পরিবার ধর্ষণ ও বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত
সময় এবং পৃথিবীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান বিজ্ঞানের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে কাজ হচ্ছে। সেটা মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে
মানবজীবনের বিভিন্ন চৌহদ্দি – সবকিছু নিয়েই বৈজ্ঞানিক
দৃষ্টিভঙ্গির লেন্সের তলায় মাপা জোকা চলছে নিরন্তর। উঠে আসছে জীবন ও যাপন সম্পর্কে নতুন
সত্য। সেই সূত্র ধরেই আমরা আমাদের অতীত পৃথিবী ও সমাজ জীবনের নানা চোরাগোপ্তা অলিগলির
বিষ্ময়কর অনাচার নিয়ে সতর্ক হবার সুযোগ পাচ্ছি।
পরিবার তো সেটা নয় যেখানে একজন মানবস্বত্বার অস্তিত্ব
রক্ষার অতি প্রয়োজনীয় সীমারেখা গুলোকে নিরন্তর অতিক্রান্ত হতে হয়। পরিবার সেটা নয় যেখানে একজন মানুষের
মৌলিক প্রয়োজন গুলোকে মেটাবার জন্য অন্যের দরজায় ভিক্ষের আঁচল পেতে ধরতে হবে। পরিবার সেটাও নয় যেখানে ব্যক্তির ব্যক্তিগত
পছন্দ অপছন্দ গুলোকে অন্যের ইচ্ছে অনিচ্ছের নিরিখে বিচার করে দেখা হবে। পরিবার সেটা নয় যেখানে একজন ব্যক্তিকে
তার নিজস্ব স্বত্ত্বায় বিকশিত হয়ে উঠতে বাধা দেওয়া হবে। পরিবার সেটা নয় যেখানে একজন মানুষ তার নিজের
নিরাপত্তা নিয়ে সদাচিন্তিত, ভীত, সন্ত্রস্ত থাকবে। আবার পরিবার এটাও নয় যেখানে
একজন ব্যক্তিকে সবসময় তুলনামূলক সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে। অথচ সেই পরিবারেই
নারীর আত্মিক বিকাশে, তার অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসংক্রান্ত মেরুদন্ড তৈরীর ক্ষেত্র গুলোতে
বৈবাহিক সূত্রে আসা পরিবার ও সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আজও ছেদ টানার পর্ব নিরন্তর ঘটে
চলেছে। কয়েক দশক আগেও ভালো ও উচ্চমানের ফলাফল করা ছাত্রীদের কাছ থেকে তাদের
পরবর্তী পড়াশুনো ও চাকরী করার অধিকার কেড়ে নিত তাদের স্বামী শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, আজও
এই প্রজন্মেও সেই ওই একই ঐতিহ্য একইভাবে অব্যাহত আছে। দুহাজার ষোল সতেরো নাগাদ সমাজমাধ্যমের
সূত্র ধরে নজরে আসে এক আধুনিক শিক্ষিত চাকুরীরতা নবদম্পতির কথা যেখানে মেয়েটি একই
বিষয়ে ছেলেটির থেকে উচ্চ মেধা সম্পন্ন হওয়া স্বত্বেও বেচারা তার চাকরীটা ছেড়ে দিতে
বাধ্য হয় স্রেফ ছেলেটির অর্থাৎ স্বামী বাবাজীবনের অফিসের খাবার ও টিফিন করে দিতে
গিয়ে বাধ্য হয়ে। এই কাজে প্রচ্ছন্ন মদত যুগিয়েছে মেয়েটির বাবা এই যুক্তিতে যে
একমাত্র সন্তান হবার জন্য ও শ্বশুরবাড়ির স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির কলেবর মোটের ওপর
কম না হওয়ায় মেয়েটির চাকরি সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ সংসারে ততটা দরকারী নয়। অন্যদিকে
স্বামী শ্বশুরবাড়ি রক্ষা করে চলতে না পারলে আত্মীয় স্বজন সমাজ সংসারের কাছে মেয়েটি
ভালো মেয়ে পদবাচ্য হবে না। নিজের শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, চাকরি ও অন্য কোনো কিছুর
জন্যই যেন কোনো মেয়েকে বিবাহবিচ্ছেদের দ্বারস্থ হতে না হয়, গুডগার্ল সিন্ড্রোমের এ
হেন তাস পেটানো পিতৃতন্ত্র কিন্তু ছেলেদের স্বাবলম্বী করে না তুলে এখনো তাদের
ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখার ব্যাপারে সদা সচেষ্ট। এই
পিতৃতন্ত্রের পরম প্রতিভূ, প্রায় সব পরিবারেরই পিতার, যতক্ষণ না যুগোপযোগী নতুন মূল্যবোধে শিক্ষিত ও দীক্ষিত
হচ্ছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়েরা, ততক্ষণ ধর্ষণের মতো
অপরাধের দায় ও দায়িত্ব তাদেরও নিতে হবে।
বলা বাহুল্য ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য বর্বরতার
জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দায়ী এরাও। এগুলো না গেলে ধর্ষণও যাবে না।
মেয়ে সন্তানকে বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠাতে হবে বলে এখনো
যেসব মায়েরা, বাবারা ছেলেসন্তান চান, ছেলেরা পরিবারের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি শুধু ছেলে বলেই পাবার যোগ্য এবং মেয়েরা
নয় এমন ভাবনাও যেসব মায়েরা বা মেয়েরা মনের মধ্যে আগলে নিয়ে বসে আছে, ধর্ষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায় এড়াতে পারে না সেইসব নারীগোষ্ঠীও। আবার যে শিক্ষিত মেয়ে তার বাবার সম্পত্তির
অধিকারকে আইনের খাতাতেই সীমাবদ্ধ রেখে, সেটার জন্য সচেষ্ট
না হয়ে শ্বশুরের সম্পত্তি পাবার জন্য প্রাণপাত করে বা পুত্র সন্তান প্রসবের পথে হাঁটে
সেই নারীও কিন্তু পরোক্ষভাবে ধর্ষণের জন্য সমানভাবে দায়ী। এই দায় তিনি মেনে নিলেন কিনা তাতে সমাজ
বা সভ্যতার কিছু যায় এসে যাবে না। ভবিষ্যতের পৃথিবীর ইতিহাসে এরা কিন্তু চিনহিত হয়ে থাকবেন
এভাবেই।
একবিংশের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রম করে এসেও যখন একজন শিক্ষিতা
শিক্ষিকা নারী নারীবাদ সম্পর্কে ছুঁৎমার্গে সামিল হন কিম্বা অন্য কাউকে, ‘ও বাবা! তুমি ফেমিনিস্ট নাকি!’ বলেন তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না শিক্ষা কনসেপ্টটা বাস্তবিকই এদের কাছে জগত ও
জীবনকে দেখার ও বোঝার
ও সেগুলোকে বিবর্তিত করার কোনো উপায় নয় আদৌ। তাই নারীবাদ মানবতাবাদেরই একটা অংশ
মাত্র। এটা নারী ও পুরুষের উভয়েরই উন্নততর বিকাশের একটা প্রাথমিক শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের
এই দুনিয়াতে। এর পেছনেও রয়েছে পিতৃতান্ত্রিক গুড
গার্লসিন্ড্রোম যা তাকে পঙ্গু ও অথর্ব করে রেখেছে। এরা এটাও ভেবে দেখে না যে বর্তমান দৈনন্দিনতার
পেছনে পিতৃতন্ত্রের কি সুগভীর চক্রান্ত কাজ করছে। ধর্ষণ তো পিতৃতন্ত্রের একটা হাতিয়ার
নারীকে দমিয়ে দাবিয়ে রাখার। এরা তাতে খুব সুন্দর ফিট হয়ে যান যে যার নিজের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধের চাহিদা
মাফিক যোগানে নিজেকে পুরো দস্তুর বেঁচে দিয়ে। বলা বাহুল্য ধর্ষণে এদের ভূমিকা একেবারে
নগন্য নয়।
যেমনটা স্যোসাল সাইকোলজিতে পরিমাপ করা হয়, কর্তৃত্বকে প্রশ্ন করার ভয় বা অস্বস্তি বা আত্মবিশ্বাসহীনতা মধ্যযুগে
মানবমনের কোনায় যতটা গভীর হয়ে জমেছিল, গনতন্ত্র এসে সেই বাঁধাটাকে
অনেকখানি অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে মানুষকে। ঠিক এই কারণেই আগে পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদ
পারিবারিক পরিমন্ডলে যতটা কঠোর হয়ে চেপে গেঁড়ে বসেছিল, যত সময় গেছে সেই অন্ধত্বের বাঁধন তত শিথিল হয়েছে। এখন আর নারী মানেই সন্তানের জন্ম
দেওয়া এবং ঘরের কাজ আর পুরুষ মানেই ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে ঘরে বসে থেকে অনন্ত অর্থ যোগানের
একমাত্র যন্ত্র হিসেবে কাজ করা নয়। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবারের যাত্রাও একে অনেক বেশি সহজ
করে তুলেছে, যদিও শতাংশের হিসেবে বদল একেবারেই নাম
মাত্র। ফলস্বরূপ প্রতি প্রজন্মে নারীরা আজ অনেক বেশি লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে পরিবারের মধ্যে
প্রশ্ন তুলছে, বুঝে নিচ্ছে নিজেদের প্রাপ্য অধিকার। পুরুষরাও একই ভাবে এগিয়ে আসছে। সমতাভিত্তিক চিন্তাভাবনার দৌলতে তারাও
নারীর পাশে দাঁড়িয়ে নারীর সমানাধিকারের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রশ্ন, প্রতিবাদ ছুঁড়ে দিচ্ছে। হয়ত সব পুরুষ নয়। কিছু সংখ্যক পুরুষ। তবু এইই বা কম কী? আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পুরুষের বেশির ভাগের কাছেই নারী আর সন্তান
জন্ম দেওয়ার যন্ত্র নয়। নারীর প্রসবকালীন সমস্যা ও প্রসব যন্ত্রণা তাদের কাছে
অস্তিত্বের সংকট ঘনিয়ে নিয়ে আসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য এসবই মানবসভ্যতা, মানবতা তথা নারীবাদের ক্ষেত্রে এক ধ্বনাত্বক অধ্যায়ের সূচনা করে।
কিন্তু এখানে একটা কিন্তু আছে। এইসব পুরুরষদের সংখ্যা এতই নগন্য যে
তা শতাংশের হারে হিসেব করতে গেলে বেজায় বিপদে পড়তে হবে। এর একটাই কারণ সমাজের বৃহত্তর অংশ এখনো
জীবনযাপনের প্রাথমিক চাহিদা পুরণের জন্য যা যা সব দরকার, সেইসবই পাচ্ছে না। আধুনিক শিক্ষা, চিন্তাচেতনায় দীক্ষিত হওয়াটা তো অনেক দুরের ব্যাপার। আর যতক্ষণ না সঠিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের
বিস্তার সমাজের সর্বস্তরে হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে
পিতৃতান্ত্রীক মৌলবাদের দাপট বহাল তবিয়তে বিদ্যমান থাকবার সম্ভাবনা থেকে যাবে যার ফলাফল
হিসেবে ধর্ষণের ঘটনাও সমাজে ঘটবার পরিস্থিতি কোনো না কোনো ভাবে থেকে যেতে থাকবে। আর এ
কথা কে না জানে সমাজের বৃহত্তর মানুষের জীবনযাপনের মান নিয়ন্ত্রণ নির্ভর করে সেই সমাজের
রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ব্যাবস্থার ওপর।
এই শিরনামের একেবারে শুরুতে যে কথা বলেছিলাম, ভুল জ্ঞান আর ভুল তথ্য বিষয়ে, এবার আসব সেই
কথায়।
মানবসভ্যতায় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার উন্মেষ ঘটেছে দর্শনের
মধ্যে দিয়ে, যে কারণে দর্শনকে জ্ঞানবিজ্ঞানের মা বলা
হয়, আমরা সবাই জানি। তো সেই রকম এক উন্মেষলগ্নে জৈবিক লিঙ্গবৈষম্যের
কারণে নারীকে পুরুষের তুলনায় নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী বলে মনে করা হত কোনো জলজ্যান্ত প্রমাণ
ছাড়াই। দর্শনসম্রাট আরিস্তেতেলেস তাঁর আলোচনায় এমনটাই বলেছেন। বলেছেন তাঁর আগের ও পরের আরো অন্যান্য
দার্শনিকরাও কমবেশি, একমাত্র জন স্টুয়ার্ট মিল এর থেকে আলাদা
এবং পরবর্তীকালে বার্টান্ড রাসেল। আরিস্তেতেলেসের দার্শনিক অবস্থান সম্পর্কে একটা কথা বহুপ্রচলিত। সেটা হল দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানে তাঁর
প্রভাব সর্বগ্রাসী। বলা হয় যে তা এমন সর্বগ্রাসী যে তাঁর জ্ঞানের ধ্বনাত্বক
ও ঋণাত্বক প্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে গোটা পৃথিবীর জ্ঞান বিজ্ঞানের জগৎ তাঁর সময়
থেকে পরবর্তী দুহাজার বছর অব্দি। নারী সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যও এইভাবে আমাদের পৃথিবী ও সভ্যতার
জনজীবনকে প্রভাবিত করেছে। তার ওপরে প্রথম দিকের দর্শনজনীত জ্ঞান পরীক্ষা নিরীক্ষার
ওপর অর্থাৎ বিজ্ঞান নির্ভর না হওয়ার কারণে সেটার ভিত্তিহীনতাও ততটা প্রমাণিত ছিল না
যতদিন না জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে বিজ্ঞানের আবির্ভাব ও জয়যাত্রা শুরু হয় এই মাত্র কয়েকশো
বছর আগে। আরিস্তেতেলেসের এবং অন্যদেরও ভুল জ্ঞান ও ভুল তথ্য কীভাবে মানবজীবন, সমাজ ও সভ্যতাকে পৃথিবীর আদিম মৌলবাদের সাহায্যে ধ্বংসলীলার মুখোমুখি
করেছে সেটা সঠিকভাবে বোধগম্য হয় আজ যখন বিভিন্ন তথ্য ও সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে
জানতে পারি একজন ধর্ষক নিজেকে নারীর থেকে উচ্চস্তরের মানুষ বলে মনে করে শুধু নয়,
নারী কে ধর্ষণ করা তার অধিকার বলে মনে করে।
সর্বাধুনিক বিশ্ব নারীবাদ যদি অতীতের এই সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান
দর্শনকে মর্ষকামী আখ্যা দিয়ে সেই সমস্ত কিছুকে বাতিল করে নতুন করে নতুন জ্ঞান বিজ্ঞানের
নির্মাণ ও চর্চার দাবী জানায়, সেটা কি খুব অসঙ্গত
হবে?
(ক্রমশ)
একদম ঠিক।একশো শতাংশ। এই বিষয়ে নারীদের দায়িত্ব কম নয়, মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
উত্তরমুছুনঅন্তরা ঘোষ কর্মকার
মুছুন