মেয়েদের আত্মকথনঃ সৌদামিনী দেবীর ‘পিতৃস্মৃতি’
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন কন্যা ও বধূ নিজেদের কথা বলতে লিখেছেন আত্মজীবনী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রথম কন্যা সৌদামিনী দেবী। তিনি অবশ্য লিখেছেন পিতৃস্মৃতি, পিতাকে কেন্দ্র করে তাঁর স্মৃতিকথা। বিয়ের পর স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে তিনি পিত্রালয়ে থাকতেন ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী। নিপুণ গৃহিণীপনায় তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বিশাল পরিবারের কর্ত্রী। ঠিক যেমন ভাবে তখনকার শিক্ষিত ব্রাহ্ম অনুরাগী পরিবার মেয়েদের কাছে বিনয় ও সহিষ্ণুতা আশা করত তা ফুটে উঠেছিল সৌদামিনীর মধ্যে। তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর পিতা। বেথুন স্কুলের প্রথম বছরের ছাত্রীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। মেয়েদের শুধু লেখাপড়া শেখানো নয়, জাগ্রত করার প্রয়াস ছিল তাদের শিল্পবোধের। ভিক্টোরীয় এটিকেট আশা করা হত শিক্ষিত মেয়েদের কাছে। গৃহস্থালির কাজে সূক্ষ্মতা ও পরিচ্ছন্নতাবোধ এবং আত্মবিস্মৃত সহিষ্ণুতা প্রয়োজন ছিল। একটি চিঠিতে দেবেন্দ্রনাথ কন্যাকে লেখেন “তুমি সম্প্রতি অসহায় অবস্থাতে জ্বররোগে প্রপীড়িত হইয়া পড়িয়াছিলে অথচ তাহাতে একটি বাক্যস্ফুটও কর নাই। একি তোমার অসাধারণ ধৈর্য।’’ মেয়েদের শারীরিক অসুস্থতায় সহিষ্ণুতা এক বিশেষ শিক্ষা বলে মনে করা হত। সৌদামিনী দেবীর নিজের কথা সম্পূর্ণই পিতার স্মৃতিচারণ। সেখানে আত্মর উপস্থিতি পিতার ছত্রছায়ায়। সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে প্রধান, যা মেয়েদের অস্তিত্বে প্রবলভাবে আধিপত্য বিস্তার করে। তাই শীতবোধও পারিবারিক অভ্যাসের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তিনি লেখেন:
“কোন বিষয়ে
তিনি কোনোপ্রকার অপব্যয় ভালবাসিতেন না... সেইসমস্ত শৈথিল্যে
জীবনযাত্রার যে ছন্দভঙ্গ করে তাহা তাঁহার কাছে পীড়াজনক ছিল।... তখন শীতকালে গায়ে গরম কাপড় পরার রীতি মেয়েদের মধ্যে
ছিল না, আমরা পাতলা কাপড় পরিয়াই শীত যাপন করিতাম। মিশনারি মেমরা শীতের সময় আমাদের সেই পাতলা কাপড় পরা দেখিয়া আশ্চর্য্য হইয়া
যাইত—তাহারা বলিত, তোমাদের কি শীত করে না?
পিতা আমাদের জন্য রেশমের রেজাই তৈরি করাইয়া দিলেন। কিন্তু এমনি আমাদের অভ্যাস, সে রেজাই আমরা
পরিতে পারিতাম না, গরম হইত,
খুলিয়া ফেলিতাম”।
পিতা নিয়ন্ত্রিত পরিবারে মেয়েদের নিজস্ব সাজগোজ ছিল সম্পূর্ণ পুরুষ নিয়ন্ত্রিত, যার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা কন্যার। আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি যেখানে মায়ের ইচ্ছা বা ভালোলাগা না পূরণের মধ্যে তাঁর পিতার রুচিবোধের প্রতি প্রচ্ছন্ন গর্ব ফুটে ওঠে:
“মা একবার আমার
ছোট দুই ভগিনীকে নাক বিঁধাইয়া দিয়া বলিলেন, যাও,
কর্ত্তাকে দেখাইয়া নোলক চাহিয়া
আন। তিনি নাক বেঁধান দেখিয়াই বলিয়া
উঠিলেন, এ কি সং সাজিয়াছ! যাও যাও খুলিয়া ফেল!
বন্য বর্ব্বররাই ত নাক কান ফুঁড়িয়া গহনা পরে—এ কি
ভদ্রসমাজের যোগ্য! মা তাহাই শুনিয়া লজ্জায় মেয়েদের
নোলক পরাইবার সাধ মন হইতে দূর করিয়া দিলেন। পূর্ব্বে আমাদের বাড়ীতে কর্ণবেধের
সময় সমারোহপূর্ব্বক মেয়েদের ডাকিয়া খাওয়ানো হইত। এই কান বিঁধাইবার উৎসব পিতা উঠাইয়া দিয়াছিলেন”।
ঊনবিংশ শতকের
আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ভদ্রলোকের মধ্যে ভদ্র ও বন্য এই দুই রুচিগত ভেদ তৈরির প্রধান জায়গা
ছিল মেয়েদের শারীরিক উপস্থাপনা। জ্ঞানদানন্দিনীর
লেখাতেও পাওয়া যায় স্ত্রী-এর সাজপোশাক নিয়ে তাঁর উদ্বিগ্ন
বা মনোযোগী স্বামীর কথা। সৌদামিনী
দেবীর লেখাতেও তার মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের প্রয়াসের কথা পাওয়া যায়,
“ছেলেবেলা হইতেই মেজদাদা অবরোধ-প্রথার
বিরোধী ছিলেন, বিলাত হইতে ফিরিয়া তাঁহার উৎসাহ
আরো প্রবল হইয়া উঠিল। মেজবৌঠাকুরাণী
স্বভাবতই অত্যন্ত বেশি লজ্জাবতী ছিলেন, তাঁহার সেই
চিরদিনের সঙ্কোচ দূর করিয়া দেওয়াই মেজদাদার বিশেষ অধ্যবসায় হইল। বাড়ীর ছেলেমেয়েরা সকলে একসঙ্গে
বসিয়া খাইবে মেজদাদার এই ইচ্ছা জানিতে পারিয়া পিতৃদেব একটি বড় ঘরে খাইবার স্থান নির্দ্দেশ
করিয়া আমাদের সকলের একত্রে খাওয়া নিয়ম করিয়া দিলেন। প্রথম প্রথম আমরা লজ্জায় খাইতেই পারিতাম না—অল্প
কিছু মুখে দিয়া বসিয়া থাকিতাম, ক্রমে ক্রমে আমাদের লজ্জা ভাঙিল।’’
বাঙালি পুরুষের রিফর্মিস্ট রূপটি এখানে স্পষ্ট, যেখানে
ভদ্রমহিলারাও পুরুষের দ্বারা সংস্কৃত হতে স্বস্তি বোধ করেছেন।
সৌদামিনী দেবীর
লেখা থেকে সমকালীন বাঙালি শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন দেখা যায়। কন্যাশিশুর
বিদ্যাচর্চা নিয়ে যে দেবেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন সেই কথা জানান তিনি। তিনি লেখেন যে তাঁর
শৈশবে মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার বিশেষ চল ছিল না। বৈষ্ণব মেয়েরা লেখাপড়া জানত। তাদের
কাছ থেকেই ঠাকুরপরিবারের মেয়েরা অল্পবিস্তর লেখাপড়া শিখত। সৌদামিনী দেবীরও প্রথম শিক্ষা
একজন বৈষ্ণবীর কাছে। শিশুপাঠ পড়া এবং কলাপাতায় চিঠি লেখা থেকে রামায়ণ পড়া পর্যন্ত অগ্রসর
হয়েছিলেন তিনি। দেবেন্দ্রনাথ এইসময় মেয়েদের শিক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন।
কেশব চন্দ্র সেন-এর বাড়িতে যে মিশনারিরা অন্তঃপুরে মেয়েদের পড়াতে আসত তাদেরই নিজের
বাড়ির কন্যাদের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।
সৌদামিনী দেবীর লেখা থেকে জানা যায় একজন বাঙালি খ্রিস্টান শিক্ষয়িত্রী প্রতিদিন পড়াতে
আসতেন আর একজন মেমসাহেব সপ্তাহে একদিন বাইবেল পড়াতে আসতেন। কিন্তু সেই পাঠদান দেবেন্দ্রনাথের
পছন্দ না হওয়াতে তিনি তা বন্ধ করে দেন। ১৮৪৯ সালে স্থাপিত হয় বেথুন স্কুল। বাঙালি সমাজ
মেয়েদের সেখানে পড়তে পাঠাতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল প্রথমদিকে। সেই সময়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিজের কন্যা ও ভ্রাতুষ্পুত্রীকে বেথুন স্কুলে পাঠান। এই সময়ে হরদেব চট্টোপাধ্যায় এবং
মদনমোহন তর্কালঙ্কার তাঁদের মেয়েদেরও পাঠিয়েছিলেন বেথুন স্কুলে, সে কথাও লিখেছেন সৌদামিনী
দেবী তাঁর স্মৃতিকথায়। স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে সৌদামিনী দেবী তাঁর মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ
ঠাকুরের কথা বলেছেন। সৌদামিনী জানিয়েছেন যে, সত্যেন্দ্রনাথ অল্প বয়সেই স্ত্রীস্বাধীনতা
বলে একটি চটি বই লিখেছিলেন। সেই সময়ে বাড়ির মেয়েদের কোথাও যেতে হলে ঢাকাদেওয়া পাল্কিতেই
যেতে হত। মেয়েদের পোশাকও ছিল বাইরের সমাজে বার হবার অনুপযুক্ত। সত্যেন্দ্রনাথ পরিবারে
এই ক্ষেত্রেও পরিবর্তন নিয়ে এলেন। সৌদামিনী দেবী লেখেন, “ আমরা যখন শেমিজ জামা জুতা
মোজা পরিয়া গাড়ি চড়িয়া বাহির হইতে লাগিলাম তখন চারিদিক হইতে যে কিরূপ ধিক্কার উঠিয়াছিল
তাহা এখনকার দিনে কল্পনা করা সহজ নহে।” ছোট মেয়েরা ভাল করে শাড়ি পরে সামলাতে পারে না
বলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়ির দর্জিকে দিয়ে সেই পোশাক পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। মেয়েদের
ছাতে ওঠা নিয়ে জ্ঞাতিভাই অনুযোগ জানাতে এলে দেবেন্দ্রনাথ গ্রাহ্য করেন নি। কন্যারা
সে যুগের নিরিখে বেশি বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকার কারণে আত্মীয়স্বজনের সমালোচনাও কানে
নেন নি দেবেন্দ্রনাথ।
সেই সময়ে সমাজ
ও ধর্মের ক্ষেত্রে বাঙালি জীবনে যে পরিবর্তনগুলি আসছিল তা কিছুটা ধরা পড়ে সৌদামিনী
দেবীর লেখায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন যা তাঁর পরিবারের অনেকে মানতে
পারেন নি। সৌদামিনী দেবী লেখেন, “এক সময় ছিল যখন আমাদের বাড়ি আত্মীয়স্বজনে পূর্ণ ছিল।
অবশেষে একদিন দেখিলাম প্রায় সকল আত্মীয়ই আমাদিগকে একে একে পরিত্যাগ করিয়া গেলেন।” ব্রাহ্মধর্মকে
নিয়ে যে পারিবারিক বিচ্ছেদ ঘটে যায় ঠাকুর পরিবারে তাঁর মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন তিনি
লেখাতে। কেশব চন্দ্র সেন ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার কারণে পরিবারের সঙ্গে তাঁর এবং তাঁর
পত্নীর বিচ্ছেদ ঘটলে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে ওঠেন তাঁদের আশ্রয়।
বাড়িতে নাচ
বা সুরুচিবিরুদ্ধ যাত্রা নিষিদ্ধ থাকলেও বিশুদ্ধ আমোদ-প্রমোদে কোন বাধা ছিল না বলে সৌদামিনী দেবী জানিয়েছেন তাঁর স্মৃতিকথায়। তিনি
লেখেন, “ বাড়ির ছেলেমেয়েরা মিলিয়া আপনা আপনির মধ্যে অভিনয় করিবার উদ্দেশ্যে বাহিরের
বড় ঘরে ষ্টেজ বাঁধিবার জন্য যখন তাঁহার অনুমতি প্রার্থনা করিয়া পত্র লিখিয়া পাঠাইল,
তখন আমাদের মনে আশঙ্কা ছিল, কি জানি পাছে তিনি বিরক্ত হন। তিনি সম্মতি প্রকাশ করিয়া
পত্র লিখিলে পর সকলে নিশ্চিন্ত হইলেন। একবার এইরূপ পারিবারিক অভিনয় দেখিয়া তাঁহার সঙ্গে
যখন দেখা করিতে গেলাম তিনি আমাকে সমস্ত বিবরণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহার একটি নাতবৌ পুরুষ
সাজিয়াছিলেন ও সেই সজ্জায় তাঁহাকে সুন্দর দেখিতে হইয়াছিল শুনিয়া তিনি হাসিতে লাগিলেন।”
সময়কালের পরিবর্তন ধরা পড়েছিল সৌদামিনী দেবীর লেখায় এবং সেই পরিবর্তনের স্রোত প্রবাহিত
হতে দিয়েছিলেন যাঁরা তাদের মধ্যে বাংলায় অগ্রণী ছিল ঠাকুর পরিবার সে বিষয়ে কোন সন্দেহ
নেই।
সৌদামিনী দেবীর
স্মৃতিকথা মূলত তাঁর পিতার সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ। তবে, সেখানে ধরা পড়ে সমসাময়িক সমাজের
নানা বাঁক। স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের যে দরজা খুলছিল তা দেখিয়েছেন সৌদামিনী
দেবী তাঁর স্মৃতিকথায়। সমাজের আরও নানা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এবং ব্রাহ্মসমাজের সূচনার
একটা ছবি পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। তাঁর স্মৃতিকথা তাই হয়ে ওঠে একটা সময়কালের দলিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন