মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৩


কোজাগরী

ক্রমাগত হেরে যাচ্ছে। দ্রুততর রাত ওকে ফেলে ছুটে যাচ্ছে গ্রাম থেকে শহর। পুকুর আর ফসলের মাঠ পেরিয়ে অনেক দূরে। সে বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে চলে। অবশেষে ভবঘুরে। এ-গলি সে-গলি খুঁজে খুঁজে পাওয়া গেল একটুকরো ছাদ। পুরুষ না নারী!

তবু ভালবাসে। তবু গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কালো জলে।

"যার বিষে হচ্ছি নীল দিবানিশি

জানি না কেন তাকেই ভালোবাসি" (গোবিন্দ বৈরাগী)

ভালোবেসে নক্ষত্রের কাছে এসে এখন থৈ থৈ জলে দ্যাখে হেরে যাওয়া মুখ। ঘাটে এসে শুয়ে থাকি রাতে। পালিয়ে পালিয়ে হিজলের বাঁকা ডালে, কার্নিসে, কার্নিসে। যেন কেউ না দেখে।

এই ‘আমি’ আবহমান। এই আমি নশ্বর। এই আমি ভীরু। কাপুরুষ হয়ে পালিয়ে বেড়াই এখন। শরীর থেকে বিচ্ছুরিত সংশয়ে এখন জাগছে হায়নারা। জাগছে হত্যা, নিষিদ্ধের হাতছানি। ‘এই চাঁদ তোমার আমার’। এইরাত! এই জ্যোৎস্না!

তীব্র হচ্ছে কাম। ক্ষত বিক্ষত দেহময় কাম। বৃদ্ধ চাঁদের রতি আরাধনা। শরীর ভেঙে উঠে আসছে ঘাতক। যাবতীয় নিঃশব্দ আয়োজন মৃত্যুর।

এমন কত কাজলা দিদির জীর্ণ কুটির গলে ঢুকে পড়ে সে। আর কত মেয়েমানুষ একঠায় চাঁদের দিকে চেয়ে চেয়ে ভূতগ্রস্থের মত এগিয়ে যায় এক ফালি দড়ি নিয়ে অস্পষ্ট অন্ধকারে ফিরবে না বলে। অথবা কোনো আহত তরুণপ্রাণ ভালোবেসে মরে যাবে আজ রাতে শুধু এই সূক্ষ্ম চাঁদ ছোবলের বিষে।

‘স্বপ্নে মরা ময়ূর, তার গায়ে চাঁদের আলো...’ স্বপ্ন দেখে চাঁদ। হাজার অশ্বারোহী ছুটে আসছে পাড়ের দিকে।

একা নারী চাঁদের মত অথবা সেই কবি যে পূর্ণিমা থেকে নেমে আসা নিজের আত্মজাকে খেয়ে নেয় গোগ্রাসে।

একদিন বাসা ভাড়া করে চাঁদ আমার অভাবের ঘরে। প্রাচীন খয়াটে বেশ্যাচাঁদ। পা ছড়িয়ে বসে। ফুঁপিয়ে কাঁদে আলো আর ছায়াতে। অবধারিত এক বিচ্ছেদ বেদনায়। কুষ্ঠ রোগীর মত খসে খসে পড়ে শরীর। ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায় এক জন্ম আমার। অন্ধকার নিকষ পৃথিবী পথ হারিয়ে ফেলে।

আর তারপর আবার এক জন্ম চাঁদের আবার একথালা সাদাভাত, শ্যামবর্ণ চাষী চাষ করে চাঁদের জমিতে। পৃথিবীর প্রতি প্রগাঢ় প্রেমে বারবার জন্ম আর মৃত্যু। চাঁদ সদাগর ভেসে ভেসে কলার ভেলায়। গ্রামে গ্রামে হৈমন্তী রাতে পা গুটিয়ে বসে দেখে ওরা। বেহুলার ক্রন্দন। পালাকার ঘাড় নাড়ে পর্দার আড়াল থেকে। বাঁশি বাজে। শুরু হবে পালাগান দ্বিতীয় প্রহরে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন