বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

 

কবি বিনয় মজুমদার সম্পর্কিত কিছু নতুন ভাবনা


(‘গল্পকবিতা’ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো - ‘ইন্টারভিউ’/ আমার সৃষ্টিরা সব কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত জিজ্ঞাসাবাদঃ দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় / রেকর্ডিংঃ কৃষ্ণগোপাল মল্লিক / অনুলিখনঃ দুলালচন্দ্র দাস /  সম্পাদনাঃ সুনীলকুমার দত্ত)

 


প্রথমে আছে একটি চিঠি। তপন গঙ্গোপাধ্যায় (২৬.০১.৭২) কবিতা চেয়ে চিঠি দিলে উত্তরে বিনয় মজুমদার  (৫.২.৭২) লেখেনঃ... ‘আপনাদের কাছে আমার লেখা কবিতা পাঠাতে পারলাম না। কারণ আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি, আর কোনো দিন কবিতা লিখব না।’ এই ঘোষণা স্তম্ভিত করেছিল কবিসমাজকে। সত্যিই আর তেমন লেখা হয়নি। ওঁর কয়েকটি খসড়া দেখেছেন ‘মহাবাহু’ সম্পাদক অভিজিৎ লাহিড়ীর কাছে প্রাবন্ধিক অর্ণব সেন। অর্ণব সেনের বর্ণনায় প্রায় দুর্বোধ্য হাতের লেখা, কবিতাও নয়, শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ পরপর সাজানো। কবি তখন দারিদ্র্য অবহেলায় শেষ শয্যায়। না, বিনয় মজুমদার অনেক আগেই চলে গেছেন। একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর সাক্ষাৎকার দুটি মন্তব্যই তুলে দিচ্ছিঃ (১) ‘না, কবিতা আমি লিখতাম, এটা ঠিক, কিন্তু সেটা আমার গণিত চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে এবং তুমি আমার কবিতাগুলো পড়ে দেখলে পাবে যে অধিকাংশই গাণিতিক কবিতা।’ (২) সব শেষে প্রশ্ন ছিল ‘আপনি গণিতের যে স্তরের কথা বললেন সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট অবস্থা তো কবিতার খুব কাছাকাছি।’ বিনয়ের উত্তরঃ ‘হতেও পারে আবার তা নয়ও। কারণ কবিতার প্রধান বস্তু ইমাজিনেশন আর গণিতের মূল উপাদান হার্ড ফ্যাক্টস যা বাস্তব।...’

বিনয় মজুমদারের কবিতা অনেকগুলো বেরিয়েছিল ‘গল্পকবিতা’ পত্রিকায়। মার্চ ১৯৭০ এর সংখ্যায় বেরোয় ‘বিনয় মজুমদারের আরো কবিতা’। তিনটির মধ্যে ছিল ‘ধ্বনির সহযোগিতায়’, ‘আলট্রা বলেনি’ এবং ‘আমলকী’। ‘আমলকী কবিতার কিছু অংশঃ

‘এক বলে কিছু নেই, কারণ দুয়ের মতো সাজানো তিনের চার, পাঁচ ...দশের অস্তিত্ব সকল কিছু ভেদ ক’রে চলে যায় দুই তিন... দশ নেই এই ভেবে ভেবে...

কিন্তু, আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন যে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি নতুন উদ্যমে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। দেড় বছরে দুইশত কবিতা লিখেছেন। তাহলে কবির কথা অনুযায়ি ১৯৭১ সালের শেষ পর্যন্ত লেখা এই সব কবিতা। হতেই পারে ১৯৭২ সালেই আবার তাঁর মানসিক ব্যাধি শুরু হয়, যা শুরু হয়েছিল তিনি ১৯৬৭ সালে কলকাতা ছেড়ে শিমুলতলা যাওয়ার পর থেকেই। জানা যায় কবি ১৯৬৭ সালেই বিনা পাশপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েন এবং ছয় মাস জেল খেটে বাড়ি ফেরেন। জানা যায় যে ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে দুইবার মানসিক রোগের কারণে দীর্ঘদিন কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

উপরের সাক্ষাৎকারে কবি যে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন তার সমর্থনে আমরা আরও কিছু তথ্য পরিবেশন করতে পারি। আর একটি কথা আত্মপরিচয় প্রবন্ধে ১৯৭০ সালের পর জীবনের কোন তথ্য নেই। ১৯৯৩ সালে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসমগ্র ১ম খণ্ড প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সম্পাদকের সাথে কবির যোগাযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও আত্মপরিচয় পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি কেন? নিশ্চয় কবিকে দিয়ে আর কিছু লেখানো সম্ভব ছিল না।

১) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা সামাজিক মাধ্যমে বিনয় মজুমদারের যে সব গ্রন্থের আলোচনা দেখা যায় তার মধ্যে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসমগ্র ১০ খণ্ডের অন্তর্ভূক্ত “নক্ষত্রের আলোয়”, “গায়ত্রীকে”, “ফিরে এসো চাকা”, “অধিকন্তু”, “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” ব্যতীত আর তিনটি গ্রন্থের উল্লেখ পাই- “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”, “বাল্মীকির কবিতা” এবং “একা একা কথা বলি”। কিন্তু ১৯৭৪ সালের পর থেকে আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া পর্যন্ত গোটা দশেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি আগে লেখা অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন ছাড়া আর কিছু সম্ভব নয়।

২) এর মধ্যে দেখা গেছে “বাল্মীকির কবিতা” (১৯৭৬) এর পর “আমাদের বাগানে” (১৯৮৫) প্রকাশিত হয়েছে প্রায় দশ বছর পরে। তার মানে তিনি নিয়মিত লিখতে পারতেন না।

৩) “এখন দ্বিতীয় শৈশবে” লেখা হয় ১৯৫২ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। প্রকাশ করে শিলীন্ধ্র ১৯৯৯ সালে।

৪) কবি যে কাব্যজগৎ থেকে দূরে ছিলেন তা বোঝা যায় কবির বিলম্বিত আকাদেমি পুরস্কার লাভে। কবি জয় গোস্বামী পেয়েছেন ২০০০ সালে আর অনেক প্রবীণ এই কবি পেয়েছেন ২০০৫ সালে, মৃত্যুর আগের বছর। যে গ্রন্থের জন্য তিনি এই পুরস্কার পান তার নাম “হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ”। বোঝাই যায় কবির স্বাস্ত্যের অবনতি কবির আকাদেমি পুরস্কার ঘোষণার অনুঘটক হয়েছে।

৫) মৃত্যু এবং আকাদেমি পুরস্কারের পর গ্রন্থ প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায় প্রকাশক মহলে। ২০০৫ সালে “শিমুলপুরে লেখা কবিতা” প্রকাশিত হওয়ার পরে মৃত্যুর বছর মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় - পৃথিবীর মানচিত্র, বিনোদিনী কুঠী, একা একা কথা বলি, নির্বাচিত কবিতা, ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য, আকাশে চাঁদ নেই অথচ আজিকে পূর্ণিমা, দুপুরে রচিত কবিতা (২০০৬)। অসুস্থ মানসিক রোগগ্রস্ত রোগীর এতো লেখা জমা ছিল অপ্রকাশিত অবস্থায়?

 আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি নিজের কবিতার সম্বন্ধে লিখছেন,

 ‘অথচ তীক্ষ্ণতা আছে, অভিজ্ঞতাগুলি সূচিমূখ,

ফুলের কাঁটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের

পরিধির মতো তীক্ষ্ণ, নাগালের অনেক বাহিরে।

ফুলের কাঁটা এবং নক্ষত্রের দূরত্ব। উপমার মাধ্যমে দর্শনকে নিয়ে আসা। অঘ্রাণের অনুভূতিমালা ছয়টি কবিতা। আলাদা কবিতা হিসাবে ছয়টি পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছা দেখালেও প্রকাশ করেননি পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমালোচনা লিখে দেননি অমিতাভ দাশগুপ্ত।

ফিরে এসো চাকার ২১ নম্বর কবিতায়

অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার

সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে, বাতাসের

নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

কবির বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তবধর্মিতা কবিতায় প্রায়শই দৃষ্ট হয়। যেমন আকাশ যে সত্যি বর্ণহীন এবং বাতাসের কণায় আলোর বিচ্ছুরণের ফলে শুধুমাত্র নীল রং আমাদের চোখে আসে, তাই আমরা আকাশকে নীল দেখি। এই তত্ত্বটিই তিনি উপরোক্ত তিনটি লাইনে ব্যক্ত করেছেন। আবার “অভিজ্ঞতা” শব্দটির ব্যবহারও বাস্তবধর্মীতার পরিচায়ক হয়েছে বারবার তাঁর কবিতায়।

আবার ২০ নম্বর কবিতায়

আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভচারী

বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো নাই মেশো,

সেও এক অভিজ্ঞতা,

উপরোক্ত তিনটি লাইনেও সেই ফুটন্ত জলের থেকেই উদ্ভূত বাষ্পের এক কাব্যিক বর্ণনা বাস্তবধর্মিতার নিদর্শন রেখেও। আবার সেই “অভিজ্ঞতা” শব্দের ব্যবহার।

গায়ত্রীকে গ্রন্থের শেষ কবিতায় (১৪তম)

চাঁদের ছায়ার নীচে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের

সময়ে পৃথিবীলোকে দিগন্তের সর্বদিকে ছেয়ে,

কমলালেবুর মতো কী এক আশ্চর্য আলো জাগে।

সূর্যে কালো বৃত্তটিকে ঘিরে থাকে অপরূপ এক

রূপালী হীরকদীপ্তি; জ্ঞানোদয় হওয়া জেনেছি,

আকাশের রঙ নেই, বাতাসের নীলাভতা হেতু

আকাশের অবয়ব দিবালোকে নীল মনে হয়।

ঋতুস্রাব বন্ধ হলে যতই সঙ্গম করি, সখি,

সন্তানলাভের আশা সম্ভাবনা শূন্য হয়ে থাকে।

উপরোক্ত লাইন কয়টি বিজ্ঞানের অনুসারী মহাজাগতিক এক ঘটনার বর্ণনা কাব্যময়তার কায়ায়। আর এখানে আরো স্পষ্ট করেছেন আকাশ নীল শুধু দিবালোকে। রাতে আকাশের রং বর্ণহীন বা কালো। শেষ দুটি লাইন কবির আদিরসাত্মক রচনার নিদর্শন, যা এক সময় তিনি বেশ কিছু কবিতায় প্রকাশ করেছেন।

অঘ্রাণের অনুভূতিমালা গ্রন্থের ৫ম কবিতায়

পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে, চন্দ্র পৃথিবীকে ঘিরে কোনভাবে আবর্তিত হয়-

আবর্তিত হয়ে গেলে এদের গতির গুণ এবং ধরন কী-রকম

হয়ে থাকে জেনে নিতে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদে একসাথে বসে সব মাপা

ঠিক সমাধান নয়, সমাধান হলো আঁকা, চিত্রাকারে এঁকে তাতে আরো বহু বিশ্লেষণী রেখা

এঁকে-এঁকে জ্যামিতির, সূর্য চন্দ্র পৃথিবীর ঊর্ধে উঠে সেই জ্ঞানে- শুধু জ্ঞানে উপনীত হওয়া।

আমরা যা করি তার সবই এই আঁকাআঁকি, কোনটাই মূল হয়, সবই শুধু ছবি করে আঁকা।



এখানেও কবির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং কাব্যিক প্রকাশের এক মেলবন্ধন দেখা যায়। একটি নিমন্ত্রণপত্রের খামকে নিজের গাণিতিক ভাবনা দিয়ে অক্ষয় করে দিয়েছেন বিনয় মজুমদার। লেখার মধ্যে আছেঃ ‘-১’-এর বর্গমূল যাকে ইনফিনিটি বলা হয় এবং প্রকাশ করা হয় ইংরেজি ‘i’ দিয়ে। সেই খামটির প্রতিচ্ছবি ইনটারনেট থেকে সংগ্রহ করে দিলাম।

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন