনও কারো কাছে কিছু প্রার্থনা করিনি। কিন্তু তোমার কাছে আমি প্রেম যাচ্ঞা করছি। তুমি তা স্বীকার করো। দেবী বললেন, তবে তুমি দেবতাদের হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দাও। রাজা বললেন, তা তো সম্ভব নয়। ও তো আমার দেশ। দেবী বলেছিলেন, তবে যুদ্ধ করো। সে কী ভয়ানক লড়াই! বিরাট মার্কণ্ডেয়চণ্ডী জুড়ে তার বিশদ বর্ণনা করেছেন কবিরা। লিখেছেন, মহাপরাক্রমী রাজা মহিষের সঙ্গে যুদ্ধের সময় দুর্গা খুব রেগে গিয়ে বারবার মদ্যপান করতে করতে রক্তনেত্র হয়ে অট্টহাস্য করছিলেন।
"ততঃ জগন্মাতা চণ্ডিকা ক্রুদ্ধা উত্তমং পানং (মদ্যং)
পুনঃ পুনঃ পপৌ অরুণলোচনা রক্তনয়না
জহাসঃ চ।।"
যে বীর রাজা জীবনে কোনও যুদ্ধে পরাজিত হননি, দেবী তাঁর প্রতি মায়াজাল বর্ষণ করে বশীভূত করে ফেলেছিলেন। তিনি যে মহামায়া। তিনি বলেছিলেন, সব মেয়েদের মধ্যেই তাঁর অংশ রয়েছে। মোহগ্রস্ত পুরুষ মেয়েদের মায়াজালে তাদের সব বীর্য হারিয়ে ফেলবে এটা তো 'দেবতা'র বিধান। কে তাকে জয় করবে?
সেই সুরামুগ্ধা, মদমত্তা, পরমনারীরত্নের
অস্ত্রাঘাতে প্রাণ দেওয়া ভিন্ন পুরুষের কাছে আর কিছু বিকল্প থাকে না। এই জায়গায় মহাবিক্রমী
মহিষ আর ম্যাদামারা মেধো কেরানির কোনও তফাত নেই। আমাদের আয়ু বলতে তাঁর মধুপানের বিরতিটুকু
মাত্র। তার পর কী হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বিশদে ব্যাখ্যান করে গেছেন,
গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ়, মধু যাবৎ পিবাম্যহম।
ময়া ত্বয়ি হতে ঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু
দেবতাঃ।।
যোদ্ধা দেবীদের মধুপানের পরম্পরাটি এসেছিলো কৌমসমাজের আরাধ্য দেবীচেতনার থেকে। হিমালয়নন্দিনী পার্বতীকে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ কালক্রমে এই দেবীরা সংস্কৃত পুরাণ ও সাহিত্যে পার্বতীরই অংশ হয়ে যান। নানা স্থানে কালী বা কালিকা নামে এক রক্তলোলুপা, ভয়ঙ্করী দেবীর উল্লেখ পাই, যিনি মদ্যমাংসপ্রিয়া, শবর, বর্বর, পুলিন্দগণের আরাধ্যা (খিল হরিবংশ)। পুরাণ যুগের মধ্যবিন্দু সপ্তম শতকে বাণভট্টের 'কাদম্বরী' এবং সমসাময়িক ভবভূতির 'মালতীমাধব' নাটকে যে দেবীর কথা শোনা যায় তাঁকে শবরজাতি মদ্যসহ নরমাংস নিবেদন করতেন। এর সঙ্গে ছিলেন রক্তলোলুপা চণ্ডী বা করালা দেবী। এঁরা কৃষ্ণবর্ণা, উগ্রা, মদমত্তা, চামুণ্ডার উপদেবী। বনের কাছে শ্মশানে অধিষ্ঠান করেন। পরবর্তীকালে এঁরা কালী বা কালিকা দেবীর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে গেছেন। সেকালে মূলস্রোতের আর্য লেখকদের রচনায় দেবী কালীর প্রতি মর্যাদাকর মন্তব্য পাওয়া যেতো না। তাঁদের মনোভাব দেখলে বোঝা যাবে কালী তখনও ব্রাহ্মণ্য দেবীর সম্মান লাভ করেননি। মার্কণ্ডেয় পুরাণের 'চণ্ডী' অধ্যায়ে চামুণ্ডা, কালী, কালিকা, কৌষিকী (ইনি গৌরী, তারও দীর্ঘ গল্প আছে ), অম্বিকা প্রভৃতি দেবীর সঙ্গে পার্বতীর গুণ ও লক্ষণ সমন্বিত করে করালবদনা কালীর রূপকল্প প্রস্তুত করা হয়েছিলো। যদিও এই সব দেবীর প্রধান স্বভাব-লক্ষণের মধ্যে একটি ছিলো তাঁদের মদ্যপ্রিয় রুচি। বামাচারী তন্ত্রসাধনার আবশ্যিক অঙ্গ পঞ্চ-ম'কারের প্রথম উপচারই মদ্য। আর্য পরম্পরার পার্বতীর মাহাত্ম্য সেখানে 'ম্লান' হয়ে যায়।
দেবভাষায় 'মদ' শব্দটির পরিভাষার সীমা নেই। হর্ষ, মত্তভাব, তৃপ্তি, মদ্য, সুরা, মধু, কস্তুরী, সোম, 'মত্ততাজনক পেয়', অনুরাগ, কল্যাণকর বস্তু, গর্ব, অহংকার, নায়িকার অলংকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত আমরা 'আগমসার' নামের সংকলনটি থেকে এই শ্লোকটিই পড়ি,
''সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে ।
পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ।।''
''হে পার্বতী! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক।" বিশ্বজননীর ইচ্ছেমতো মদমত্তা মোহিনীমায়া আমাদের চিরকাল অভিভূত করে রাখুন।
(সঙ্গের ছবিটি বীরভূমের ইলামবাজারে রামেশ্বর শিবমন্দিরে তোলা)
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনখুব ইন্টারেস্টিং এই আদিম অধিবাসীদের দেবী দেবতাদের আস্তে আস্তে আর্যদের দেবীদেবতায় পরিণত হওয়া আর তার না হলে তাদের অসুর/রাক্ষস/ রাক্ষসী বলে গণ্য করা --এই বিষয়ে যদি ডিটেলে লেখেন, মনে হয় অনেকেরই ভালো লাগবে
উত্তরমুছুন