ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৪১)
হর্ষও আর চাপ নিতে পারছিল না। শ্রুতির সঙ্গে কথা হওয়ার পর আবার মনের মধ্যে প্রচুর তোলপাড় হয়েছে। সামলানোর চেষ্টা করেছে, বারবার নিজেকে শান্ত করেছে। মামপির মতো চাপা মেয়ে শেষ পর্যন্ত তার কাছে মন খুলল। তার মানে সমস্যা তার একার নয়। সম্পর্কের অঙ্কে জেনারেশন ওয়াই বা জেড্ মানসিকভাবে বেশ ঘেঁটে, বিভ্রান্ত অনেকে। সঙ্গী খুঁজতে নিজস্ব রুচির প্রাধান্য এবং মা-বাবার পছন্দে ভরসা না থাকায় তারাও দূরত্ব রাখে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ছেলে-মেয়ের পছন্দে সম্মতি দেয়। হর্ষ ভাবে এতে প্রচুর চাপ আসছে নিজের ওপর। লিপিকা-শোভনের মতো বুঝদার মা-বাবা, তা সত্বেও মা-র পছন্দে তার পছন্দ মিলল কোথায়?
ঊর্বীর সঙ্গে দেখা করার
জন্য তৈরি হয়ে চুল সেট করে বেরোচ্ছিল সে, মোটাসোটা জ্যাকেট পরল। খুব ঠাণ্ডা দিল্লীতে
এখন। আগের বছর শীত পড়ার আগে বাবা-মা তার কাছে এসেছিল। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল। এখন
সত্যিই অন্তর থেকে স্থায়ী সম্পর্কের কথা ভাবছে হর্ষ। ‘ভালোবাসা’
শব্দটা আজকাল অজস্রমুখে অজস্র বছরের ব্যবহারে ক্লিশে। ‘আই লভ ইউ’
বলতে বিশেষ পরিবেশ বা ইমোশন প্রয়োজন হয়না। ‘ডেটিং’ বর্তমানে চালু একটি শব্দ, বাংলায়
অনুবাদ করলে হয় ‘সামাজিক সাক্ষাৎকার’। তবে তাতে অর্থ ধরা পড়েনা। শ্রুতির সঙ্গে কথা
হওয়ার পর থেকে পারস্পরিক বোঝাপড়া ধরণের ব্যাপার চলছে ঊর্বীর সঙ্গে। অফিসের অনেকে এখন
ওদের ব্যাপারটা আন্দাজ করে। হর্ষ কাউকে যদিও কিছু বলে নি। কবে একদিন অফিস ক্যান্টিনে
বসে ঊর্বী বলেছিল,
“হর্ষ্-স্যার, যদি পারমিশন দাও, স্যার-টা ঝেড়ে
ফেলি?”
কতবার এভাবে ইঙ্গিত
দিয়েছে ঊর্বী। হর্ষ এড়িয়ে গেছে। সেদিনও খাবার খুঁটছিল, জবাব দেয়নি। ঊর্বীর মধ্যে ছেলেমানুষী
চঞ্চলতা আছে, গভীরতা কম। অদিতির একেবারে উলটো। বয়সে অবশ্য বেশ ছোটো। শাম্ভবী নামের
মেয়েটি ঊর্বীর কাছাকাছি বয়সের হলেও আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব ছিল। অবশ্য গম্ভীর থাকা মানেই
ব্যক্তিত্বের পরিচয় নয়। অন্তরমুখী মানুষেরা আপাতগম্ভীর থাকে। হর্ষ তলিয়ে মন খুঁজেছিল,
ঊর্বীকে আদৌ কোনও জায়গা দিতে পেরেছে কিনা। ঊর্বী অধৈর্য হয়ে উঠছিল,
“উঃ! আমি কিন্তু অলরেডি বাপীকে জানিয়েছি অ্যাবাউট
ইয়ু, দাদাকেও।”
আকণ্ঠ উৎসুক হয়েছিল
ঊর্বী, হর্ষ তখনও নীরব ছিল। অনুভব করছিল এই একবছরে ঘটনা পরিক্রমায় ভেতরে সে এখন অনেক
পরিণত। ঊর্বীর এলোমেলো ভাবটুকুর প্রতি একধরণের মধুর প্রশ্রয় কাজ করছে। তার সরলতার সুযোগ
নিয়ে কিছুদিন নির্দোষ ফ্লার্ট করে বিদায় দেওয়া কঠিন হবে না। চিন্তাটা দুষ্টগ্রহের মতো
ঘুরে গেল মাথায়। সব ঝেড়ে ফেলে বস্-সুলভ গাম্ভীর্যে কাজের কথায় ফিরে গেল হর্ষ। ঊর্বীর
ঝলমলে মুখটা সেদিন নিভে গিয়েছিল। রাতে মেসেজ করেছিল ঊর্বী। ইংরাজিতে দীর্ঘ মেসেজ,
‘ইউ হ্যাভ নট টোল্ড মী এনিথিং অ্যাবাউট ইয়োরসেলফ—! আর ইউ অলরেডি কমিটেড টু সামওয়ান? অর আর ইউ গোয়িং থ্রু দ্য ট্রমা
অব এনি ব্রেক-আপ?’ ইত্যাদি।
সত্যিই তো জানায় নি
হর্ষ, বাবা-মা, বাড়ি কোনও কথাই না। অদিতির বিষয়ে জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। অফিশিয়াল
কথাবার্তার বাড়তি একটাও কথা বলে না। সেদিন লিখেছিল,
“গিভ মী সামটাইম টু থিংক অ্যাবাউট দ্য ম্যাটার,
ইউ টু ডু দ্য সেম। ইউ আর ইয়ং অ্যাণ্ড প্রমিসিং। সো, থিংক আ থাউজ্যাণ্ড টাইমস্।”
ঊর্বী কষ্ট পেয়েছিল কিনা হর্ষ জানে না। অফিসে গিয়ে কাজ ছাড়া অন্য
চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। অথচ ফোঁটাফোঁটা জমছিল অপরাধবোধ—সে যে আগ্রহী নয়, স্পষ্ট করে একথাও বলতে পারেনি। মামপির সঙ্গে মন খুলে
কথা হল যেদিন, সেদিন নিজেকে বুঝল। ক-দিন আগে ঊর্বীকে মেসেজ করে জানিয়েছে,
“ওয়ান্ট টু মীট ইয়ু সামহোয়্যার ইয়ু উইশ টু বী।”
ঊর্বী অপেক্ষা করছিল
রেস্টুরেন্টের গেটে। সামান্য দেরী হয়ে গেছে হর্ষর, এটা বরাবরের দোষ। ঊর্বীর দিকে চোখ
ফেলে হাসির ভাব করল। গোল বেবিফেস, মাথায় সুদৃশ্য বিনি-ক্যাপ আঁট হয়ে বসে আছে। ঝুলছে
রঙিন চুলের রাশ। বড়বড় দু-চোখ কাজলে উজ্জ্বল। পরণে শীতদুরস্ত পোশাক। ধূসর শীত বা একঢাল
গৈরিক গ্রীষ্ম মানুষকে সাজতে উৎসাহী করে, ভাবল হর্ষ। না হলে হয়ত অবসন্নতা ঘিরে ফেলত।
মাঝে-মধ্যে টুকটাক গভীর ভাবনা তাকে ছুঁয়ে যায় ইদানিং। বুকের মধ্যে ছোট্ট খুশী লাফিয়ে
উঠল। ডানহাত বাড়িয়ে দিল ঊর্বীর দিকে, নরম গরম হাতের পাতা মেয়েটার।
দোতলায় একধারে টেবিলে
বসল দুজনে। তাদের মতো অনেকে বসে আছে এদিক-ওদিক। কাচের বাইরে দিয়ে দেখা যায় অনেক দূর।
ফুটি-ফুটি আলোয় সেজে-থাকা প্রিয় মনোরম শহর। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল, মা-বাবা এখানেই ফ্ল্যাট
নিতে পারত। ঊর্বী তার অন্যমনস্ক চোখের সামনে হাত নাড়ল,
“হ্যালোও—!”
“বলো—,”
“ইংলিশ না বেঙ্গলি?”
“তার মানে?”
“মানে দুটোতেই বলতে পারি!”
“গুড! আচ্ছা, তোমার নামের কী মানে?”
“ঊর্বী মানে পৃথিবী। আমার দাদু দিয়েছেন, বাবার বাবা।”
“ও-কে। আমার নামের মানে জানো?”
“অবভিয়াসিলি! হর্ষ মানে আনন্দ। হর্ষবর্ধন রাজা ছিল
না?”
“গুড! তুমি জানো।”
“আমার সেকেণ্ড ল্যাঙ্গুয়েজ বেঙ্গলী ছিল যে!”
হর্ষ চোখ কপালে তুলে
স্যালুটের ভঙ্গী করল। খিলখিল করে হেসে উঠল ঊর্বী, হাসিটুকু স্পর্শ করল হর্ষকে। অনেক
দ্বিধা উড়ে গেল ডানা ঝাপটানো পরিযায়ী পাখিদের মতো। খাবার সামনে নিয়ে কুলকুল নদী হয়ে
উঠল ঊর্বী। বাবা-মা কে কেমন, কে কী করে থেকে আরম্ভ করে ওর ন-বছরের বড় দাদাও সফটওয়্যার
প্রফেশন্যাল, নিউ জার্সির বাসিন্দা। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর ফ্রেঞ্চ লেডির সঙ্গে
লিভ-ইন করছে। ভাভী পঞ্জাবী মেয়ে ছিল, মানিয়ে চলতে পারল না। ওর চারবছরের বড়ো দিদি সেরেব্র্যাল
পলসির পেশেন্ট ছিল। বছরপাঁচেক হল মারা গেছে। বন্ধু, আত্মীয়, তুতো ভাইবোন – ইত্যাদি
প্রায় সকলের কথা বলা হলে বলল,
“বোর করলাম, না? ভেরি স্যরি আসলে ব্যাড হাবিট—!”
হর্ষ তার মাথায় ছোট্ট
একটা চাঁটি মেরে হাসল,
“আমি রিয়েল্লি সারপ্রাইজড্!”
“কেন?”
“এত প্রমিসিং, ব্রিলিয়্যান্ট একটা মেয়ে এরকম কন্টিন্যুয়াস
বকার স্কিলও রাখে! হা-হা-হা!”
“আর তুমি তো কথাই বলো না!”
“নাঃ, এই ফ্লোতে বকে যাওয়ার স্কিল নেই সত্যি। আর
বলার মতোও কিছু থাকতে হবে তো!”
“ধুৎ। জানো, এইজন্য একটা রিলেশনশিপও লং-টার্ম হল
না, ম্যাক্সিমাম ছ-মাস করে।”
হর্ষ শব্দ করে হাসছিল।
ঊর্বী চোখ গোল করে বলল,
“আর ইয়ু নট্ জেলাস? বাট্ বিলীভ মী, কেউ আমাকে
সিরিয়াসলি নিল না কোনওদিন। কেন বলো তো?”
“সো স্যাড! ব্যাড লাক।”
“ইয়াঃ! আই থিঙ্ক ইয়ু হ্যাড রিলেশনশিপ উইথ আ ভেরি
প্রিটি অ্যাণ্ড ইন্ট্রোভার্ট গার্ল, কোনও কারণে ইউ ব্রোক্ আপ!”
“মানে?”
চমকে উঠল হর্ষ, কী বলছে
ঊর্বী? অদিতির কথা সে প্রায় কাউকেই বলেনি। অত লক্ষ করল না ঊর্বী, সামান্য অবরুদ্ধ গলায়
বলল,
“কিন্তু সে সব গল্প আমাকে শুনিয়ো না এখন প্লিজ।
আমি তোমার মতো নই, টু জেনারাস! আমি কেঁদে ফেলব।”
“ধ্যাৎ, কেউ থাকলে তবে না বলবো?”
“শোনো, নেক্সট উইকে আমার বার্থ-ডে, আই উড বী টোয়েন্টি-সিক্স!
ভাবতে পারো? নট্ আ সিঙ্গল ম্যান ওয়েটস ফর মী!”
চোখ কপালে তুলে অদ্ভুত
মুখ করল ঊর্বী,
“বাপী-মা আসছে কলকাতা থেকে। তোমার কথা আমি বলে দিয়েছি।
তুমি আসবে কিন্তু ইভনিং-এ। আমি সেদিন লীভে থাকব।”
“দেখছি, বিজি না থাকলে যাবো সিওর।”
ঝুপ করে আলো নিভে গেল
ঊর্বীর মুখের, দেখল হর্ষ। ওয়েটার আসছিল বিল্ হাতে করে। হর্ষ পকেট থেকে পার্স বের করছিল।
ঊর্বী ওর হাত চেপে ধরল,
“আমি—,”
“সেটা হয় না। আমি তোমাকে ডেকেছি।”
“একে ডেটিং বলে না হর্ষ-স্যার, জাস্ট একটা—ঠিক আছে ওঠা যাক। তুমি বেশ গোঁয়ার আছো কিন্তু, স্টাবর্ন।”
পরের দু-তিনদিন অফিসের
কাজে ভয়ানক ব্যস্ত ছিল হর্ষ। চাপ একটু কমলে লিপিকাকে ফোন করল। লিপিকাও অপেক্ষা করছিল
ছেলের ফোনের। হর্ষ দ্বিধা করল না, ঊর্বীর কথা বিশদে জানাল। লিপিকার গলার স্বর ক্লান্ত,
আগের উচ্ছ্বাস নেই।
“খুশী হলাম বাবুল। ওর ছবি পাঠাস একটা। তোর বাবাকেও
দেখাব।”
“বাবা কী করছে? আঁকছে?”
“ঘুমিয়ে আছে। আজকাল কথা-টথা আরও কম বলে। ক-দিন হল
দুটো ছবি নিয়ে বসে থাকে, হিজিবিজি কাটে আর আপনমনে বলে—শেষ ছবি, শেষ ছবি।”
“এসব কী বলছ মা?”
হর্ষ ভয় পায়। লিপিকা
অতি কষ্টে উঠে-আসা আবেগ রোধ করে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। প্রসঙ্গ ঘোরায়,
“কলকাতার কোথায় বাড়ি ওদের?”
“শিবপুরে। ওর বাবা বি-ই কলেজে পড়াতেন।”
“ভালো। এবার ফাইন্যাল করে ফেল বাবুল। আর দেরী করিস
না। মোবাইলে ওর ছবি পাঠাস, বাবাকে দেখাব।”
“হ্যাঁ, মা পাঠাব।”
ফোন বন্ধ করে নিঃশ্বাস
ফেলে হর্ষ। আর দ্বিধা নেই। খুব ইচ্ছে করছে ড্রিম হোমস থেকে একবার ঘুরে আসতে। পছন্দমতো
উপহার কিনবে ঊর্বীর জন্য। নিজেকে বলে, কিন্তু ওখানেই কেন? তবু, একবার যাওয়া যায়। এতদিন
পর আবার খুব টানছে ব্যুটিকটা।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন