মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল



 

(৪০)     

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল লিপিকা। এই বিকেলবেলায় অনেক কুকুর বেড়াতে বেরোয়। দামী ব্রিডের কুকুর বেশীর ভাগ, বড়সড় স্বাস্থ্যবান বা ঝুমঝুমে লোমওয়ালা খেলনার মতো দেখতে। গলায় বাঁধা সুদৃশ্য বকলস্‌ ভাড়া-করা ডগ্-ট্রেনার ছেলেটির হাতে। এও এক নতুন ধরনের চাকরি। মালিকের হয়তো সময় নেই, তাই এই বন্দোবস্ত। শহর জুড়ে পশুপ্রেমী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

তাদের ছোটোবেলায় দুপুরশেষে সদরের গেটের সামনে গোটাতিন কুকুর আসত। চারপাঁচটা বেড়াল এসে দাঁড়াত একেবারে টিউবওয়েলের পাশে। গায়ত্রী সকলের পাতের উচ্ছিষ্ট জড়ো করে রাখতেন। সঙ্গে আরও ভাত-তরকারি, মাছ-টাছ মেখে আলাদা-আলাদা দলা খেতে দিতেন। কুকুরেরা অল্পেই খুশী, লেজ নাড়ত। বেড়ালের চাহিদা বেশী, চেটেপুটে খেয়েও ডাকতেই থাকত। তখন গায়ত্রী জল ছেটাতেন, ওরা লেজ তুলে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাত। পাড়ার প্রায় সব বাড়িতেই এমনি করে খাবার পেত এরা। পেট ভরা থাকত, কোথাও ছায়া খুঁজে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকত। সত্যসাধনের পশুপ্রীতি ছিলনা যদিও বাধা দেননি কখনও। এক ধনী আত্মীয়ের পোষা দুটো বিদেশী কুকুর ছিল। সত্যসাধন বলতেন, ‘বড়লোকের পিত্‌লা শখ। কবেকার কথা, কত সামান্য ঘটনা। তবু মনে রয়ে গেছে। হঠাৎ সম্বিত ফেরে, সেও শোভনের মতো একই পথে হাঁটছে। শৈশব আর শৈশবস্মৃতি। ভালো নয় এসব। ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সে ঘরে ঢোকে। অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করা হয়নি ক-সপ্তাহ হল যেন। বয়স হচ্ছে, কাজ করতে কুঁড়েমি লাগে। সলমনের দিকে নজর দেওয়া হয়নি। বয়স হয়েছে তার, ক-দিন আর বাঁচবে কে জানে! লিপিকা কাচের বাক্সের সামনে এসে বসে পড়ে। বাক্সের গায়ে হাত বোলায়। এর চেয়ে বেশী আর কিছু করা যায়না। তার আঙ্গুলের ছায়া দেখে সলমন এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। বাকিরাও কাছাকাছি এসে ঘুরে যায়, হয়ত খাদ্যই ভাবে। বুকের মধ্যে মায়ার ঘূর্ণি। ইচ্ছে করে জল থেকে তুলে নিয়ে আদর করে। ভাবে, ঝুমঝুম লোমওয়ালা ছোট্ট কুকুর থাকলে চমৎকার হয়! নরম সাহচর্যের জন্য বুকের মধ্যেটা আকুল হয়ে ওঠে। বিগত যুগে মেয়েরা তার বয়সে ঠাকুমা-দিদিমাএকঝাঁক কচিমুখের আদর-আবদার, খেলা, বায়নাভারিক্কি গৃহিনী ভরা সংসার নিয়ে সব সময়ে ব্যস্ত বিব্রত। কোনও কারণ ছাড়া আজকাল শূন্যতা ঘিরে ধরে।

দিন বয়ে যায়। ক্রমশঃ ঝিমিয়ে আসছে শোভন, স্বভাববিরুদ্ধভাবে বিরক্ত হয় আজকাল অকারণে। ছবি আঁকার আগ্রহ আছে, কিন্তু খানিক পরেই খাতা পেন্সিল সরিয়ে বলে,

আর ভালো লাগছে না।

তারপর শুয়ে থাকে জানালার বাইরে তাকিয়ে। চোখে বা মনে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কী কী রঙ যাতায়াত করে সে নিজেও বুঝতে পারে না। আগে অনেক সময় ধরে খবরের কাগজ উলটে-পালটে পড়ত। আজকাল তাও নয়। এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে প্রায় আনমনেই শ্রুতির নম্বরে কল্‌ করে লিপিকা। আগে নিজে থেকে কখনও করেনি। ফোন বেজে বেজে থেমে যায়, শ্রুতি ধরে না। লিপিকার মনে হয়, ভালোই হয়েছে। কিন্তু মিনিটদশ পরে কল্‌ আসে। বুঝি চিন্তিত স্বর মেয়ের,

ভালো আছো তোমরা? কী হয়েছে গো?”

না না কী হবে? এমনিই। তুই ব্যস্ত এখন? অসুবিধে হল?”

না তেমন কিছু না। একটা কল্‌ ছিল। আবার ঘন্টাখানেক পরে হয়ত একটা বলো!”

লিপিকা চুপ করে থাকে, কী বলার আছে ভেবে পায় না। কথা গুছোয় মনে মনে। বলে,

কবে আসবি তুই আবার?”

ঠিক নেই গো কিছু।

দেবার্ঘ্য যাচ্ছে তা হলে?”

তাও জানি না।

শ্রুতি হাসে, লিপিকা হাসে, কথা ফুরিয়ে যায়। কী যেন বলবে ভাবে লিপিকা অথচ বলে উঠতে পারে না। একটু অপেক্ষা করে মামপি বলে,

রাখি তাহলে?”

হ্যাঁ হ্যাঁ। ও আচ্ছা শোন,”

বলো?”

কঙ্কন নিবি না কান-গলার সেট্‌? ডিসকাউন্ট শুরু হবে দেখছিলাম। কিনে রেখে দেবো। যা দাম হয়েছে সোনার!”

মামপি থতমত খেয়ে চুপ করে যায়। দেবিকা কি কিছু বলেছে ইতিমধ্যে? কিন্তু তার মাসির গলায় স্নেহের সুর,

পরে ভেবে বলিস, যেটা তোর পছন্দ। আচ্ছা শোন,”

বলো?”

মামপি একটা ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিতোর মেশোর আঁকা ছবিগুলো দেখেছিলি গতবার এসে?”

হ্যাঁ। খুবখুবঅন্যরকমযেন আসল একদম! গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল আমার। খাতা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

তাই না? ওটাই ভাবছিলাম, কার কাছে জানতে চাই?”

আর দু-চার কথার পর ফোন বন্ধ করে লিপিকা। মামপি ল্যাপটপ খুলে বসে, মেইল এসেছে কয়েকটা। শর্ট-লিস্ট করতে হবে। কাজ করতে করতে শোভনের আঁকা ছবিগুলো মনে পড়ে। এর আগেও পড়েছে বহুবার। কাউকে সে বলেনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া হয়েছে। মনে হয়েছে, ছবির মানুষগুলো নড়ে-চড়ে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতা নড়ছে। মেশোর বাড়ির কাউকে সে চেনে না, তাই মুখগুলো অস্পষ্ট কিন্তু ভীষণ জীবন্ত। এরকম অদ্ভুত ঘটনা কোনওদিন ঘটতে পারে, সে ধারণা করতে পারেনি। ভয়ে খাতা বন্ধ করে মেশোর পাশে রঙের বাক্স চাপা দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। তখন শোভন কথা বলতে বলতে শিশুর সারল্যমাখা মুখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মামপি এবারে কথাপ্রসঙ্গে একটু আভাস দিয়েছে, শোভনকে কাউন্সলিং করিয়ে নিতে। লিপিকা আগেও ভেবেছে কতবার, ডাক্তারের পরামর্শও নিয়েছে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। স্থান-পরিবর্তনে কতটা এগিয়ে ভাবতে শিখেছে মেয়ে, স্মার্ট, গ্লোবালাইজড, আপডেটেড হয়ে উঠেছে। হয়ত এরা নিজেও করিয়েছে বা করায়, তাই এত অনায়াসে বলতে পারে। একটা ফোন নম্বর দিয়েছে, অনলাইনে কয়েকটা সেশন নেবেন মহিলা। নেট খুলে লিপিকা দেখছিল, ভালো রেটিং অর্থাৎ সুনাম আছে। শোভনকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে সে। শোভন বিস্মিত,

কেন? কী হয়েছে আমার?”

কী আবার হবে? যেগুলো আমাকে বলতে পারো না সেগুলো বলবে মানে ডাক্তারকে। মন হাল্কা হবে”

তোমাকে যা বলতে পারি না? ওঃ!”

থেমে গিয়েছিল শোভন, গলায় বিরক্তি। খানিক পরে ঠাণ্ডাভাবে বলেছিল,

বেশতো তুমি যা ঠিক মনে করছ, তাই হোক।

লিপিকা অস্বস্তিতে পড়েছিল। আলাপচারিতা একান্তে হয়, শুধু রোগী আর থেরাপিস্টের সেশন। কিন্তু শোভন কি রোগী? সে এলোমেলো ভাবছিল, হঠাৎ অত্যন্ত সহজ গলায় শোভন বলল,

তুমিও থেকো।

না না, ওরকম হয় না। নিয়মবিরুদ্ধ।

নিয়ম আবার কিসের? আমি নিজেই চাইছিওনাকে জানিয়ে দেবো।

না।

লিপিকা নীরবে মাথা নাড়ে, কিছু বলে না। কেমন হেরে যাওয়ার অনুভূতি হয়। আসল কথা সে নিজেও অস্থির হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে।

শুরুতে সপ্তাহে দুদিন করে একঘন্টার সেশন, পরে দরকারমতো সময় বাড়ানো বা কমানো হবে। লিপিকা লিভিংরুমে গিয়ে বসে, মাথার মধ্যেটা খালি। টিভি চালিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেশব্দ বন্ধ করে মানুষের ঠোঁট নাড়া দেখে যায়। সেশন শেষ হওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শোভন, মাথায়, কপালে ঘাম। লিপিকা মনোযোগ না দেওয়ার ভান করে উৎসুক হয়ে থাকে। শোভন মুখোমুখি এসে বসে। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে লিপিকার দিকে। বলে,

আমার তো কিছু হয়নি। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করবে?”

সামান্য কেঁপে ওঠে লিপিকা,

কথা হয়েছে?”

হ্যাঁ। এমন কিছু নেই যা তোমাকে জানাই নি।

কী বললে থেরাপিস্টকে?”

আসলে অনেক সময়ে যেদিকে গাড়ি চলে তার উলটোদিকের সীটে বসতে হয়। মানে গাড়ি সামনে এগোচ্ছে, যাত্রী সামনে না দেখে দেখছে যে রাস্তা অলি-গলি সে ফেলে আসছে। বড় অস্বস্তিকর সেটা, বরং ফিউচার দেখার চেষ্টা করা ভালো। বুঝতে পারছ?”

লিপিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসে শোভন। বলে,

ছেলের সঙ্গে কথা হয়? কল্‌ করলে আমাকেও দিয়ো।

হয়েছে দুদিন আগে। এয়ার পল্যুশন বাড়া শুরু হয়েছে বলছিল, যেমন প্রত্যেক বছর হয়।

 

(ক্রমশঃ)

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন