বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১১৯ / একাদশ বর্ষ : নবম সংখ্যা

 




‘কালিমাটি’ পত্রিকা ও ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক-শিল্পী সুবল দত্ত। কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তা ‘কালিমাটি’র সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সবাই জানেন। ‘কালিমাটি’ পত্রিকা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়, আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, জামশেদপুরে, তখন সুবল চাইবাসায় স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ায় কর্মসূত্রে সদ্য যোগদান করেছেন। সেখানেই তিনি তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের সহযোগিতায় একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকার নাম ছিল ‘উইঢিবি’। এছাড়াও চাইবাসা থেকে সেইসময় ‘রোরো’ নামে আর একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। এই দুটি পত্রিকারই আমি পাঠক ছিলাম। তবে আমার কোনো লেখা এই দুটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কিনা, স্মৃতিতে নেই। না লিখলেও, এই সূত্রে আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়েছিল সুবল দত্তর। সেইসময় তাঁর লেখায় লেগে থাকত মানভূমের মাটির গন্ধ। শহুরে গন্ধ থাকত কম। পরবর্তী সময়ে তাঁকে কর্মসূত্রেই চলে যেতে হয় প্রথমে বোকারো এবং পরে ধানবাদ। যেখানেই থেকেছেন, সেখানেই তিনি নিজের মতো করে সাহিত্যের পরিমন্ডল গড়ে তুলেছেন, জড়িয়েছেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে। কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর  গ্রহণের পরে তিনি চলে আসেন জামশেদপুরে এবং এখানেই একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করে স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। আর ঠিক এই সময় থেকেই ‘কালিমাটি’ পত্রিকা ও ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। পত্রিকা ও ব্লগজিনের প্রতিটি সংখ্যায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতো। তিনি মূলত গল্প লিখতেন ‘কালিমাটি’তে। আর লিখতেন ঝুরোগল্প। একেবারে অন্য বিষয়, অন্য ভাবনা, অন্য আঙ্গিক এবং স্বতন্ত্র ভাষা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, অনেকের লেখা প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। তাঁরা সবাই মোটামুটি ভালো লেখেন। কিন্তু সবার লেখায় তাঁদের নিজস্ব কোনো ভাষা বা ডিকশন খুঁজে পাই না। নিজস্ব ভাষারীতি বা নিজস্ব শিল্পরীতির কোনো প্রতিফলন ফুটে ওঠে না। সেই বিচারে সুবল দত্তর যে কোনো লেখায় ছিল তাঁর নিজস্বতা। বিষয় অনুযায়ী তিনি আঙ্গিক ব্যবহার করতেন, এবং আঙ্গিকের অনুসারী ভাষা প্রয়োগ করতেন। শিরোনামে লেখকের নামের দিকে দৃষ্টিপাত না করে কোনো পাঠক যদি লেখার মধ্যে অনুপ্রবেশ করেন, এবং যদি সেই পাঠক সুবল দত্তর অন্য কোনো লেখার নিবিড় পাঠ পূর্বে করে থাকেন, তাহলে তিনি অনায়াসে সনাক্ত করতে পারবেন যে, এই লেখাটিও সুবল দত্তর, অন্য কারও নয়।

সুবল দত্তর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল খুবই সহজ এবং আন্তরিক। বয়সে তিনি আমার অনুজ ছিলেন, তাই দাদা সম্বোধন করতেন। একই শহরে বসবাস, মাঝে মাঝেই চলে আসতেন আমাদের ফ্ল্যাটে। আমরাও যেতাম তাঁদের ফ্ল্যাটে। ঘন্টা দু’তিন নিটোল সাহিত্য-আড্ডা হতো আমাদের। তবে কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর তাঁর শরীর বিশেষ একটা ভালো যাচ্ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হলেন হার্টের গন্ডগোলে। আর্টারিতে ব্লকেজের সমস্যা ছিল। সমস্যার সমাধানে অপারেশন করা হয়েছিল এবং হার্টের গন্ডগোল থেকে তিনি মুক্তও হতে পেরেছিলেন। কিন্তু ঠিক এই সময়েই চিকিৎসকরা আশঙ্কার সঙ্গে ডায়গানোসিস করেন যে, তাঁর শরীরের গভীরে বাসা বেঁধেছে মারণব্যধি। বলা বাহুল্য, এরপর থেকে মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি  সাংঘাতিক যন্ত্রণা সহ্য করে লড়াই চালিয়ে গেছেন ক্যানসারের বিরুদ্ধে। এবং শুধুমাত্র মারণব্যধির বিরুদ্ধে লড়াই নয়, একইসঙ্গে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখে নিরলসভাবে সৃষ্টি করে গেছেন একের পর এক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ। প্রকাশ করেছেন বেশ কয়েকটি বই। ছবি এঁকেছেন অনেক। নবজাত পৌত্রের সান্নিধ্যলাভের জন্য আকাশপথে পাড়ি দিয়েছেন সুদূর আমেরিকায়। একজন মানুষ কতটা প্রাণবন্ত ও সৃষ্টিশীল হলে এভাবে সৃজনানন্দে বিভোর হয়ে থাকতে পারেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। সুবল দত্ত তাঁর জীবনকালে তা করে দেখিয়েছেন। আমাদের সামনে রেখে গেছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। এমন একজন সৎ, সদাশিব, সজ্জন এবং বলিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিরল মানুষকে হারিয়ে আমরা আজ সত্যি সত্যিই খুব একাকী ও অসহায় বোধ করছি।  

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com                

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 


স্লাভো জিজেক

 

ইজরায়েল-প্যালেস্টাইনে প্রকৃত বিভাজন রেখা

(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী)



 

ইজরায়েলের উপর হামাস যে বর্বর আক্রমণের মুখটি খুলে দিয়েছিল তাকে নি:শর্তভাবে এবং কোন 'যদি’ এবং ’কিন্ত’ ছাড়াই সমালোচনা করা উচিত। গণহত্যা, ধর্ষণ এবং ইহুদি গ্রাম এবং কিবোতজিম বা যৌথ খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইজরায়েলের ছোট শহরগুলো থেকে বেসামরিক নর-নারীদের অপহরণ এবং একটি সঙ্গীতানুষ্ঠান যা শেষমেশ একটি সংগঠিত গণহত্যার কেন্দ্রে পর্যবসিত হয় - এসবই নিশ্চিত করে যে হামাসের সত্যিকারের লক্ষ্য ছিল ইজরায়েল রাষ্ট্র এবং সব ইজরায়েলীকে হত্যা করা। সুতরাং বলতেই হবে যে বিদ্যমান পরিস্থিতি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের পর্যালোচনা দাবি করে - কোন ন্যায্যতার দাবি হিসেবে নয়, তবে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে সামনে উত্তরণের জন্য গোটা বিষয়টা সম্পর্কে স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে প্রথম বিবেচনার দিকটি হলো যে নিরঙ্কুশ হতাশা অধিকাংশ ফিলিস্তিনীর জীবনকে অন্যদের জীবন থেকে আলাদা বা স্বতন্ত্র করে। আজ থেকে এক দশক আগে জেরুজালেমের রাস্তায় যে বিচ্ছিন্ন আত্মঘাতী হামলাগুলোর ঢেউ দেখা দিয়েছিল, সেই হামলাগুলোর কথা একবার স্মরণ করুন। একজন সাধারণ ফিলিস্তিনী তেড়ে যাচ্ছে কোন ইহুদির দিকে, ছুরি টেনে বের করে নিরীহ প্রতিপক্ষকে আঘাত করছে যদিও এই ফিলিস্তিনী ভাল করেই জানে যে এই অসহায় প্রতিপক্ষ সাথে সাথে মারা যাবে। এই 'সন্ত্রাসী’ আচরণ বা কাজগুলোর কোন নিহিত বক্তব্য ছিল না, ‘প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করো!’ জাতীয় কোন আর্তনাদও ছিল না। এই বিচ্ছিন্ন ফিলিস্তিনী আক্রমণকারীদের পেছনে কোন বৃহত্তর সংগঠনও ছিল না। এগুলো ছিল ভয়ানক হতাশার চিহ্নবাহী কিছু ব্যক্তিগত আক্রমণ।

বিষয়গুলো আরো মন্দ দিকে বাঁক নিলো যখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু চূড়ান্ত ডানপন্থী এবং ইহুদি অভিবাসী  বা সেটেলার সমর্থক দলগুলোর সাথে একটি নতুন সরকার গঠন করলেন যারা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনী এলাকাসমূহকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্তিকরণের পক্ষেও প্রচার চালায়। জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নতুন মন্ত্রী ইতামার বেন-গ্ভির মনে করেন যে, ‘পশ্চিম তীরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াতে পারা আমার অধিকার,  আমার স্ত্রীর অধিকার, আমার সন্তানদের অধিকার এবং সেটা আরবদের অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ’। এই ব্যক্তি আরব-বিরোধী চরমপন্থী দলগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য অতীতে সেনাবাহিনীতে কাজ করা চালিয়ে যেতে বাধা পেয়েছিল যেহেতু ইহুদিবাদী ঐ চরমপন্থী সংগঠনগুলো ১৯৯৪ সালে হেবরনে আরব গণহত্যার জন্য দায়ি ছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করা ইজরায়েল নেতানিয়াহুর বিদ্যমান সরকারের অধীনে ইজরায়েল একটি ধর্মবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ‘মূল নীতিমালা’-র তালিকা পরিষ্কারভাবেই বলছে: ‘ইজরায়েলের সব অংশের ভূমির উপর ইহুদি জনগণের  রয়েছে চূড়ান্ত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। গালিলি, নেগেভ, গোলান, জুদিয়া ও সামারিয়া সহ সরকার  ইজরায়েলের সব অংশে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের অবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টা চালাবে।’

ইজরায়েল সরকারের এমন সব প্রতিশ্রুতির মুখে ইজরায়েলের সাথে আলাপ-আলোচনায় আসতে না চাইবার  জন্য ফিলিস্তিনীদের নিন্দা-মন্দ করাটা বেশ অযৌক্তিকই মনে হয়। ইজরায়েলের বর্তমান সরকারের দাপ্তরিক কর্মসূচীই আলোচনাকে টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়েছে।

কিছু ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা অবশ্য জোর দিয়ে বলেই যাবেন যে নেতানিয়াহু সরকার নিশ্চিত জানতেন যে সামনে  কিছু আক্রমণ ইজরায়েলের উপর আসতে যাচ্ছে যেহেতু গাজায় ইজরায়েলী প্রহরা এবং গোয়েন্দা গতিবিধি সংক্রান্ত সক্ষমতার শক্তি যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। কিন্ত যখন (হামাসের) এমন আক্রমণ ক্ষমতায় থাকা ইজরায়েলী চরমপন্থীদের স্বার্থকেই রক্ষা করে, তখন নেতানিয়াহুর ’মিস্টার নিরাপত্তা’ হবার দাবির প্রতি সন্দেহ ছুঁড়ে দেয়।

সত্যি বলতে দু’দিকেরই - হামাস এবং ইজরায়েলের অতি-জাতীয়তাবাদী সরকার - এই দুই পক্ষের অবস্থানই যে কোন বিবেচনায় যে কোন রকমের শান্তির বিকল্প পথ খুঁজে নেবার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান। দু’পক্ষই যেন মৃত্যুর পক্ষেই সংগ্রামে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। হামাসের এই আক্রমণ ইজরায়েলের নিজের ভেতরেই এক বড়  সঙ্ঘর্ষের সময় আছড়ে পড়েছে যখন নেতানিয়াহু সরকার ইজরায়েলের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকে সীমিত করার প্রয়াস চালাচ্ছিল। গোটা ইজরায়েল তাই একদিকে জাতীয়তাবাদী মৌলবাদী যারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করতে চায় এবং একটি সুশীল সমাজ আন্দোলনের ভেতর বিভক্ত যারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধ্বংসের বিপদটি বুঝতে পারলেও অধিকতর মধ্যপন্থী ফিলিস্তিনীদের সাথে মৈত্রী গড়তে অনিচ্ছুক।

ইজরায়েলে এখন ঘনিয়ে আসা সাংবিধানিক সঙ্কট আপাতত: স্থগিত রাখা হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্যের একটি সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। এ সেই পুরনো গল্পই: বাহ্যিকভাবেই দেখা যাচ্ছে এবং গভীর, অন্তর্গত  বিভাজন সহসা এক বহি:স্থ বৈরীর কারণে কেটে গেল - যে বৈরী উভয়ের কাছেই বৈরী।  কিন্ত ঘরের ভেতরে শান্তি এবং একতা বজায় রাখার জন্য একজন বহি:স্থ বৈরী তবে থাকা একান্ত দরকার? কীভাবে এই দুষ্ট চক্র ভাঙ্গা সম্ভব?

প্রাক্তন ইজরায়েলী প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট অবশ্য মনে করছেণ যে, সামনে এগিয়ে যাবার রাস্তা হলো হামাসের সাথে লড়াইয়ের পাশাপাশি ইহুদি-বিদ্বেষী নয় এমন ফিলিস্তিনীদের কাছে পৌঁছানো এবং পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার জন্য প্রস্তÍত থাকা। ইজরায়েলী উগ্র-জাতীয়তাবাদীরা যেমনটা দাবি করে যে কোন ’শান্তিবাদী ফিলিস্তিনী’ নেই, সেটা সত্য নয়। বরং এই দাবির উল্টোটাই - শান্তিবাদী ফিলিস্তিনীরাও রয়েছেন। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে শতাধিক ফিলিস্তিনী শিক্ষাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী একটি খোলা চিঠিতে ’মানবতার বিরুদ্ধে নাজি অপরাধকে যে কোনভাবে লঘু করে দেখা, এর যে কোন রকম ভুল ব্যাখ্যা অথবা  ইহুদি-বিদ্বেষের বৈধতাদান অথবা নাজি বাহিনী কর্তৃক ইহুদি গণহত্যার বিরুদ্ধে কোন ঐতিহাসিক সংশোধনবাদের প্রচেষ্টাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা-র ডাক দিয়েছেন।’

একবার যদি শুধু আমরা স্বীকার করে নিই যে, সব ইজরায়েলী উগ্র জাতীয়তাবাদী নন এবং সব ফিলিস্তিনীই  উগ্র ইহুদি-বিদ্বেষী নন, শুধুমাত্র তখনি আমরা চারপাশের হতাশা ও সংশয়কে মেনে নিতে শুরু করতে পারব যা অশুভের বিষ্ফোরণ ঘটায়। শুধু মাত্র তখনি আমরা ফিলিস্তিনী এবং ইহুদিদের ভেতর কিছু আশ্চর্য মিলও দেখতে পাব - ফিলিস্তিনীদের কাছে আজ তাদের নিজেদের জন্মভূমিই অস্বীকৃত আর ইহুদিদের ইতিহাসও একই রকম দূর্ভাগ্যের অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন।

'সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির ক্ষেত্রেও একইরকম সাদৃশ্য। ফিলিস্তিনে বৃটিশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইহুদি সংগ্রামের সময়ে ’সন্ত্রাসবাদী’ শব্দটির একটি ইতিবাচক অর্থ ছিল। ১৯৪০ সালে মার্কিনী সংবাদপত্রগুলোয় ’ফিলিস্তিনের সন্ত্রাসবাদীদের কাছে চিঠি’ শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হতো যেখানে হলিউডের চিত্রনাট্যকার বেন হেশট লিখতেন, ‘আমার সাহসী বন্ধুরা - আমি তোমাদের উদ্দেশ্যে যা লিখছি তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না যেহেতু বাতাসে এই মূহূর্তে রয়েছে প্রচুর সার। তবে আমেরিকার ইহুদিরা তোমাদের পক্ষে রয়েছে।’

আজ যখন কে সন্ত্রাসী বা কী কী কাজ করলে কেউ সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচিত হবেন ইত্যাদি নিয়ে নানা তর্কের স্তÍপ জমে উঠেছে, সেই যাবতীয় তর্কের নিচে রয়ে গেছে অসংখ্য ফিলিস্তিনী আরব যারা দশকের পর দশক এক কারাগার রাষ্ট্রে বসবাস করছেন। তারা কারা এবং এই  মৃত্তিকা কাদের? তারা কি ’অধিকৃত এলাকার’বাসিন্দা, ‘পশ্চিম তীরের’ মানুষ, ‘জুদিয়া এবং সামারিয়া’-র অধিবাসী অথবা ১৩৯টি রাষ্ট্র কর্তৃক  স্বীকৃত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এবং ২০১২ সাল থেকে যে রাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে একটি অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে? তবু ইজরায়েল যারা বাস্তবে এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, ফিলিস্তিনীদের সাময়িক বসতি স্থাপনকারী হিসেবে দেখছে, একমাত্র খাঁটি আদি বাসিন্দা হিসেবে ইহুদিদের একটি ’স্বাভাবিক’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা বা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছে। রাষ্ট্র হিসেবে ইজরায়েল কখনোই তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি, কোন আশা দেখায়নি অথবা রাষ্ট্রে তাদের ভূমিকার কোন সদর্থক রূপরেখা আঁকেনি।

সত্যি বলতে হামাস এবং ইজরায়েলী চরমপন্থীরা একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। আমাদের তাই দুই চরমপন্থার কোনটিকে বেছে নেব সেই ভাবনার বদলে উভয়পক্ষের মৌলবাদী এবং উভয়পক্ষের ভেতরেই তুলনামূলক যুক্তিবাদী যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন, তাদের ভেতর একটি পক্ষকে বেছে নিতে হবে। ফিলিস্তিনী এবং ইজরায়েলী চরমপন্থীদের সাথে কোন সমঝোতাই হতে পারে না এবং এই উগ্রবাদীদের সাথে লড়তে হবে একই সাথে ফিলিস্তিনী নিরাপত্তার অধিকারের পক্ষে মুক্ত কণ্ঠ  দাবি তোলার সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ইহুদি-বিদ্বেষের বিরুদ্ধেও অটুট ও অবিচল লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।

একথা শোনাতে যতই অলীক বা অবাস্তব শোনাক, এই উভয় সংগ্রামই মূলত: একটি সমগ্রেরই অংশ। সন্ত্রাসবাদী সব আক্রমণের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে আমাদের নি:শর্ত সমর্থন যোগানো উচিত। একইসাথে গাজা ও অধিকৃত ভূ-খন্ডে সত্যিকারের নি:সহায় ও হতাশ যে অবস্থার মুখোমুখি অসংখ্য  ফিলিস্তিনী বাস করছেন, তাদের প্রতিও নি:শর্তভাবে সহানুভূতিশীল হতে হবে। যারা মনে করেন যে এই  অবস্থানের ভেতর ‘বৈপরীত্য’ রয়েছে তারাই মূলত: আজ ফিলিস্তিনী ও ইহুদিদের ভেতর একটি সমাধানের রাস্তা কার্যকরী ভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।

(স্লাভো জিজেক, ইউরোপীয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলে দর্শনের অধ্যাপক, ’হ্যাভেন ইন ডিসঅর্ডার’গ্রন্থের লেখক। এই লেখাটি এবছরের ১৩ই

 অক্টোবর ’প্রজেক্ট সিন্ডিকেট’ কর্তৃক প্রথম মুদ্রিত হয়।) 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ৩৫




এই পর্বে আমরা ফিরে দেখব হলিউডের বিখ্যাত পরিচালকদের। শুরুর আগে এক ছোট টিপ্পনী। চলচ্চিত্রের স্বর্গরাজ্য বলতে গোটা পৃথিবীতে আমরা হলিউডকেই বুঝি। কিন্তু এই জায়গা এল কিভাবে? লস এঞ্জেলস শহরের খুব কাছে এইচ জে হুইটলি ৪৮০ একর জায়গা কিনেছিলেন। পরে উইলকক্স নামক এক ব্যক্তি ১৮৮৭ সালে  আরো ১২০ একর জায়গা কেনেন। তার স্ত্রী সেই জায়গার নাম রাখেন হলিউড, কারণ ‘হোলি’ শব্দের অর্থ পবিত্র। ১৯০৩ সালে এই গোটা জায়গাটা পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়। ১৯১০ সালে  জায়গাটা লস এঞ্জেলসের সাথে একত্রিত হয়। একে একে ছায়াছবির কোম্পানিগুলো আসতে থাকে, পরিচালকরা আসতে থাকেন, নিউ জার্সি ছেড়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হলিউডে পাড়ি দিতে শুরু করে। ১৯১০ সালে ডি ডব্লু গ্রিফিথ প্রথম ১৭ মিনিটের এক শর্ট ফিল্ম বানান ‘ইন ওল্ড ক্যালিফোর্নিয়া’। শুরু হয় হলিউডের জয়যাত্রা। একদম শুরুর দিকে অনেক বাধা বিপত্তি কাটিয়ে ১৯২৭-২৮ সাল নাগাদ হলিউডে স্বর্ণযুগ শুরু হয়। আমরা আজ যে যে পরিচালকদের বেছে নেব, তারা কিন্তু সবাই স্বর্ণযুগ বা তার পরবর্তী কালের। স্বর্ণযুগের আগেকার নির্বাক চলচ্চিত্র জমানার কাউকে আমি এখানে বাছিনি। এবং এটাও ঠিক, আজ যাদের নাম এই লিস্টে রেখেছি, তাদের সবার ছবি আমি এই ধারাবাহিকের আগের কোন পর্বে উল্লেখ করেছি বা আলোচনা করেছি। আমাদের বাছাই নবীনে-প্রবীনে হলিউডের সেরা দশ - ১) ভিক্টর ফ্লেমিং ২) বাস্টার কিটোন ৩) ফ্রাঙ্ক কাপরা ৪) আলফ্রেড হিচকক ৫) অরসন ওয়েলেস ৬) ফ্রান্সিস ফোর্ড কোপালা ৭) মার্টিন স্করসেসি ৮) স্টিভেন স্পিলবার্গ ৯) কোয়েন্টিন টারান্টিনো ও ১০) ক্রিস্টোফার নোলান। প্রথম পাঁচজন স্বর্ণযুগের এবং পরের পাঁচজন স্বর্ণযুগ পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভ করা পরিচালক।

এই পর্বে শুধু প্রথম পাঁচজন, হলিউডের স্বর্ণযুগের পরিচালকদের নিয়ে। স্মৃতি ক্ষুরধার পাঠককে মনে করানো  যেতে পারে যে, এই ধারাবাহিকের বিস্মৃতপ্রায় ৪ নম্বর পর্বে আমরা আজকের পর্বের বাস্টার কিটোন বাদে  বাকি চারজনের ছবি নিয়েই কিন্তু আলোচনা করেছিলাম।

ভিক্টর ফ্লেমিং (১৮৮৯-১৯৪৯) শুরু করেছিলেন একজন স্টান্টম্যান হিসেবে। পরিচালক হিসেবে ওনার প্রথম হিট ছবি ‘দ্য ভার্জিনিয়ান’ (১৯২৯) গ্যারি কুপারকে স্টার বানিয়েছিল। কিন্তু সাধারণ যে কোন সিনেমাপ্রেমী  মানুষের কাছে ভিক্টর ফ্লেমিং বললেই চার ঘন্টার মহাকাব্য ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) এবং পাশাপাশি ‘উইজার্ড অব অজ’ (১৯৩৯)। গন উইথ দ্য উইন্ড সেই প্রথম ছবি যা একাধারে দশটা অস্কার পেয়েছিল। কেন? আলোর খেলা, রঙের সাবলীল ব্যবহার, আউটডোর সিন, অনবদ্য অভিনয়, লং শট, এরকম বেশ কিছু ব্যাপার। আরো বড় কথা, এই ছবি সিনেমার ইতিহাসে সাদা কালো ছবির ভীড়ে প্রথমদিকের কয়েকটা রঙিন ছবির ভেতর একটা। আরেকটু এগোই, এই ছবি সেই প্রথম ছবি যা রঙের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দর্শকের মুড ভাল করার জন্য অনারারি অস্কার পেয়েছিল। সঙ্গে অনবদ্য কস্টিউম ডিজাইন যার জন্য আর্ট ডিরেকশনেও অস্কার। আবার উল্টোদিকে উইজার্ড অব অজ। শুধুমাত্র রঙের খেলা আর সঙ্গীত দিয়েই যে বাচ্চাদের মন জয় করা যায়, এই ছবি তার নিদর্শন। সঙ্গীতের জন্য দুটো অস্কার। আর শিশুশিল্পী জুডি গারল্যান্ডের জন্য বিশেষ অস্কার। অবশ্য এখানে জানিয়ে রাখি, ফ্লেমিং খুব কড়া মেজাজের পরিচালক ছিলেন। প্রতিটি সিনের খুঁটিনাটি নিজেই খুঁটিয়ে দেখতেন। কাউকে ফাঁকি দিতে দেখলে অসম্ভব রেগে যেতেন। জুডির অমনোযোগ দেখে ঠাসিয়ে এক থাপ্পড় মেরেছিলেন – ব্যস্‌, কাজ হয়ে গেছিল। সেই যে জুডি সিরিয়াস হয়ে গেলেন, অভিনয়কেই পরবর্তীকালে পেশা করে নিয়েছিলেন। ফ্লেমিংয়ের শেষ ছবি জোয়ান অব আর্ক (১৯৪৮)। সাফল্য পায়নি। যদিও উনিই একমাত্র হলিউডি পরিচালক যার ১৯৩৯-এর দুটো সিনেমাই সেরা ১০০-য় স্থান পেয়েছে।

বাস্টার কিটোন (১৮৯৫-১৯৬৬)–কে নিয়ে আমি আজ অব্ধি কোথাও কিছু লিখিনি। আসলে স্ল্যাপস্টিক কমেডি বললেই আপামর ছবিদর্শকের কাছে চার্লি চ্যাপলিনের নাম ভেসে ওঠে। আমিও এই লেখার ৪ নম্বর পর্বে আর চারজন পরিচালকের সঙ্গে চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস্‌’ নিয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু এটা মানতেই হয় যে কিটোন চ্যাপলিনের থেকে কোথাও একটু হলেও বেশি ফিল্ম বোদ্ধা ছিলেন যার নিদর্শন থেকে যেত তার ভাবলেশহীন চুপচাপ মুখে, যখন পর্দার সিনে হাসির তুফান উঠত। ফলে দর্শকরা আরো মজা পেত। এজন্য তার ডাকনাম ছিল দ্য গ্রেট স্টোন ফেস। হ্যাঁ, আমাদের আজকের আলোচ্য পরিচালকদের ভেতর একমাত্র কিটোনকেই সঠিক অর্থে বলা যায় স্বর্ণযুগ পূর্ববর্তী, কারণ তার খ্যাতির প্রায় পুরোটাই স্বর্ণযুগের আগে।  ১৯২০ থেকে ১৯২৯ অব্ধি যত সাইলেন্ট ছবি, ওয়ান উইক (১৯২০), দ্য প্লে-হাউজ (১৯২১), কপ্‌স (১৯২২), ইলেকট্রিক হাউজ (১৯২২), শার্লক জুনিয়র (১৯২৪), দ্য জেনেরাল (১৯২৬), স্টিমবোট বিল জুনিয়র (১৯২৮), দ্য ক্যামেরাম্যান (১৯২৮), স্পাইট ম্যারেজ (১৯২৯), সমস্ত একে একে হিট। নির্বাক কিন্তু ননসেন্স নয়। হাসির কিন্তু দার্শনিক। পরবর্তীকালে উনি আরো ছবিতে অভিনয় করেছেন, কিন্তু সেসব ছবি এগুলোর পাশে ঠিক পাতে দেবার যোগ্য নয়। দ্য জেনেরাল দেখে শুধু যে আমি বিভোর হয়েছি, তা নয়, গোটা পৃথিবী মুগ্ধ হয়েছে। এই ছবি নিয়ে অরসন ওয়েলেস বলেই দিয়েছেন – ‘the greatest comedy ever made…and perhaps the greatest film ever made’। আসলে আমার মনে হয়েছে ওনার ছবিগুলোতে কোথাও যেন অঙ্ক লুকিয়ে আছে, প্রতি সিনে, প্রতি আপেক্ষিক ফ্রেমে, ওনার মুখে, ওনার চলাফেরায়। ডেভিড থমসন পুরো ব্যাপারটার ক্রাক্স যেন কয়েক লাইনে বলে দিয়েছেন – ‘Buster plainly is a man inclined towards a belief in nothing but mathematics and absurdity…like a number that has always been searching for the right equation’। কি হল পাঠক, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ মনে পড়ে যাচ্ছে? মিল পাচ্ছেন? ভুলে যাবেন না, এ বছর কিন্তু আবোল তাবোলের ১০০ বছর পূর্তি হল।

ফ্রাঙ্ক কাপরা (১৮৯৭-১৯৯১) যে যে সিনেমার জন্য আজো একদম ওপরের দিকে, সেগুলোর কয়েকটা হলঃ ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট (১৯৩৪), মিস্টার ডিডস্‌ গোজ টু টাউন (১৯৩৬), ইউ কান্ট টেক ইট উইথ ইউ (১৯৩৮), মিস্টার স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন (১৯৩৯), ইট’স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ (১৯৪৬)। উনি সেই পরিচালক যার তৈরি ছবি (ইট হ্যাপেন্ড ওয়ান নাইট) হলিউডের প্রথম ছবি হিসেবে পাঁচটা সেরা অস্কার (বিগ ফাইভ) পেয়েছিল – সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা স্ক্রিপ্ট, সেরা নায়ক ও সেরা নায়িকা। আবার ‘ইট’স আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও, অনেক পরে, ১৯৯৮ সালে, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট এই ছবিকে শেষ ১০০ বছরের সেরা ১০০ ছবির তালিকায় স্থান দেয় এবং ২০০৭ সালে এই সিনেমাকে আমেরিকার সর্বকালের সেরা অনুপ্রেরণা দায়ক ছবি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। ওনার ছবির কিছু বিশেষ দিক বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয়, ওনার ক্যামেরা ছিল শুরুর দিকের ক্যামেরা যেখানে একদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং আরেকদিকে গ্রাম্য আমেরিকা ফুটে উঠেছিল। ক্লোজ শটে স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স কিভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, সেটাও উনি পৃথিবীকে শিখিয়েছিলেন। এবং এটাও দেখিয়েছিলেন, পরিচালক কিভাবে অভিনেতাদের সেরাটা বের করে আনতে পারেন। বারবার শট পরিবর্তন করতেন, শুধু মাত্র একটা মাস্টার স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে সেটে চলে আসতেন, কিন্তু পরিচালনা করার সময় প্রতি সিনে ডুবে যেতেন। টেকনিকাল গিমিক পছন্দ করতেন না। ওনার নিজের ভাষায় – ‘what you need is what the scene is about, who does what to whom, and who cares about whom…all I want is a master scene and I’ll take care of the rest – how to shoot it, how to keep the machinery out of the way, and how to focus attention on the actors at all the time’। ক্লাসিকাল বিশুদ্ধতা তকমা যদি কোন পরিচালকের পিঠে সেঁটে দেওয়া যায়, তাহলে তিনি অবশ্যই কাপরা। দেখুন, উনি কিন্তু একমাত্র পরিচালক যাকে নিয়ে আমি ৩ এবং ৪, দু’পর্বেই আলোচনা করেছি।

আলফ্রেড হিচকক (১৮৯৯-১৯৮০) সিনেমাটিক স্টাইলে এদের থেকে অনেকটাই যেন দূরের মানুষ। আজো, এই এত বহু বছর পরেও, তাকেই মাস্টার অব সাসপেন্স বলা যায়, অন্য কাউকে নয়। উনি ব্রিটেন ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে হলিউড আসার পর রেবেকা (১৯৪০) প্রথম ছবি, তারপর একে একে লাইফবোট (১৯৪৪), স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫), নটোরিয়াস (১৯৪৬), রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪), ভার্টিগো (১৯৫৮), নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট (১৯৫৯), সাইকো (১৯৬০), দ্য বার্ড (১৯৬৩)। বলতেই হয়, আজো যে সব হবু পরিচালকরা সিনেমা শিখতে শুরু করেছে, তারা সাসপেন্স থ্রিলার বলতে হিচককের ছবি বোঝে। হিচককের রেবেকা নিয়ে, সেই সূত্র ধরে ওনার ক্যামেরা নিয়ে, আমি বেশ কিছু তথ্য ৪ নম্বর পর্বে লিখেছিলাম। সেগুলো আজ আর রিপিট করব না। উৎসাহী পাঠক, ওগুলো নিজগুণে ঘেঁটেঘুঁটে একটু পড়ে নেবেন। আমি আজ শুধু এটুকুই বলব, হিচককের  ক্যামেরা মানেই চলাফেরা, এডিটিং, কিন্তু এমনভাবে যেন ছবি দেখার সময় মনে হয়, ক্যামেরা নয়, মানুষের চোখ। যেমন ধরা যাক, বিয়ে এবং বিয়ে সংক্রান্ত থিম। সেটা bleak and skeptical হিসেবে দেখানোর বাহাদুরি ওখানেই। আবার এটাও ঠিক, বিতর্ক যেন হিচককের সঙ্গী। যখন যা ইচ্ছে বলেছেন, যেটা ইচ্ছে হয়েছে সেইসব সিন কেটেছেন বা জুড়েছেন। যেমন একবার বলেছিলেন – ‘actors should be treated like cattle’। পরে অবশ্য শুধরে নিয়েছিলেন। যাইহোক, হিচককের সঙ্গে একটা মোটা নোটবই থাকত, যেটা থেকে উনি যে কোন সিনের ডিটেলস জুড়তেন, কাটতেন, এবং সে বই নিয়ে চুপচাপ বারান্দায় বসে ভাবতেন, যেদিন সিনেমা রিলিজ হবে, সেদিন দৃশ্যটা কি রকম হবে?

অরসন ওয়েলেস (১৯১৫-১৯৮৫) হলিউডের সেই পরিচালক যাকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে এটাই প্রথমে মাথায় আসবে – ‘I don’t think any word can explain a man’s life’। দুর্দান্ত। ব্রিটেন থেকে কম বয়সে আমন্ত্রিত হয়ে হলিউড চলে এসেছিলেন। শুরু করলেন সিটিজেন কেন (১৯৪১) দিয়ে। তারপর দ্য ম্যাগনিফিশিয়েন্ট অ্যাম্বারসন (১৯৪২), দ্য স্ট্রেঞ্জার (১৯৪৬), লেডি ফ্রম সাংহাই (১৯৪৭), টাচ অব এভিল (১৯৫৮), দ্য ট্রায়াল (১৯৬২), চাইমস অ্যাট মিডনাইট (১৯৬৬), এফ ফর ফেক (১৯৭৩)। মাঝে অবশ্য কিছু বছর আবার ইউরোপ চলে গেছিলেন। ওয়েলেসের ক্যামেরা মানেই নন লিনিয়ার বর্ণনা, অদ্ভুত লাইট, বেয়াড়া রকমের ক্যামেরা অ্যাঙ্গল, অফবিট ক্যামেরার জায়গা, লং , মন্তাজ এবং অবশ্যই ডিপ ফোকাস। এগুলো কি, সেটা কিন্তু ৪ নম্বর পর্বে বিশদে বলেছিলাম, সিটিজেন কেন সিনেমার প্রেক্ষিতে। এবং এটা বলাই যায় যে শুধুমাত্র এই ছবির জন্য ওয়েলেসের এত খ্যাতি, শুধু এই সিনেমাই ওনাকে পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসে অমর করে দিয়েছে। মননশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত সিনেমা বলতে কি বোঝায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরন এই ছবি। ২০০২ সালে দুবার দুটো ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এক সমীক্ষায় ওনাকেই ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ পরিচালক তকমা দিয়েছিল। বিখ্যাত গার্জিয়ান পত্রিকা একবার ওনাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল –‘Why Orson Welles lived a life like no other’? ভাবুন, এক অগোছালো মানুষ, থিয়েটারের মঞ্চ থেকে এসে জীবনের প্রথম ছবিটাই গ্রেটেস্ট বানিয়ে ফেলেছেন – পরিচালক প্রযোজক লেখক ও অভিনেতা হিসেবে, বাকী জীবন সেই চাপ নিয়ে আরো ছবি বানাতে হবে, লিখতে হবে, একটা মিথ নিজের ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াতে হবে। এবং ক্রাইম থ্রিলার বানাতে গিয়ে উনি আস্তে আস্তে হলিউডের স্টুডিওগুলো থেকে বহিরাগত হয়ে গেলেন। কি অদ্ভুত নিষ্ক্রমন, তাই না?

আগামী কিস্তিতে হলিউডের আরো পাঁচজনকে নিয়ে আলোচনা চলবে, যার মধ্যে এই সময়ের দুজনকে নিয়েও।

(ক্রমশ)

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – প্রাক-ইতিহাস থেকে (১ম পর্ব)






আমার ইংরেজী ছবি দেখার প্রাক্-ইতিহাস

 

মা’র লেখা স্মৃতিচারণে দেখছি যে আমায় প্রথম সিনেমা হলে নিয়ে যাওয়া হয় ৩১শে মার্চ ১৯৫৯-এঃ অর্থাৎ তখনো আমার দু’ বছর বয়স পূর্ণ হয়নি। বিরতি অবধি নাকি বেশ খুশীই ছিলাম। বিরতির পর মূল ছবি, ১৯৫৮ সালের Tom Thumb, অভিনয়ে পীটার সেলার্স ও টেরি টমাস-এর দুটি দৃশ্য দেখার পর বাবা আমার অধৈর্য দেখে আমাকে বাইরে ‘লবি’তে এনে বসেন। পরে কাজের লোকের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহ ধর্মতলা-চৌরঙ্গী অঞ্চলের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক মেট্রো!

৩১শে জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ১৯৫৫ সালের Lord of the Jungle দেখতে। জনি ওয়াইসমুলারের টার্জান ছবিগুলিতে টার্জানের পালিত পুত্র ‘বয়’ করে বিখ্যাত জনি শেফিল্ড ‘বোম্বা’ নামে এক জংলী ছেলে সেজে যে ‘সিরিজে’ অভিনয় করেছিল, এটি সেই সিরিজেরই একটি। আবার, বিরতি অবধি দেখে আইসক্রীম খাবার বায়না জুড়েছিলাম। প্রেক্ষাগৃহের নামোল্লেখ মা করেননি। জানি না, এই ছবি দেখার সময়েই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম কিনা, “ঐ দেখ, দাদা, ‘নদীজলে ভেসে চলে হিপোপটেমাস’!” এই কীর্তিটিও মা’র মুখে শোনা! চোখের সামনে দিয়ে পর্দায় একটা বড় কুকুরকে চলে যেতে দেখেছিলাম, বাবা বলেছিলেন, “ঐ দেখো, কুকুর নিয়ে গেল!” ভেবেছিলাম কুকুরটি কি যকের ধন-এর বাঘা? বাঘা কিন্তু বিদেশী কুকুর নয়, দেশী, তা’ খেয়াল ছিল না। আর দৃশ্যটিও যে এই ছবিরই, তা’ও জোর গলায় বলতে পারব না!

৬ই ডিসেম্বর ১৯৬০-এ বাবা স্মৃতিচারণের খাতায় লিখছেন যে লাইটহাউস সিনেমায় আমায় ওজন করে দেখা গেছে যে আমি ৩৩ পাউন্ড। ছবির নামের উল্লেখ নেই। হতে পারে ছবি ছিল জুল ভের্নের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৯ সালের Journey to the Center of the Earth, অভিনয়ে জেমস মেসন ও গায়ক প্যাট বুন।

Tom Thumb বা Journey to the Center of the Earth-এর বিন্দুমাত্র কিছু আমার মনের পর্দায় ফুটে ওঠে না।

 

প্রাক্-ইতিহাস থেকে ইতিহাসের প্রথম পর্ব


১৯৬৩-র জানুয়ারিতে আমি কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত সেন্ট লরেন্স স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়তে শুরু করি। স্কুলে প্রতি বছর জুলাই মাসে স্কুলেরই বাসে চাপিয়ে পার্ক স্ট্রীটের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ৩৫ মিমি পর্দা-সম্বলিত প্রেক্ষাগৃহে নিয়ে যাওয়া হতো ‘রেক্টর দিবস’ উপলক্ষে ছবি দেখাতে। ১৮ই জুলাই ১৯৬৩-তে এখানে দেখলাম ইংরেজীতে ‘ডাব’ করা ১৯৫৯ সালের জাপানী ছবি,  Magic Boy। কিছু দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ একটি মেয়েকে দুর্বৃত্তরা দু’-হাতে দড়ি বেঁধে খাদের ধার থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে, কাহিনীর নায়ক সারুতোবি সেসুকে তাকে রক্ষা করবে। সেসুকের প্রতিপক্ষ এক প্রবল ক্ষমতাশালী দানবী ইয়াকুসা। এটি নাকি মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে আমেরিকায় মুক্তি পাওয়া প্রথম ‘অ্যানিমে’ ছবি। [1]

এইরকম সময়েই আরও কিছু বিদেশী ছবির কথা মনে পড়ে। মেট্রোয় রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় বাড়তি একটি শো হতো (সোম থেকে শনি সমস্ত হলেই ৩টি করে প্রদর্শনী চালু ছিলঃ ম্যাটিনি, ইভনিং, ও রাত – ৩টে, ৬টা, ও ৯টার আশে-পাশে। দুপুরের শো কলকাতায় এসেছে বোধহয় ৭০-এর দশকে) । এই সকালে মাঝে-মধ্যেই আসত স্বল্প-দৈর্ঘের একাধিক কার্টুনের সঙ্কলন। প্রথমে দেখেছি Tom and Jerry, তারপর Woody Woodpecker।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার জন্য ১৯৫৯ থেকেই আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে। এখান থেকে সবচেয়ে কাছে ছিল ভবানীপুর-কালিঘাট। আর সেখানকার বাংলা ছবির পাড়ায় রবিবার সকালে দেখানো হতো, পূর্ণ আর বসুশ্রীতে, ইংরেজী ছবি, ঊজ্জ্বলায় সাধারণত দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। ব্যতিক্রম-হিসেবে ঊজ্জ্বলা এক রবিবার আনে আমার দেখা প্রথম Western: ১৯৫৮ সালের The Lone Ranger and the Lost City of Gold । ‘লোন রেঞ্জার’-এর কমিক্স বাড়িতে প্রচুর ছিল, দাদা সেগুলোর থেকে ছবি দেখিয়ে আমায় গল্প বলতেন। তিনিই ছবিটি দেখতে আমায় নিয়ে যান, আমার বয়স তখন ৫ বা ৬। মনে আছে পর্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লোন রেঞ্জারের সাদা ঘোড়া ‘সিলভার’ আর নেপথ্যে দরাজ গলায় গান হচ্ছে, “Hi yo Silver Away!” তারপর লোন রেঞ্জার সিলভারের পিঠে চেপে ধাওয়া করেছে আততায়ীদের, বার করেছে তার রূপোর বুলেট-ভরা রিভলভার, দাদা বলছেন, “দেখ, দেখ, লোন রেঞ্জার বন্দুক বার করেছে!” তার পরেই রিভলভারের নল দিয়ে ধোঁয়া আর “দুম!” কাহিনির মূল প্রতিপক্ষ এক মহিলা, যিনি স্বর্ণনগরের খোঁজে নিজের দলের লোককেও পেছন থেকে pickaxe ছুঁড়ে নির্দ্বিধায় খুন করেন! সবশেষে লোন রেঞ্জার আর তার লাল-মানুষ বন্ধু টোন্টো আবিস্কার করবে সোনার শহর! এক চমকপ্রদ দৃশ্য!

পূর্ণ-তে (ঊজ্জ্বলার মতো এটিও এখন আর নেই, যদিও বাড়িটি দেখা যায়; ঊজ্জ্বলার জায়গায় এখন নতুন ইমারত!) যত-না বাংলা ছবি দেখেছি, তার চেয়ে বেশী দেখেছি ইংরেজী! পূর্ণ-র প্রথম স্মৃতিই এক অতি স্নেহপ্রবণ টিকিট-চেকারের, যিনি “এসো ছোট ভাইটি আমার! কী দেখবে?” বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। দেখতে গিয়েছিলাম ১৯৫৮ সালের Son of Robin Hood[2] গল্পের চমক হলো রবিন হুডের ছেলে নয়, মেয়ে ডিয়ারিং হুড! তরোয়াল খেলা ছিল আমার কাছে ছবির মূল আকর্ষণ! গল্প পরে মা’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

এই পূর্ণতেই দাদা এক রবিবার সকালে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, বাড়িতে যার সম্বন্ধে বই ঠাসা, সেই টার্জানের, আমার কাছে, প্রথম ছবি, ১৯৫৯ সালের Tarzan’s Greatest Adventure,[3] এবং তার কয়েক রবিবার পরে, ১৯৬০ সালের Tarzan the Magnificent[4] পরে, ৮০-র দশকে, ব্রিটিশ টেলিভিশনে দুটি ছবিই আবার দেখেছি। অবাক হয়েছি যে প্রথমটিতে খলনায়কদের নেতা ‘স্লেড’-এর ভূমিকায় ছিলেন পরবর্তীকালে Operation Crossbow, Lawrence of Arabia, এবং আরও পরে শেক্সপীয়রের রচনার চিত্ররূপে অভিনয়কারী স্যর অ্যান্টনি ক্যোয়েল, আর স্লেডের এক সহকারীর ভূমিকায় শীঘ্রই জেমস বন্ড-রূপে যিনি বিখ্যাত হবেন, সেই শন কনারী! দাদার সঙ্গে আমার প্রথম দুটি টার্জান ছবি দেখি ৬ বছর বয়সে, আর সেই দাদারই মেয়ে, আমার ভাইঝিকে নিয়ে আশির দশকের শুরুতে মিনার্ভা, পরে নাম পালটে যা হয়েছিল ‘চ্যাপলিন’, প্রেক্ষাগৃহে দেখব ১৯৬২ সালের Tarzan goes to India,[5] যাতে Tarzan the Magnificent ছবির খলনায়ক কয় ব্যান্টনের ভূমিকায় অভিনয়-করা জক ম্যাহোনি আবির্ভূত হবেন নায়ক টার্জানের ভূমিকায়!

মোটামুটি এই সময়েই মা আর দাদার কাছে ট্রয় আর গ্রীসের যুদ্ধের গল্প শুনে ভালো লেগেছিল। দাদা লাইটহাউসে নিয়ে গেলেন ১৯৬১ সালের The Trojan Horse দেখতে। প্রথম দৃশ্য এখনো চোখে ভাসেঃ

অ্যাখিলিস তাঁর রথে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ট্রয়ের মহাযোদ্ধা হেক্টরের মৃতদেহ, কারণ হেক্টরের হাতেই মৃত্যু ঘটেছিল অ্যাখিলিসের প্রাণাধিক সখা প্যাট্রোকোলাসের। প্যারিস, যার অদম্য লালসার জন্য এই বিধ্বংসী যুদ্ধ বাধে বলে মনে করা হয় (এখন পণ্ডিতেরা বলেন হেলেনের প্যারিসের সঙ্গে ট্রয়-পলায়নকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে গ্রীস ঈজিয়ান সাগরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতাকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে!) কি রকম যেন হোঁদল-কুতকুতে, তবে ছবির মূল তারকা ইনিয়াসের ভূমিকায় স্টীভ রিভস (যিনি একাধিক ছবিতে হারকিউলিস-রূপে বিখ্যাত)। এরপর কাঠের ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে গ্রীকেরা ট্রয় নগরে প্রবেশ করে শহর ও সভ্যতা একসঙ্গে ধ্বংস করে। হেলেনের স্বামী মেনেলস প্যারিসের চুলের মুঠি ধরে তার পেটে ঢুকিয়ে দেন তরবারি।

আর মনে আছে, এর অনেক পরে মক্ষমূলার ভবনে দেখা, কিন্তু আগে তোলা, ১৯৫৬ সালের Helen of Troy ছবিতে প্যারিস বারবার রথে-চড়া অ্যাখিলিসের দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন, কিন্তু অ্যাখিলিসের শরীর তো একটি জায়গায় ছাড়া অভেদ্য! শেষে প্যারিস দেবরাজ জিউসকে স্মরণ করে তীর ছোঁড়েন, আর সেই তীর গিয়ে লাগে অ্যাখিলিসের গোড়ালিতে। মা থেটিস যে ওই গোড়ালি ধরেই ছেলেকে স্টিক্স নদীতে ডুবিয়ে তার দেহ অস্ত্রের পক্ষে দুর্ভেদ্য করেছিলেন! অ্যাখিলিসের মৃত্যু হয়।

(ক্রমশ)



[1] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26262887

[2] By Source (WP:NFCC#4), Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=49449467

[3] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26749132

[4] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=43190783

[5] By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=26745430


পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

 

কবি বিনয় মজুমদার সম্পর্কিত কিছু নতুন ভাবনা


(‘গল্পকবিতা’ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো - ‘ইন্টারভিউ’/ আমার সৃষ্টিরা সব কাগজের ভগ্নাংশে নিহিত জিজ্ঞাসাবাদঃ দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় / রেকর্ডিংঃ কৃষ্ণগোপাল মল্লিক / অনুলিখনঃ দুলালচন্দ্র দাস /  সম্পাদনাঃ সুনীলকুমার দত্ত)

 


প্রথমে আছে একটি চিঠি। তপন গঙ্গোপাধ্যায় (২৬.০১.৭২) কবিতা চেয়ে চিঠি দিলে উত্তরে বিনয় মজুমদার  (৫.২.৭২) লেখেনঃ... ‘আপনাদের কাছে আমার লেখা কবিতা পাঠাতে পারলাম না। কারণ আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছি, আর কোনো দিন কবিতা লিখব না।’ এই ঘোষণা স্তম্ভিত করেছিল কবিসমাজকে। সত্যিই আর তেমন লেখা হয়নি। ওঁর কয়েকটি খসড়া দেখেছেন ‘মহাবাহু’ সম্পাদক অভিজিৎ লাহিড়ীর কাছে প্রাবন্ধিক অর্ণব সেন। অর্ণব সেনের বর্ণনায় প্রায় দুর্বোধ্য হাতের লেখা, কবিতাও নয়, শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু শব্দ পরপর সাজানো। কবি তখন দারিদ্র্য অবহেলায় শেষ শয্যায়। না, বিনয় মজুমদার অনেক আগেই চলে গেছেন। একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর সাক্ষাৎকার দুটি মন্তব্যই তুলে দিচ্ছিঃ (১) ‘না, কবিতা আমি লিখতাম, এটা ঠিক, কিন্তু সেটা আমার গণিত চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে এবং তুমি আমার কবিতাগুলো পড়ে দেখলে পাবে যে অধিকাংশই গাণিতিক কবিতা।’ (২) সব শেষে প্রশ্ন ছিল ‘আপনি গণিতের যে স্তরের কথা বললেন সেই অ্যাবস্ট্রাক্ট অবস্থা তো কবিতার খুব কাছাকাছি।’ বিনয়ের উত্তরঃ ‘হতেও পারে আবার তা নয়ও। কারণ কবিতার প্রধান বস্তু ইমাজিনেশন আর গণিতের মূল উপাদান হার্ড ফ্যাক্টস যা বাস্তব।...’

বিনয় মজুমদারের কবিতা অনেকগুলো বেরিয়েছিল ‘গল্পকবিতা’ পত্রিকায়। মার্চ ১৯৭০ এর সংখ্যায় বেরোয় ‘বিনয় মজুমদারের আরো কবিতা’। তিনটির মধ্যে ছিল ‘ধ্বনির সহযোগিতায়’, ‘আলট্রা বলেনি’ এবং ‘আমলকী’। ‘আমলকী কবিতার কিছু অংশঃ

‘এক বলে কিছু নেই, কারণ দুয়ের মতো সাজানো তিনের চার, পাঁচ ...দশের অস্তিত্ব সকল কিছু ভেদ ক’রে চলে যায় দুই তিন... দশ নেই এই ভেবে ভেবে...

কিন্তু, আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন যে ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি থেকে তিনি নতুন উদ্যমে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। দেড় বছরে দুইশত কবিতা লিখেছেন। তাহলে কবির কথা অনুযায়ি ১৯৭১ সালের শেষ পর্যন্ত লেখা এই সব কবিতা। হতেই পারে ১৯৭২ সালেই আবার তাঁর মানসিক ব্যাধি শুরু হয়, যা শুরু হয়েছিল তিনি ১৯৬৭ সালে কলকাতা ছেড়ে শিমুলতলা যাওয়ার পর থেকেই। জানা যায় কবি ১৯৬৭ সালেই বিনা পাশপোর্টে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে পড়েন এবং ছয় মাস জেল খেটে বাড়ি ফেরেন। জানা যায় যে ১৯৮৭ এবং ১৯৮৮ সালে দুইবার মানসিক রোগের কারণে দীর্ঘদিন কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

উপরের সাক্ষাৎকারে কবি যে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন তার সমর্থনে আমরা আরও কিছু তথ্য পরিবেশন করতে পারি। আর একটি কথা আত্মপরিচয় প্রবন্ধে ১৯৭০ সালের পর জীবনের কোন তথ্য নেই। ১৯৯৩ সালে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসমগ্র ১ম খণ্ড প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সম্পাদকের সাথে কবির যোগাযোগ ছিল। তা সত্ত্বেও আত্মপরিচয় পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি কেন? নিশ্চয় কবিকে দিয়ে আর কিছু লেখানো সম্ভব ছিল না।

১) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা সামাজিক মাধ্যমে বিনয় মজুমদারের যে সব গ্রন্থের আলোচনা দেখা যায় তার মধ্যে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসমগ্র ১০ খণ্ডের অন্তর্ভূক্ত “নক্ষত্রের আলোয়”, “গায়ত্রীকে”, “ফিরে এসো চাকা”, “অধিকন্তু”, “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” ব্যতীত আর তিনটি গ্রন্থের উল্লেখ পাই- “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”, “বাল্মীকির কবিতা” এবং “একা একা কথা বলি”। কিন্তু ১৯৭৪ সালের পর থেকে আকাদেমি পুরস্কার পাওয়া পর্যন্ত গোটা দশেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলি আগে লেখা অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন ছাড়া আর কিছু সম্ভব নয়।

২) এর মধ্যে দেখা গেছে “বাল্মীকির কবিতা” (১৯৭৬) এর পর “আমাদের বাগানে” (১৯৮৫) প্রকাশিত হয়েছে প্রায় দশ বছর পরে। তার মানে তিনি নিয়মিত লিখতে পারতেন না।

৩) “এখন দ্বিতীয় শৈশবে” লেখা হয় ১৯৫২ সালে ইডেন হিন্দু হোস্টেলে। প্রকাশ করে শিলীন্ধ্র ১৯৯৯ সালে।

৪) কবি যে কাব্যজগৎ থেকে দূরে ছিলেন তা বোঝা যায় কবির বিলম্বিত আকাদেমি পুরস্কার লাভে। কবি জয় গোস্বামী পেয়েছেন ২০০০ সালে আর অনেক প্রবীণ এই কবি পেয়েছেন ২০০৫ সালে, মৃত্যুর আগের বছর। যে গ্রন্থের জন্য তিনি এই পুরস্কার পান তার নাম “হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ”। বোঝাই যায় কবির স্বাস্ত্যের অবনতি কবির আকাদেমি পুরস্কার ঘোষণার অনুঘটক হয়েছে।

৫) মৃত্যু এবং আকাদেমি পুরস্কারের পর গ্রন্থ প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায় প্রকাশক মহলে। ২০০৫ সালে “শিমুলপুরে লেখা কবিতা” প্রকাশিত হওয়ার পরে মৃত্যুর বছর মোট নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় - পৃথিবীর মানচিত্র, বিনোদিনী কুঠী, একা একা কথা বলি, নির্বাচিত কবিতা, ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য, আকাশে চাঁদ নেই অথচ আজিকে পূর্ণিমা, দুপুরে রচিত কবিতা (২০০৬)। অসুস্থ মানসিক রোগগ্রস্ত রোগীর এতো লেখা জমা ছিল অপ্রকাশিত অবস্থায়?

 আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি নিজের কবিতার সম্বন্ধে লিখছেন,

 ‘অথচ তীক্ষ্ণতা আছে, অভিজ্ঞতাগুলি সূচিমূখ,

ফুলের কাঁটার মতো কিংবা অতি দূর নক্ষত্রের

পরিধির মতো তীক্ষ্ণ, নাগালের অনেক বাহিরে।

ফুলের কাঁটা এবং নক্ষত্রের দূরত্ব। উপমার মাধ্যমে দর্শনকে নিয়ে আসা। অঘ্রাণের অনুভূতিমালা ছয়টি কবিতা। আলাদা কবিতা হিসাবে ছয়টি পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছা দেখালেও প্রকাশ করেননি পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সমালোচনা লিখে দেননি অমিতাভ দাশগুপ্ত।

ফিরে এসো চাকার ২১ নম্বর কবিতায়

অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার

সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে, বাতাসের

নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

কবির বিজ্ঞানমনস্ক বাস্তবধর্মিতা কবিতায় প্রায়শই দৃষ্ট হয়। যেমন আকাশ যে সত্যি বর্ণহীন এবং বাতাসের কণায় আলোর বিচ্ছুরণের ফলে শুধুমাত্র নীল রং আমাদের চোখে আসে, তাই আমরা আকাশকে নীল দেখি। এই তত্ত্বটিই তিনি উপরোক্ত তিনটি লাইনে ব্যক্ত করেছেন। আবার “অভিজ্ঞতা” শব্দটির ব্যবহারও বাস্তবধর্মীতার পরিচায়ক হয়েছে বারবার তাঁর কবিতায়।

আবার ২০ নম্বর কবিতায়

আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভচারী

বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো নাই মেশো,

সেও এক অভিজ্ঞতা,

উপরোক্ত তিনটি লাইনেও সেই ফুটন্ত জলের থেকেই উদ্ভূত বাষ্পের এক কাব্যিক বর্ণনা বাস্তবধর্মিতার নিদর্শন রেখেও। আবার সেই “অভিজ্ঞতা” শব্দের ব্যবহার।

গায়ত্রীকে গ্রন্থের শেষ কবিতায় (১৪তম)

চাঁদের ছায়ার নীচে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের

সময়ে পৃথিবীলোকে দিগন্তের সর্বদিকে ছেয়ে,

কমলালেবুর মতো কী এক আশ্চর্য আলো জাগে।

সূর্যে কালো বৃত্তটিকে ঘিরে থাকে অপরূপ এক

রূপালী হীরকদীপ্তি; জ্ঞানোদয় হওয়া জেনেছি,

আকাশের রঙ নেই, বাতাসের নীলাভতা হেতু

আকাশের অবয়ব দিবালোকে নীল মনে হয়।

ঋতুস্রাব বন্ধ হলে যতই সঙ্গম করি, সখি,

সন্তানলাভের আশা সম্ভাবনা শূন্য হয়ে থাকে।

উপরোক্ত লাইন কয়টি বিজ্ঞানের অনুসারী মহাজাগতিক এক ঘটনার বর্ণনা কাব্যময়তার কায়ায়। আর এখানে আরো স্পষ্ট করেছেন আকাশ নীল শুধু দিবালোকে। রাতে আকাশের রং বর্ণহীন বা কালো। শেষ দুটি লাইন কবির আদিরসাত্মক রচনার নিদর্শন, যা এক সময় তিনি বেশ কিছু কবিতায় প্রকাশ করেছেন।

অঘ্রাণের অনুভূতিমালা গ্রন্থের ৫ম কবিতায়

পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে, চন্দ্র পৃথিবীকে ঘিরে কোনভাবে আবর্তিত হয়-

আবর্তিত হয়ে গেলে এদের গতির গুণ এবং ধরন কী-রকম

হয়ে থাকে জেনে নিতে পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদে একসাথে বসে সব মাপা

ঠিক সমাধান নয়, সমাধান হলো আঁকা, চিত্রাকারে এঁকে তাতে আরো বহু বিশ্লেষণী রেখা

এঁকে-এঁকে জ্যামিতির, সূর্য চন্দ্র পৃথিবীর ঊর্ধে উঠে সেই জ্ঞানে- শুধু জ্ঞানে উপনীত হওয়া।

আমরা যা করি তার সবই এই আঁকাআঁকি, কোনটাই মূল হয়, সবই শুধু ছবি করে আঁকা।



এখানেও কবির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং কাব্যিক প্রকাশের এক মেলবন্ধন দেখা যায়। একটি নিমন্ত্রণপত্রের খামকে নিজের গাণিতিক ভাবনা দিয়ে অক্ষয় করে দিয়েছেন বিনয় মজুমদার। লেখার মধ্যে আছেঃ ‘-১’-এর বর্গমূল যাকে ইনফিনিটি বলা হয় এবং প্রকাশ করা হয় ইংরেজি ‘i’ দিয়ে। সেই খামটির প্রতিচ্ছবি ইনটারনেট থেকে সংগ্রহ করে দিলাম।

 

 

 

 

 

 

 

 


শিবাংশু দে

 

কবি ও সুরসুন্দরী

 


                

কবিকে নিয়ে ইয়ারকি-ফাজলামো তো আমাদের বাবাদের আমল থেকেই ছোকরাদের জন্য একটা প্রিয় ব্যসন। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। একশো ষাট বয়স পেরোনো একজন মানুষের প্রতি আর কীসের চ্যালেঞ্জ?  তবু টান না থাকলে কেউ ইয়ার্কি মারে না। উল্কার মতো লাফিয়ে ওঠা ঝলমলে জনতা কীভাবে পলকে ছাই হয়ে ধুলোয় মিশে যায়, এ জীবনে তা অগণন দেখা যায়। যদি তাই হয়, ব্যাপারটা হয়তো সামান্য হলেও সিরিয়স। বাঙালি হয়ে জন্ম নিলে কবির প্রতি একটা 'টান' থেকেই যায়। 'টান' ব্যাপারটা ঠিক কোথা থেকে আসে? পারিবারিক উত্তরাধিকার? ব্যক্তিগত অনুভব? সামাজিক অভ্যেস? যাপিত বিজ্ঞাপন? হয়তো সবই, নানা মাত্রায়। সেদিন একটা লেখা পড়লুম। কয়েকজন ছেলেপুলে আড্ডা দিচ্ছে, তার শ্রুতিলিখন। সেখানে একটি ছেলে বলছে হানি সিং-এর যুগে ফিউসন না করলে বুড়োর গান টিকবে না। তার বন্ধুবান্ধবরা বঙ্গদেশীয় বাঙালি। তাদের অধিকাংশই যাপন অভ্যাসে কোনও না কোনও ভাবে কবি প্রভাবিত। ব্যক্তিসূত্রে হোক, বা পারিবারিক সূত্রে। কবির গান সম্বন্ধে তাদের ভালো লাগা, না লাগার নিজস্ব মাত্রা আছে। কিন্তু বাকি বন্ধুরা ওই ছেলেটির ‘স্মার্ট' সংলাপটির সঙ্গে একমত হতে দ্বিধা বোধ করছে।  গুড়গাঁওয়া-র বিগ ফ্যাট বিবাহ পার্টির গান-বাজনা বা বেঙ্গালুরু-র মধ্যরাতের পাব-এ জড়ো হওয়া মানুষজনের জন্য জকি-র বেছে নেওয়া গানের মধ্যে কবির গান যে আসবে না, সে নিয়ে তো কারো মনে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু হানি সিং-এর গান আসবে। কবির গানের প্রতি কি কোনও মাথার দিব্যি রয়েছে? তাকে কেন সতত, সর্বত্র প্রাসঙ্গিক থাকতে হবে? অনেক সমঝদারই তো বলেন কবির গান মানে 'নির্জন, এককের গান'।  কেউ ভিন্নমত হতে পারেন, কিন্তু কথাটা অনেকটাই সত্যি।

আমার মনে হয়েছে 'প্রাসঙ্গিকতা'র সমস্যাটি কবির গানের জন্য নয়। বাঙালিরা নিজস্ব 'সাংস্কৃতিক সম্পদ'  নিয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই সম্পদের উত্তরাধিকারের সঙ্গে কবির গান ওতপ্রোত। প্রত্যেক বাঙালির জন্য তা এক  মূল্যবান ওয়ারিশনামা। আত্মপরিচয়ের সঙ্গে জড়িত। সে গানের  প্রতি কোনও রকম 'অবহেলা' একজন গড় বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কবির গান যাঁদের জন্য সৃষ্ট হয়নি, তাঁদের কাছেও যেন তার 'প্রাসঙ্গিকতা' থাকে । এই আকাঙ্খা বাঙালির অবচেতনে থেকে যায়। সেই তাড়না থেকেই হয়তো হানি সিং-এর সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দেখার উতলপনা ।   

সারাদেশে বসবাস করার সূত্রে দেখেছি বাঙালি জাতির সঙ্গে গানের প্রসঙ্গ ইঞ্জিনের পিছনে কামরার মতো চলে আসবেই। হুবলির এক কন্নডিগা সহকর্মী চুপিচুপি শুধালেন কবির সব গানই কি ট্র্যাজেডি-কেন্দ্রিক? তাঁর শুনতে তেমনই লাগে। হায়দরাবাদে এক নিপুণ যন্ত্রশিল্পী ছিলেন। কখনও আমার সঙ্গে সঙ্গত করতেন। তাঁর ধারণা ছিলো 'গান' নিয়ে যে কোনও  'বাঙালি'র ধ্যানধারণা চূড়ান্ত। তা নিয়ে কোনও ভাবে ভিন্নমত হওয়া যায় না। কারণ তা কবির গান থেকে এসেছে। অথচ তিনি একবিন্দু বাংলা জানতেন না। কবির গান হৃদয়ঙ্গম করা দুরস্থান। শ্রদ্ধেয় মান্না দে'র স্মৃতিচারণে পড়েছি বম্বের একজন নামজাদা সঙ্গীতকার তাঁর কাছে অভিযোগ করতেন কবির গানে কোনও বৈচিত্র্য নেই। একদিন মান্না দে সেই সঙ্গীত পরিচালককে নিজের বাড়িতে ডেকে ঘন্টা ধরে নানা রকম রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছিলেন। শেষে শুনিয়েছিলেন 'ওগো স্বপ্নস্বরূপিনী'। উদ্দিষ্ট শ্রোতা গানের নেশায় এমন বুঁদ হয়ে পড়েন, কোনও মন্তব্য না করে নির্বাক বেরিয়ে যান তাঁর বাড়ি থেকে। পরে নাকি তিনি মান্না দে'কে বলেছিলেন সেই সব গানের নির্মাণ এক কথায় 'অপার্থিব'।  

নাহ, কবির গান নিয়ে লিখবো ভাবিনি। মুক্তপক্ষ ভাবনার কোনও দিশা থাকে না। কথার পিঠে কথা চলে আসে। আজ বিকেলে হাঁটতে বেরোইনি। বিভূতিভূষণ পড়ছিলুম। 'কিন্নরদল'। 'মণিডাক্তার'-এ এসে আটকে গেলুম। বিধু গয়লানির মেয়ে 'প্রমো'র গল্প পড়তে পড়তে মনে হলো যেন রাগ  মধুবন্তী। কোনও কারণ নেই। একেকটা রাগের পাগলামিই এরকম। মনে পড়ে গেলে শুনতেই হয়। পড়া ছেড়ে দিয়ে গেলুম রাশিদ খান সাহেবের কাছে। ওঁর সেই তরুণ বয়সে, ১৯৯১ সালে গাওয়া রাগ মধুবন্তী'র অনুষ্ঠানটি আমার প্রিয়। বহু বার শোনা, তবু পুরোনো হয় না। একটা অদ্ভুত রাগ। সেই কোথায় পঞ্জাবের শেষ প্রান্ত মুলতানের থেকে আসা একটা সুর থেকে রাগ মুলতানি, দক্ষিণদেশে এসে রাগ মধুবন্তী হয়ে গেলো। তোড়ি থাটের রাগ, কিন্তু তার সময় আসে অপরাহ্নে, কচি সাঁঝবেলায়। দরবারি বা রাগেশ্রী-র মতো গুমোর নেই কোনও। সহজ শৃঙ্গার রসের রাগ। কান বেয়ে মাথায় যায়। বোধের থেকে অনেক বেশি সখ্য  আবেগের গোধূলি আলোছায়ায়।

গান শুনতে শুনতে চলে যাওয়া বেলুরুর চেন্নাকেশব মন্দিরে সুরসুন্দরীদের সুর-জলসায়। শরীরের চোখ, মনের কান জুড়ে তাদের আবেশ পাহাড়ি মেঘের মতো চমক দিয়ে ভিজিয়ে যায়। এঁদের বয়সও তো কোণার্কের সুন্দরীদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। কে বলবে? জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। আবার না জন্মালে এঁদের আর দেখা হবে না।  সারি সারি পাথর হয়ে থাকা সেই সব বিভঙ্গ বিলাসিনী  সুরসুন্দরীরা সামনে এসে দাঁড়ায় । কবি আর কী করে দূরে থাকেন? তিনিও পায়ে পায়ে, এভাবেই,

 

'...মুখে তার লোধ্ররেণু লীলাপদ্ম হাতে,

কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে,

তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা,

চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।

বসন্তের দিনে

ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে...

 

…সন্ধ্যার লক্ষ্মীর মতো সন্ধ্যাতারা করে।

অঙ্গের কুঙ্কুমগন্ধ কেশধূপবাস

ফেলিল সর্বাঙ্গে মোর উতলা নিশ্বাস।

প্রকাশিল অর্ধচ্যুত বসন-অন্তরে

চন্দনের পত্রলেখা বাম পয়োধরে।

দাঁড়াইল প্রতিমার প্রায়

নগরগুঞ্জনক্ষান্ত নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়…’