মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি # চিলেকোঠার সেপাই




প্রতি,

পর্দা খুলতেই দেখা যায়, মঞ্চের উপর-নিচ দুই তল। বোঝা যাচ্ছে, কোনও বৃহৎ জায়গাকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে। আর তাই এভাবে অনেকগুলো জায়গাকে একই সহাবস্থানে আনতে চাওয়া হচ্ছে। এ তো চেনা ছক… মঞ্চভাবনার জন্যে। কিন্তু এরমধ্যে দিয়ে একটা গভীর তল তৈরি করে, সেই তলের মধ্যে আনমনা ব্যস্ততম দর্শকের মন টেনে ধরা শক্ত কাজ। নয় কি? তারমধ্যে দিয়ে যখন বিষয়টা একেবারে লঘু তো নয়! তো দর্শকের সাধারণ জ্ঞানের সঙ্গে পাল্লা দিতেই হবে।

কিছু প্যাকেটের খচরমচর শব্দে দর্শক আসনের আবহ। আজকাল তো সংলাপের সঙ্গে তাল রেখে বেজে ওঠে অথৈ মুষ্টিযন্ত্র। তাতে অভিনয় থামিয়ে যখন বলতে হয় - বাজিয়ে নিন বাজিয়ে নিন… তারপর তো থিয়েটার!

আর ততক্ষণে মঞ্চে আলোতে অভিনয়ে চিলেকোঠায় এক সেপাই। উঁচু থেকে মাপা পায়ে সংলাপে বোঝা যাচ্ছে না এই প্রযোজনার বয়স। ২৬ বছর আগে হয়েছিল। তারপর কল্যাণী নাট্যচর্চা দলের জন্মদিনে ফের হচ্ছে  চিলেকোঠার সেপাই। আমি কি ছাই জানতাম! এক থিয়েটার বিশেষজ্ঞ মনে করিয়ে দিলেন। তিনি আর কেউই নন আমাদের থিয়েটার দলের নির্দেশক সঞ্জীব রায়। বলেন, এটা দেখেননি? তাহলে তো সবটাই বৃথা। ঐ জীবনের ১৬ আনাই ফাঁকির মতন। তাই আগে থেকে আলাপ করে নিয়ে দেখতে আসা। সেকি কাণ্ড! আজকাল তো সেসব পেরিয়েই আসতে যেতে হয়।

সামনে সেলিব্রিটি রূপেন আবির্ভূত এক তারকা অভিনেতা। তাঁকে ঘিরে ফেলেছেন উপস্থিত একাডেমির সামনের জনগণ। আর যেহেতু টিকিট আজও কাউন্টার থেকেই নিই, তাই কাউন্টার এই কাউন্টার কতটা সইতে পারে বুঝতে চাইছিলাম।

হ্যাঁ, ভিড় সরে যেতেই আমরা যারা সরলাম না, তারাই তো থিয়েটার দেখতে আসিয়ে। যেমন করেই হোক ঐ চূড়ান্ত সম্মান-সরিয়ে যারা শুধুই থিয়েটার করেন – তাঁদের জন্যে আসি। আসতেই থাকি নিজেকে প্রসারিত শিক্ষায় রাখার জন্যে। কারণ, থিয়েটারের দীক্ষা তো আত্মগত। এর ভাবনা কোনও গুরুগৃহের প্রাকারে শুরু হয়নি। আবার যস্মিন দেশে যদাচার –এর ছোঁয়া বাঁচিয়েও চলতে থাকতে হয়। তো, এই থিয়েটারের জন্যে ঢুকতে গিয়ে এত…। তারপর যেই না জমিয়ে বসা, অমনি মশার শব্দের মতন পিনপিন করে কথালাপ, দর্শকের ধারণায় বোধহয় পাশের ব্যক্তিরা সব কালা। আর মঞ্চের ব্যাপারটা অভিনয় মাত্র।

কিন্তু কোন নাটকের অভিনয় জেনেছেন?

বললেন, না, এতো সময় নেই বাবা। আগেভাগেই বলি, আমি পড়ি খুব। কিন্তু এটা বাদ চলে গেছে।

কেন হে, হোম ওয়ার্ক করে যে আসার ব্যাপারটা? সেটা? সেটাও ভুলে গিয়েছেন হে দর্শক?

খুব দরকার… প্রশ্ন করলেন। এক ঢোক চা খেয়েনি। এই নিত্য থেকে অনিত্যের যাত্রায়।

তা, কার লেখা উপন্যাস বলুন তো?

সুনীলের?

না

শক্তি তো গল্প-টল্প লেখেন না।

না, ওনার শক্তিতে কুলায়নি হবে।

তবে?

এ তো বড় সাংঘাতিক  ব্যাপার।

ততক্ষণে মঞ্চে সাত-সাতটা সিন হয়ে গেল। মঞ্চের বিচিত্র মায়ায় অভিনেতাদের ওঠাবসা হল। না, মঞ্চে হতে থাকা থিয়েটারের কথা আর লিখতে পারছি কই?

যা দেখি তাই লিখি।

যা লিখি তাইই দেখি।

ওপাশে কথার সঙ্গে প্লাস্টিকের খচলচ আর মচমচ।

কিন্তু এটুক জেনে আসা তো সম্ভব ছিল মাননীয় দর্শকের পক্ষে – নাটকের বিষয়বস্তুটি। সেটা জানতে আবার উপন্যাস পড়তে হবে। একটা থিয়েটার দেখার জন্যে এত ঝক্কি? পোষায়? একে তো থিয়েটার তায় হলের ঐ হাল। তায় পড়ালেখা করে আসতে হবে – তারচেয়ে সপ্তাহান্তের ছুটি সময়টা লঘুমাত্রায় পপকর্নের সঙ্গে হোক না? মন্দ কি? এইজন্যেই তো থিয়েটার থেকে লোক পালায়? সারা সপ্তাহ পেশাযুদ্ধের পর – ফের যদি বলে পড় পড়। কোন মানুষে মেনে নেবে?

আর তাতে আনন্দ বলে কিছু থাকে? বিনোদন ভেবে আসা দর্শকের জন্যে এই থিয়েটার নয়। চিলে কোঠার সেপাই বুঝতে গেলে, আগে টেক্সট পড়ে আসতে হবে।

বটেই তো, দর্শকের রুচি যখন থিয়েটারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাইভ লোকেশন শেয়ার করে থিয়েটার দেখতে এসেছি, তখন চ্যালেঞ্জ তো বটেই। তাও চেষ্টা নিচের ভাগের নিচের তলে খোপ খোপ সেখানে লাগানো ঐ যে রঙিন কাপড়। আর একেবারে উপরে, চিলে কোঠায়? ওসমান? তাই হবে। প্লট অনুসারে তো তাই।

ঐ অন্ত্যজ শ্রেণি। আর তারমধ্যে যে ভাগগুলো করা হয়েছে – যা এই মানুষগুলোর মনের রঙ বোঝায়। যারা লোকের বাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বাঁচে, ধার করে বাঁচে। কিন্তু ওদের জীবনের আনন্দ কম নয়। মঞ্চের উপরে দুই ভাগ। যখন ২৬ বছর আগে এই চরিত্র করা হয়, তখন যুবক ওসমান।

কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আত্মপ্রকাশ করেছিল এই প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন দিয়েই। বলতেই হবে সাহস লাগে তো এমন একটি প্রযোজনা নিয়ে থিয়েটার শুরু করতে! তারিখ ১৯৯৭ সালের ১৭ নভেম্বর। চিলেকোঠায় দেখা ওসমান তখন যুবক। আজকের দিনে তিনি আরেকটু পরিণত হয়েছেন। কিন্তু চরিত্রের জন্যে বয়সের দাবি? হ্যাঁ, তাই তো মেকআপ আর্টিস্ট… তার দক্ষতা দেখিয়েছেন।

ঠিক, দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না যে…। শুনেই হেসে ফেললেন। ওটাই তো ম্যাজিক। গোটা দলের সঙ্গে কেমন মানিয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, এটাই তো ব্যাপার। নির্মাণের মধ্যে অভিনেতার আত্মনির্মাণ।

নিজেকে সেই চরিত্রে কেমন লাগছিল?

ওসমান আদপে অন্তর্মুখী চরিত্র। যে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। অসম্ভব একটা ব্যাপার। আপনি করলেন। সেই হাতনাড়া। বিড়বিড় করা। একটু কুঁজো হয়ে ঝুঁকে কি যেন চেষ্টা ওসমানকে দর্শকের কাছে তুলে ধরার। আপনি করেছেন সেটা। এত দীর্ঘ চেহারায় কীভাবে ওই বিষয়টায় মিলিয়ে দিলেন? এবং একবারও তো মনে হল না যে আপনি অভিনয় করছেন! অথচ ২৬ বছর…। কম তো নয়। এক মহৎ উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া। সেটা অভিনয় করার জন্যে বড় টিম ওয়ার্ক। এই যে চ্যালেঞ্জ… বড় টিম নিয়ে কাজ করা। সঙ্গে কি বিশাল সেট, মানে মঞ্চসজ্জা। হ্যাঁ, তারই প্রতিক্রিয়া নিতে বার্তালাপ।

দলের তরফে অভিনেতা নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্তের প্রতিক্রিয়া নিই। তিনি জানান যে, ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত নিয়মিত চলেছে প্রযোজনাটি। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, অন্যের রাজ্যেও অভিনয় হয়েছে। ২০২৩ সালের এই প্রযোজনা হল নাটকের পুনর্নির্মাণ।

ভাগ্যিস এবারে দলের জন্মদিনে একাডেমিতে এই নাটক দেখার সুযোগ হল! আগেই বললাম … কী কী করে হল। যেখানে ১৮টি চরিত্র। দলের ৩ জন পুরনো প্রোডাকশনের সঙ্গে বাকি নতুন ১৫ জনের টিম। নবীকৃত  প্রযোজনাটির অভিনয় ২৫ জুন ২০২৩, রবিবার সন্ধে ৬-৩০ একাডেমি প্রেক্ষাগৃহে।




যে দর্শক উপন্যাসটি না-পড়ে এসেছেন তার কথা থাক। যা পড়ার তা হল গিয়ে, মূল উপন্যাস লিখেছেন প্রখ্যাত লেখক আখরোজ্জামান ইলিয়াস। প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের। মূলত ১৯৬৮-৬৯ সাল। যখন বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল। নাটকের স্ক্রিপ্ট বা নাট্যরূপ দিয়েছিলেন সমীর দাশগুপ্ত। তিনি প্রয়াত। মঞ্চে নগরকেন্দ্রিক আন্দোলনের দিকেই আলোকপাত করা হয়েছে।  উপন্যাসের গতি, তার চরিত্র দিয়ে আন্দোলনের যে গতি, তাই বজায় রাখতে নাটক। একইভাবে সেই গতিই রাখা হয়। মধ্যবিত্ত দোলাচল, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, অতি বাম-আন্দোলন থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির আন্দোলন পর্যন্ত এই বিস্তার। একদিকে খিজির, মজলুদের জীবনের লড়াই। অন্যদিকে মঞ্চে একাই সেপাই চিলেকোঠা থেকে নেমে আসা ওসমান। নেমে আসা মানে, ওই যে দুই তল উল্লেখ করেছি। সেটাই। ওসমান থাকে চিলেকোঠায়। আর মঞ্চের নিচের তলে আরও চরিত্ররা। একদিকে শহরকেন্দ্রিক যে  আন্দোলনে ওসমান, খিজিরদের মতন প্রলেতারিয়েত বর্গের প্রতীকরা। অন্যদিকে, গ্রামবাংলার খিজির, এবং তার সমগোত্রীয় চরিত্র চেংটু চরিত্র। একদিকে আনোয়ার যে কিনা অতি বামপন্থী। এবং গ্রামে যাচ্ছে পার্টির নির্দেশে আন্দোলন সংগঠিত করতে। এই যে নগর থেকে একজন লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত মানুষ গ্রামে গিয়ে আন্দোলন করার সুবাদে আনোয়ার চেংটু একত্রিত হয়। বা খাইবার গাজির মতন রহমতুল্লা চরিত্রেরা আরেকদিকে।

হ্যাঁ, এভাবে লিখে গেলে লিখতেই পারা যায়। কিন্তু পাঠকের জন্যে লেখা তো! তাই, পাঠকের জন্যে সহজ করে দেওয়া যে, মুক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই নাটক। একদিকে বাংলাদেশের ৫০ বছর, আর ভারতের ৭৫ বছর। হ্যাঁ, তাই তো মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে খিজিরদের কথা ভাবতেই হয়। কতটা মুক্তি পেয়েছে খিজিরের দল। যা নাট্যরূপ তাতে তো অনেক অনুচ্চারিত কথাই অভিনেতার বুঝিয়ে দেওয়ার দায়। নাটকের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। যেমন, সময়ের সীমাবদ্ধতা। মোটামুটিভাবে নাটক দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করতে হবে। আগে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার হত, এখন তেমন করলে চলবে না।

হ্যাঁ, ফের এখনের কথায় আসতে হবে।

এখন অর্থাৎ ২০২৩ সালে যিনি খিজির করছেন, তিনি পুরোপুরি এদেশের লোক। মানে আগে যিনি অভিনয় করতেন তিনি বাংলাদেশের? জানা গেল, এর আগের যাঁরা করছিলেন তাঁদের উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার সূত্র ছিল। এখনের খিজির এপারের বেড়ে ওঠা শিল্পী। কিন্তু শিল্পী মানে দুর্দান্ত করেছেন তো? বোঝার উপায় নেই তিনি যে শুধুই ভাষা-শব্দ উচ্চারণ রপ্ত করেছেন। নিখুঁত অভিনয়। আর যা বাকি রইল, তা পরের সংখ্যায় লেখা যাবে।

 _ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী

 

 

 


১২টি মন্তব্য:

  1. Prothom dikta...theatre gamider sobhab nie besh alochona kora hoyeche.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হে নামহীন, শুভেচ্ছা জানবেন। থিয়েটার দেখতে আসুন আগামিতে। আলাপ হবে...✍️

      মুছুন
  2. হে নামহীন... শুভেচছা অপরিসীম

    উত্তরমুছুন
  3. বাহ্।। লেখনশৈলীটা খুব ভাল লাগলো। থিয়েটারের গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যাপারটা যাঁরা হালকাভাবে নেন, তাঁদেরকে ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা অসাধারণ।।

    উত্তরমুছুন
  4. শৌভিক... প্রীত হলেম। ফিজিক্স টু থিয়েটার __ হ্যাটস অফ বন্ধু...🍁

    উত্তরমুছুন

  5. আখরোজ্জামান নামটা ভুল আছে।
    --সবুজ

    উত্তরমুছুন
  6. তবে... কি লিখতে হবে জানালে বাধিত হই

    উত্তরমুছুন
  7. The review of the play performance exudes positivity, skillfully highlighting the actors' compelling performances and the seamless execution of the production. Mou's(The reviewer) enthusiasm is contagious , making it an engaging read that leaves readers excited to experience the play for themselves.

    উত্তরমুছুন
  8. Apurbo lekhati...adhunik juger oti adhunik dorshok jara kina Theatre dekhte ese live location share kore fb te, tader chehara ta lekhika chomotkar tule dhorechen. Sotti thetre gami dorshok dero eta kortyobbyo je theatre ti dekhte esechen, sombhob hole setir mul lekhati pore asun. Choritro guli chokh er samne bhasbe.

    উত্তরমুছুন