বিদ্রোহী মহিলা কবি লাল দেদ
আধুনিক কাশ্মীরি ভাষার রূপকার লাল দেদ আজ এক মহান সাহিত্যিক হিসাবে বিখ্যাত। এছাড়া, তিনি ৭০০ বছর ধরে বহু কাশ্মীরি প্রজন্মের কাছে তাঁর কবিতা বা ভখের জন্য এক আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসাবেও বন্দিত।
বিভক্ত কাশ্মীরি সমাজে তিনি হিন্দু
এবং মুসলিমের কাছে সমানভাবে আদরণীয়। দুই ধর্মের মানুষের কাছে তিনি যথাক্রমে লাল্লেশ্বরী
এবং লাল্লা আরিফা নামে পরিচিত। কথিত যে তিনি আনুমানিক ১৩০১ থেকে ১৩২০ সালের মধ্যে এক
ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তখন কাশ্মীরের রাজনীতিতে বহু উত্থান-পতনের সময়। ১৩২০
সালে মধ্য-এশিয়ার এক সর্দার জুলচু কাশ্মীরের শেষ হিন্দু রাজা সহদেবকে পরাজিত করেন।
তিনি হাজার হাজার মানুষকে হত্যা এবং ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মাৎস্যন্যায়
চলে। অনতিবিলম্বে সোয়াটের (এখন পাকিস্তানের অন্তর্গত) এক সর্দার সামস-উদ-দিন শাহ মীর
কাশ্মীর আক্রমণ করেন। তিনি সেখানে শাহ মীর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সাম্রাজ্য
প্রায় দুই শতক রাজত্ব করে।
এক অশান্ত পরিবেশে লাল দেদ বড় হন।
প্রাথমিক শিক্ষার পর তাঁর বিবাহ হয় এবং রীতি অনুযায়ী নতুন নাম হয় ‘পদ্মাবতী’। কিন্তু,
শাশুড়ি তাঁর উপর অত্যাচার করতেন এবং তিনি স্বামীর কাছ থেকে সুবিচার পান না। শাশুড়ি
দেখতেন লাল দেদ প্রতিদিন সকালে জলের পাত্র নিয়ে নদীতে জল আনতে যেতেন আর সন্ধ্যার সময়
বাড়ি ফিরতেন। তিনি তাই বধূমাতাকে সন্দেহ করতেন। তিনি জানতেন না যে শিবভক্ত লাল দেদ
মাঝের এই সময় নদীর ওপারে এক শিবের মন্দিরে কাটাতেন। অত্যাচার সইতে না পেরে লাল দেদ
গৃহত্যাগ করলেন।
তিনি এক ভ্রাম্যমান ভিক্ষাজীবী
হিসাবে দিন কাটাতেন। এক সময় তিনি সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে বিবস্ত্র
হয়ে গেলেন। তাঁর রচিত ভখ গেয়ে গেয়ে তিনি পথ পরিক্রমণ করতেন। সেই সময় তিনি গুরু সন্ত
শ্রীকান্তের দেখা পেলেন।
লাল দেদের ভখগুলি হলো কাশ্মীরি
সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। তাঁর সময়ে কাশ্মীরে বৌদ্ধ, নাথ যোগি, ব্রাহ্মণ, সুফি
এবং তান্ত্রিক এমনতর বিবিধ সম্প্রদায়ের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি এই সব ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে
বৈচিত্র্যময় শব্দ আহরণ করে কাশ্মীরি ভাষাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
শ্রীনগরের প্রিয় সন্ত মাখদুম সাহেবের
ভাই মুল্লা আলি রায়নার লেখা ‘তধকিরাত উল-আরিফিন’ (১৫৮৭) নামক জীবনী-সঞ্চয়নে লাল দেদের
প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। ২৫০এর বেশি লাল দেদের ভখ কাশ্মীরি লোক সংস্কৃতিতে এখনও বিরাজ
করছে।
লাল দেদ এক বিদ্রোহী কবি ছিলেন।
প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতিকে তিনি ভখের মাধ্যমে আক্রমণ করতেন। তাঁর কবিতা ব্যাপকভাবে
অনূদিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যঃ ‘উওমেন ইন প্রেইজ অফ দি স্যাকরেডঃ ৪৩ সেঞ্চুরিজ অফ স্পিরিচুয়াল পোয়েট্রি বাই উওমেন’
(১৯৯৪) - জেন হার্সফিল্ড; ‘নেকেড সঙঃ লাল্লা’ (১৯৯২) - কোলম্যান বার্কস; ‘লাল্লা ভখিয়ানি’
বা ‘দি ওয়াইজ সেয়িংস অফ লাল-দেদ, এ মিস্টিক পোয়েটেস অফ এনসিয়েন্ট কাশ্মীর’ (১৯২০ )-
স্যার জর্জ গ্রিয়ারসন।
লাল দেদের কয়েকটি ভখের অনুবাদঃ
(১)
শুধিয়েছি গুরুকে হাজার বার,
কী নাম হতে পারে শূন্যতার,
হাল ছেড়েছি আমি অবশেষে;
সব নামের উৎস যিনি
নামে তাঁর কী যায় আসে?
(২)
তাদের কটূক্তি আর থুতু যেন আমার
মুকুট
কুৎসা আমার প্রতি পদক্ষেপকে তাড়া
করে
আমি লাল, আমি অবিচলিত থাকি
আমি কি বোকা, ওদের রাখার জায়গা
কোথায়?
(৩)
তোমার প্রতিমার পাথর, তোমার মন্দিরের
পাথর
সব পাথর পা থেকে মাথা বাঁধা
বিচিত্র ব্রাহ্মণ, তুমি কাকে পূজা
করো?
বদলে আমার নিঃশ্বাসকে বাঁধো।
(৪)
সর্ববিরাজিত শিব, তাকে সূর্য ভাবো
হিন্দুকে মুসলিমের থেকে আলাদা ভেবো
না
যদি জ্ঞানী হও, নিজেকে জানো
তাই হলো সাহেবকে জানার একমাত্র
উপায়
(৫)
খাবারে সংযমী হও, ব্যবহারেও সংযমী
হবে
সংযমীদের জন্য সব দরোজা খোলা
শৈত্য বাঁচাতে প্রয়োজনমতোই পরিধান
করো
ক্ষুৎনিবৃত্তি করতে প্রয়োজন মতোই
খাও
(৬)
এই জগতে জন্মে কোনো সম্পদ চাইনি
বিলাসিতা আর লোভের আমি পিয়াসি নই
সামান্য আহার আমার পক্ষে যথেষ্ট
দুঃখের ঝড় সামলে নিয়ে আমি ঈশ্বরের
সাথে আছি
(৭)
হাঁপরে চাপ দিয়েছি, ওর নিঃশ্বাস
রুদ্ধ করেছি
ক্ষুদ্র শিখায় আমি বিকশিত হয়েছি
অন্তরের আলোকে আমি বিস্ফারিত করেছি
আঁধারে তাঁকে পেয়েছি আর তাঁকে যেতে
দিইনি
(৮)
দেহের কেন্দ্রে আছে জ্বলন্ত সূর্য
মাথার মুকুট বরফশীতল চন্দ্র
কোথা থেকে মৃদু জলধারা আসে
বলো ‘হু’ শীতল আর ‘হা’ গরম
(৯)
আমার আত্মা, আমি ধীরে কেঁদে যাবো
কারণ এই জগতকেই তুমি ভালোবাসো
তোমার সম্পদের ছায়াও স্থায়ী নয়
কী করে তুমি নিজেকে ভুলবে?
(১০)
আমার পিঠের চিনির ভার ঝুলে পড়েছে
আমার দেহ ধনুকের মতো বেঁকে গেছে।
আমি কী করে সহ্য করবো?
গুরুর বাণী ক্রন্দনরত ফোস্কার মতো
আঘাত করে
আমি মেষপালকহীন মেষের দল
কী করে সহ্য করবো?
(১১)
আমার মন নতুন, চাঁদ নতুন
জগতের সমুদ্রে সব নতুন দেখি
যেহেতু আমি দেহ আর আত্মাকে প্রক্ষালন
করেছি
আমি, লাল, চিরনবীন হয়ে বিরাজ করি।
(১২)
ভালোবাসায় তাড়িত আমি, লাল, ছিটকে
পড়েছি
রাতদিনের শেষ পর্যন্ত খুঁজে গেছি
তবে আমার ঘরেই আমি জ্ঞানীকে পেয়েছি
আমি সেই মুহূর্তকে জাপটে ধরেছি
- অনুগ্রাহী আমার তারারা!
[সূত্রঃ আমার গ্রন্থ ‘বিস্মৃতা অনন্যাঃ
যারা কাচের ছাদ মানেনি’।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন