শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মনীষা মুখোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


ম্যাট ফিনিশ শিফন

ফ্ল্যাশব্যাক

বিটি রোডে কয়েকশ’ বিঘা জমির উপর জমিয়ে কমপ্লেক্স গড়েছেন সুকুমার সমাজপতি। পদবিতেই সমাজের ধার-ভার বয়ে বেড়ানোর একটা ইয়ে আছে দেখে কেরিয়ার বলতে টুকটাক রাজনীতি আর প্রোমোটারি ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। ওঁর গলা সরু, মানে আওয়াজে ক্ষীণ যাকে বলে। এই গলা নিয়ে রাজনীতিতে প্রায় কিস্যুই হবে না বুঝে মানে মানে প্রোমোটারিই বেছে নিয়েছেন। তবে সুকুমার বেশ নিরামিষ প্রোমোটার। মানে, গুন্ডা-মস্তান সেভাবে পোষা নেই। নিজেরও গায়ের জোর মধ্যবিত্তের গুলি ফোলানো অবধি। আছে বলতে রাজনীতির চেনাজানাটা। তাই কাজের ফোয়ারা না ছুটলেও ফ্লো মোটের উপর ভালোই। অঞ্চলে প্রায় চার-পাঁচটা প্রোজেক্টই সমাজপতির। বাইশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন রবীন্দ্রনাথের বইয়ের নামে নাম রাখলে বাঙালি সে অ্যাপার্টমেন্ট প্রথমবার দেখেই পছন্দ করে ফেলে। তাই সমাজপতি কখনও এই উইনিং কম্বিনেশন ভাঙেননি। শুধু একবারই গঙ্গার ধারের অ্যাপার্টমেন্টের নাম ‘চোখের বালি’ রাখায় ছেলে বুকাই খুব হ্যাটা করেছিল। আজকালকার ছেলেপুলে, এমনিতেই মুখের ছিরিছাঁদ নেই, তায় আবার দু’কলম লেখাপড়া জানা হলে তো আর রক্ষে নেই। সদ্য কলেজে ঢোকা ছেলে বাপের মুখের উপর বলে দিল, ‘প্লিজ বাবা, এবার ক্ষ্যামা দাও। ওঁর দেওয়া এত নাম তুমি ঝেঁপেছ জানলে লোকটা স্বপ্নে এসেও রয়্যালটি চাইবেন!’ তারপর মুখটাকে অনেকটা কমল মিত্তিরের মতো করে একটা ছোঃ-সুলভ হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘চোখের বালি মানে জানো?’

হুঁ! কোথায় বাপের পাশে দাঁড়াবে তা নয়, মশকরা করছে। আর চোখের বালি মানে না জানার কী আছে অ্যাঁ? চোখে বালি ঢুকলে একটু কড়কড় করে ঠিকই কিন্তু গঙ্গার ধারে বাড়ি হলে মৃদুমন্দ হাওয়াও তো ঢোকে। সঙ্গে একটুআধটু বালি তো উড়বেই। চোখে কী পড়ে গেল দেখতেই তো বাড়ির লোক দৌড়ে আসবে। তারপর রুমালের কোণ দিয়ে আলতো করে বের করে দেবে। তবেই না রোমান্স! গঙ্গার ধারে অ্যাপার্টমেন্ট বলেই না ওই বালি-কাঁকড় আছে এমন একটা নাম ভেবেছিলেন সমাজপতি! কেমন একটা প্র্যাকটিক্যাল লাইফের সঙ্গে মিলজুল আছে নামটায়। তা আজকালকার ছেলেরা এসব বুঝলে তো! দুম করে ক’টা কথা শুনিয়ে দিল। নাহ্! এই জেনারেশনটাই এমন। নইলে কি আর বলাকা কমপ্লেক্সের পুজোয় আঁশ ঢোকে!

জাম্পকাট

এ’বছর বলাকা কমপ্লেক্সের পুজোর ১০ বছরে পা। এই কমপ্লেক্সেই সমাজপতির একটা নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। একটা কমপ্লেক্সে বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় গোটা তিরিশেক অ্যাপার্টমেন্ট। ১০ বছরে এবার গ্র্যান্ড ফিস্টি। নতুন নতুন নানা ধূমধড়াক্কার সঙ্গে ছেলেছোকরাদের বায়নাও ঠাঁই পেয়েছে। যদিও এই বায়নায় শিলমোহর লাগানোয় সমাজপতির ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু হলে কী হয়! ইতিহাস বারবার দেখিয়ে এসেছে, হেভিওয়েট শত্রু সর্বদা নিজের ঘরেই জন্মায়। নইলে কী আর এই বায়নাক্কাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় বুকাই! বাবা হয়ে সমাজপতির এ শোক কি জীবনে ভোলার!

বলাকা-র ‘ইয়ং বুলেটস’ ফুঁসছে। প্রত্যেকবার ধুয়ো তুলেও যে কাজ তারা সেরে উঠতে পারে না, বুকাই এবার একাই প্রায় সে কাজ মেরে এনেছে। ওদের পুজো ঘোরতর নিরামিষ। নবমীতে মা সামান্য মাছ-ভাত পেলেও মায়ের ভক্তদের খিচুড়ি-লাবড়া, খুব বেশি হলে পোলাও আলুর দমে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে বুকাই একাই প্রায় অষ্টমীতে ওদের ভোগশীল সংস্কৃতির সঙ্গে এবছর নবমীতে ভাতের সঙ্গে মাছ-মাংসকে বলাকার ফিস্টির তালিকায় নয়া এন্ট্রি দিয়ে দিয়েছে। আর যে সে এন্ট্রি নয়, রীতিমতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ৮২ শতাংশ ভোট পেয়ে মাংস-ভাতের কপালে শিকে ছিঁড়েছে। যদিও এর পুরো ক্রেডিটই এবারের ইয়ং বুলেটসের। তারা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, পুজোয় বড়রা সেক্রেটারি-প্রেসিডেন্ট সব মেনে নিলাম। কিন্তু মাংস-ভাত ছাড়া এবারের পুজোয় গেট টুগেদার মানছি না-মানব না। বিশেষ করে বুকাই। মাংস-ভাতকে জেতাতে এবার কয়েক ডজন ছাপ্পা ভোটও দিয়েছে ও। ওদের দলটা এবার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, খিচুড়ির উপর মেইনলি কাঙালিভোজন আর বন্যাত্রাণের কপিরাইট আছে। তাই ওসব ছেড়ে মাছের সঙ্গে এবার স্ট্রেট মাংস-ভাত! ‘আরে বাবা পাশের পাড়ার কমপ্লেক্সের কাছে এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু তো নাকি! আর ছোটদের মানসম্মান নেই বলে কি প্রেস্টিজও নেই নাকি! আমাদের দাবি মানতে হবে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’— যুবশক্তিকে তাতাতে ও মাংস-ভাতকে জেতাতে ওদের গোপন বৈঠকে অমাইক গলায় এসবই বলেছিল বুকাই। অবশেষে বাকিরা বিষয়টা মেনে নিলেও ব্যানার্জি দাদু আর সেন জ্যেঠুর ফোঁস ফোঁস দীর্ঘশ্বাস এখনও বুকাইদের কানে লাগে। ব্যানার্জিদাদু তো ওদের দেখলেই শোকসভা করেন, ‘ম্লেচ্ছ ম্লেচ্ছ হয়ে গেল গো সব! শেষে পুজোগণ্ডার দিনে আমিষ ঢোকালে!’

বুকাইয়ের বাবাও অবশ্য বিষয়টা বিশেষ ভাল চোখে দেখেননি, তবে বুকাইয়ের ইন্টেলেকচুয়াল জেশ্চারের সামনে খুব বেশি মুখ খোলেনি। বিশ্বস্ত সূত্রে খবর, যতবার এই নিয়ে সুকুমার ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছেন ততবারই পাড়ার পুজো নেহাতই বালখিল্য ব্যাপার — এমন একটা ভাব করে ফোনে সলমন রুশদির উপর হামলা, চিনের রণনীতি আর গুন্টার গ্রাসের কবিতা নিয়ে এমন সব আলোচনা শুরু করেছে যে সমাজপতি মানে মানে চুপ মেরেছেন। তবে ছেলে বুকাইয়ের ফোনের ও প্রান্তে আদৌ কেউ ছিল কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে বুকাইয়ের বাবার।

লং-শট

ষষ্ঠীর সকাল। বোধন হয়েছে সদ্য। বিগ্রহের চারপাশ জুড়ে এখন অ্যাপার্টমেন্টের মা-কাকিমারাদের ভিড়। এবার পুজোয় কার কী প্ল্যানিং এসবের ফাইনাল টাচ চলছে। কার কোন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং কী হল, কে আজও একবার পার্লারে ঢুঁ মারবে, কার বাড়িতে বাপেরবাড়ির কে কে এল, তাদের এবার কোথাকার ঠাকুর দেখাবে, অষ্টমীতে বোমকাই না কি পাতলিপল্লু কোনটা জোরদার হবে — এসব গল্পগাছায় জায়গাটা ভরে আছে। মোটামুটি ওই এক ভিড়েই পুজোর তিনশো-ষাট ডিগ্রি কভার। একটু দূরে ধুতির কোঁচা সামলাতে সামলাতে ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে সন্ধিপুজোর সময় আর উপচার নিয়ে আলোচনায় মেতে আছেন সমাজপতিদের গ্রুপটা, মানে বাবা-জ্যাঠাদের দল। কালকেই ঠাকুর এনে দিয়েছে বুকাইরা। আজ সকালটা তাই ওদের একটু রেহাই। চাঁদাটাঁদা তোলা শেষ, বিকেলে একসময়ে গিয়ে বিলবইটা ব্যানার্জি দাদুর কাছে জমা দিয়ে আসতে হবে। পুজোর সময় এই অ্যাপার্টমেন্টের সকলেই কলকাতায় থাকে, খুব একটা বাইরে বেড়াতে যায় না। তবে দু’-একটি পরিবার এবার নেই। হঠাৎই পুজোয় বেড়ানোর হুজুগে ধাঁ। তবে এবার একটা পরিবার এখানে নতুন এসেছেও। আর এই আসাটাই বুকাইদের কাছে একটা ইভেন্ট। তাই এবারের পুজোটা ওদের কাছে একটা ইয়ে ব্যাপার আর কী!

প্যান্ডেলের কাছেই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা চেয়ারে দেদার গজল্লা চলছে তিমির, বুকাই, তোতন, শমীকদের। হঠাৎ বোঁ করে এক চক্কর ঘুরে বুকাইয়ের সামনে এসে দাঁড়াল ভোম্বল।

‘এই আসছে, আসছে ওই দ্যাখ...।’

কে আসছে, কেন আসছে তা জানতে চাওয়ার ফুরসতই পেল না বুকাই। বরং, তার আগেই আর্মির ফার্স্ট ম্যানের মতো স্ট্যাচু হয়ে গেল। এ কী জ্বালা! এখনই আসতে হল! ইশ্ বেরনোর সময় মা কতবার বলল, মামার দেওয়া শর্ট ঝুল পাঞ্জাবিটা পরে বেরো। তখন বেশি কেতা দেখিয়ে ‘ক্যাজুয়াল ইমেজই এবার পুজোর ইন’– জাতীয় বাক্যি ঝেড়ে তাপ্পিমারা বারমুডা বাছল। লাও এবার ঠ্যালা সামলাও। আর কী মেয়ে রে বাবা! আসার কোনও টাইমজ্ঞান নেই!

সটান ওদের সামনে এসে সদ্য পাটভাঙা তাঁতের শাড়ির খুঁটটা কায়দা করে দু’আঙুলে চেপে কেটে কেটে বলল শ্রীময়ী, ‘যারা মাংস খায় না, নবমীতে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা?’

দু’মাস আগেই এই কমপ্লেক্সের তিন নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট কিনেছেন শ্রীময়ীর বাবা। বুকাইদের ফ্ল্যাটের জানলা থেকে একটু তেরচা তাকালে ওদের জানলাটা দেখা যায়। আর কারা যেন বলছিল, বুকাই দিন দিন ট্যারা হয়ে যাচ্ছে! প্রশ্নটা মাথায় গাঁথতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল বুকাই। তার আগেই তিমির ওর হয়ে ব্যাট ধরেছে, ‘কেন আপনি মাংস খান না বুঝি?’ তিমিরকে ঝলক দেখে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে শ্রীময়ী বলল, ‘আমি রেড মিট খাই না। ওতে ফ্যাট হয়। আর শুনলাম ওটাই নাকি হচ্ছে?’ ভোম্বলের ঠোঁটের ডগায় এসে গিয়েছিল, এঃ! ক্যাটরিনা কাইফ এলেন রে! একদিন রেড মিট খেলে উনি মোটা হয়ে যাবেন। কেন খেয়ে উঠেই র‍্যাম্পে হাঁটতে যাবেন বুঝি?— তবু বুকাইয়ের মুখ চেয়ে এসব গিলে বলল, ‘ইয়ে... মাছ থাকবে তো মাছ। ভাল মাছ থাকবে। আর ওটা ওই সাম্যময়, মানে আমাদের বুকাই আনতে যাবে।’

‘কে আনতে যাবে সেটা বড় কথা নয়। মেনুতে মাছ থাকবে কি না সেটা ইম্পর্ট্যান্ট। আর শুনুন, সাম্যময় না বুকাই কী একটা বললেন, ও কে? সে কি এই কমপ্লেক্সের বাজারসরকার নাকি?’

সামনেই কোথাও বিস্ফোরণ হল যেন। বুকাইয়ের পা দুটো গেঁথে দিয়েছে কেউ মাটিতে। শেষে জয়েন্ট অমন মারকাটারি র‍্যাঙ্ক পেয়ে যাদবপুরে বি টেক-এ ভর্তি হয়ে এই স্টেটাস! যদিও বুকাই কে — সে উত্তরের তোয়াক্কা না করেই শ্রীময়ী ততক্ষণে হাঁটা লাগিয়েছে। বুকাইয়ের সব রাগ গিয়ে পড়ল ভোম্বলের উপর।

‘এই শোন, তোকে না শালা বোকা বললেও অর্ধেক বলা হয়। আমি মাছ আনব তোকে কে বিগলিত হয়ে বলতে বলেছিল?’

‘আহ্, ছাড় না বুকাই, জানিসই তো ভোম্বলটা একটু বেশি কথা বলে। কিন্তু এ তো কেলো রে! যার জন্য এত মিটিং-মিছিল করে, বক্তিমে ঝেড়ে পুজোয় বিপ্লব ঢোকানোর ব্যবস্থা করলি সে-ই তো দেখছি, ‘রেড মিট খাই না’, বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল!’ শমীকের গলায় উদ্বেগ থাকলেও কোথায় যেন একটা হালকা ঠাট্টাও রয়েছে। বুকাইয়ের কপালটাই এমন। ভাবে এক আর হয় আর এক। এই যে এত চিৎকার চেঁচামেচি করে প্রায় গৃহকাম এলাকাযুদ্ধ করে নবমীর মাংস-ভাতটা এন্ট্রি করল, তা তো ওই মেয়ের জন্যই। আর শেষে কি না সেই ভাসিয়ে দিয়ে গেল!

কিন্তু শমীকের কথাটাকেও ফেলে দিলে চলবে না। ঠিকই তো, মাংস-ভাত না হলে তো অষ্টমীর খিচুড়ি ভোগেই খাওয়ার পাট চুকত। স্রেফ মেয়েটার সেদিনের ওই কথাটুকুর জন্যই কি না এত লড়ে গেল বুকাই!

‘কী করব বল, সেদিন বলল যে, খিচুড়ি নাকি সাফোকেটিং! তাই তো ভাবলাম...!’ এটা বলার সময় মুখটা একটুও করুণ করতে চায়নি বুকাই, তবু কথাটা বলার সময় কেন যে ওরকমই দেখাল কে জানে!

‘এহ্, ইল্লি রে! খুব তো আমার উপর চোটপাট করছিলি, তা তোর কানে কানে এসে বলেছিল বুঝি!’ মওকা বুঝে ভোম্বলও একটা ইয়র্কার হাঁকড়াল।

ধাঁ করে মাথা গরম হল বুকাইয়ের। ভোম্বলের উপর এমনিই চটে আছে। ‘কানে কানে কেন বলবে রে? দিন কুড়ি আগে আমি আর শমী একটু বেড়িয়েছিলাম, একেই জিজ্ঞেস কর না, শুনেছে কি না। কী রে শমী, বল!’

বুকাইয়ের কনুইয়ের খোঁচাটা পাস হতেই ময়দানে নেমে পড়ল শমীক।

‘হ্যাঁ মানে ইয়ে..., ওই সেদিন ওই ডার্বিটায় ইস্টবেঙ্গল জিতল না, তো কাকুর সঙ্গে আমার বাবার বাজি হয়েছিল। বাবা তো বরাবর এসবে হারে...!’

‘তর বাবায় এসব সিরিয়াস ব্যাপার লয়ে বাজি ধরে ক্যান? জানস না, সিনসিয়ার না হইলে জীবনে অনেক কমপ্লিকেশন আওনের সম্ভাবনা থাইক্যা যায়!’ এই এতক্ষণে একখানা জব্বর স্পেস পেয়েছে তোতোন।  এলাকায় ডাই-হার্ট ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। এখনও কাঠ বাঙাল ভাষায় কথা বলে, এমনকী প্রেমটাও। নেহাত মেয়েটি বড় ভালমানুষ, তাই ওর এসব জাত্যভিমান মেনে নিয়েছে। নইলে...!

‘এই থাম তো, ভারি একখানা ডার্বি জিতে কি মাথা কিনেছিস না কি! শোন, আমরা দশজনে খেলেছিলাম।’ শমীক তেড়ে যায়।

‘হ, হ, ওই কনসোলেশান লইয়াই পরেরবার ডার্বি অবধি ঘুমায়ে থাক। পোলাপানের মতো কথা কইস না শমী, তগো টিম ওইদিন পনেরো জন নামাইলেও চাইর গোল খাইত। অ্যাহন আর প্যাঁচাল পাড়স না।’

আলোচনাটা মূলস্রোত হারিয়ে ফেলছে দেখে তিমিরই হাল ধরল, ‘আরে তোরা কী আবার নিজেদের মধ্যে শুরু করলি। হচ্ছিল একটা অন্য কথা...। হ্যাঁ, তার পর শমী, কী হল?’

তোতনের দিকে একটা বিষদৃষ্টি হেনে নাকটা পড়ানোর সময় খেই হারিয়ে ফেলা অধ্যাপকের মতো করে গপ্পটা ভাঙল শমীক। ‘ওই তো বাজিতে হারলে বাবা কাকুকে ইলিশ খাওয়াবে আর জিতলে কাকু খাওয়াবে চিংড়ি। তা বাবা বাজিতে হারায় বাবার থেকে টাকা নিয়ে আমরা ইলিশ কিনতে গিয়েছিলাম। মোড়ের বাজারে গিয়ে দেখি মেয়েটাও কী একটা দরকারে ওর মায়ের সঙ্গে বেড়িয়েছে। তা আমরা ইলিশ কিনছি দেখেই তো...!’

‘দেখেই তো কী?’ তিমির ফুট কাটে।

‘আরে তখনই তো ওর মায়ের সামনে জোরে জোরে বলতে লাগল, ‘কী এক স্টাফি পাড়ায় যে বাপি ফ্ল্যাট কিনল মা! একটু বৃষ্টি হল কি হল না, সব খিচুড়ি আর ইলিশ খাওয়ার তাল। খিচুড়ি কি সাফোকেটিং না?’ আর তাতেই তো বুকাই...!’

‘অ। বুঝেছি।’ বেশ গম্ভীর হয়ে বার দুই মাথা নেড়ে বলল তিমির।

‘কী?’

বুকাইয়ের ‘কী’-কে এক ফুৎকারে উড়িয়ে বলেই চলল তিমির। ‘এটা ওর মনের কথা না।’

‘মানে?’

এবারও বুকাইয়ের বিস্ময়কে ধর্তব্যের মধ্যে আনল না তিমির। ‘আমার মনে হয়, বুকাইকে শুনিয়েই কথাটা বলেছে, বুঝলি শমী ।’

তোতন বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। ওর তাহলে অম্বল হয়। ‘সে যারেই শোনাক। মাইয়া কী কইসে? স্টাফি পাড়া! বুকাই, অই মাইয়ারেই তুমি বিয়া করবা। আমাগো পাড়ারে স্টাফি কওয়া! হেই স্টাফি পাড়ারই বউ করন লাগব ওরে। মনরে সোলজারের মতো করো বুকাই, হয় অই মাইয়া নইলে আর কেউ না। আমি বাঙাল হইয়া কথা দিতাসি, আমাগো ওইক্য তুমার লগে থাকব।’

পাড়ার বড় জ্যাঠার মতো করে আদেশের ঢঙে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামল তোতন।

‘ওই আবার শুরু হল বাঙালের তড়পানি! হুঁহ্! যেন পাড়ার সব মেয়েকেই পাড়ার বউ হতে হবে, এ কী আজব রে বাবা! দেখলি না মেয়েটা বুকাইকে পাত্তা দিচ্ছে না, হাটে-বাজারে টিজ করছে। বুকাই কি নাইট না কি যে, বিয়েটাও মিশন হিসেবে নেবে!’ শমীক ফুট কাটে।

এসব কথায় কান দেওয়ার সময় নেই বুকাইয়ের। মাংস ভাত পাস করার আনন্দটাও কোথায় যেন মিইয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যাওয়ার সময় আড়চোখে একবার দেখে গেল কি? কী যেন বলে গেল— কে মাছটা আনবে সেটা বড় নয়, মাছ হচ্ছে এটাই বড় ব্যাপার! ফের ভোম্বলের ওপর রাগটা চিড়বিড় করে উঠছে, ‘অত কথা তোকে বলতে কে বলেছিল, অ্যাঁ?

‘যাব্বাবা! আমার কী দোষ? প্রশ্ন করলে কিছু তো একটা উত্তর দিতে হবে নাকি! ছোটবেলায় শিখিসনি? নিজে চুপ করেছিলে কেন বাপ? হাঁ করে তাকিয়ে শ্রীময়ীর শাড়ির ডিজাইন মুখস্থ করছিলে? পরের বছর কিনে দেবে বলে?’

ভোম্বলের শেষ বাক্যটা ধাঁ করে গ্রে ম্যাটারে সেঁধিয়ে নিল বুকাই। আহা!  তা-ই যদি পারত বুকাই...! নাহ্। এই আইডিয়াটা বেড়ে। এটার জন্য ভোম্বলকে ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। পরের বছরই একটা ট্রাই নেবে নাকি? খুব বেশি প্যাঁচে পড়লে না হয় ভাইফোঁটার আগাম উপহার-টুপহার বলে ম্যানেজ দিয়ে দেবে। মুখটা গম্ভীর করে বুকাই বলল, ‘আচ্ছা তাঁত কোথাকার ভাল রে? শান্তিপুর না ধনেখালি?’

ক্লোজআপ

অষ্টমীর ভোগপর্ব ভালোয় ভালোয় মিটেছে। আবাসনে কারও ঘরে রান্না হয়নি। পাত পেড়ে পুজোমণ্ডপে একসঙ্গে খাওয়া যেন পুরো পাড়াটাকেই একটা পরিবার করে দেয়। উচ্ছ্বাসের বশে শমীকের একারই ১৮টা রসগোল্লা খাওয়া আর চৌধুরি কাকিমার গায়ে তোতোনের প্লাস্টিক চাটনি ফেলে দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনও অঘটন ঘটেনি। না, শ্রীময়ী খেতে আসেনি ভাবলে ভুল করা হবে। অবশ্যই এসেছে এবং সোনামুখ করে ওই সাফোকেটিং খিচুড়িই খেয়েছে। শুধু এত তাড়াতাড়ি খেয়ে চলে গিয়েছে যে বুকাইরা ওদের দেখতেই পায়নি!

আজ নবমী। কালকের ভুল আর নয়। বুকাইরা ফুল ব্যাটেলিয়ান আজ সকাল থেকেই প্যান্ডেলে আছে। কাল তার চোখে না পড়লেও আজ তাকে দেখা হতেই হবে। সকাল থেকে বুকাই বেশ ফুলবাবুটি হয়ে আছে। গিলে করা পাঞ্জাবি পরেই পরিবেশন করছে। আজ আর কোনও রকম ধ্যাড়ানো যাবে না। মাছ-মাংসের দায়িত্বটা নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছে বুকাই। দেখতে দেখতে প্রথম ব্যাচ শেষ। এই ব্যাচে মেয়েটা নেই। তাই নাম কা ওয়াস্তে লেবু-জল দিয়েই কাজ সেরেছে। পাঞ্জাবি খুব বেশি লাট খেলে চলবে না। ও মেয়ের কর্পোরেট নজর।

সেকেন্ড ব্যাচেই খেতে বসেছে শ্রীময়ীরা। ওই তো ম্যাট একটা হলুদ রঙের শিফন পরে এদিকেই আসছে। আহা। এমন নবমী এর আগে একটাও আসেনি বুকাইয়ের। মাছের পর্ব আসতেই বুকাই এক্কেরে সেনাপতির ভূমিকায়। এই ব্যাচে খুব বেশি মাছ নেই। সামনের দু’জনকে দিয়েই সটান শ্রীময়ীর সামনে। যত্ন করে বেছে বেছে বেশ বড় পিস দুটো ওর পাতে দিল। কিন্তু যত্নটা একটু বেশি হয়ে গেল কি? ওর বাবা যেভাবে মাপলেন একবার বুকাইকে! আর মেয়েটাই বা কী? খাচ্ছে নাকি অঙ্ক কষছে কে জানে! পাত থেকে মুখটা তো একটু তুলতে পারে! কতবার তো সামনে দিয়ে অকারণেই যাতায়াত করল বুকাই। নাহ্ দেখল না তো। একবার তো ওর মাকে না যেচেই এক পিস মাটন বেশি দিয়ে দিল। উনি হাঁ হাঁ করে উঠতেই বুকাই বলল, ‘নিন না, সব তো আপনাদের জন্যই!’ তখনও তো একবার চোখে চোখ পড়তে পারত!

ডিসলভ

খাওয়া শেষ। ভিড়টার সঙ্গে ম্যাট শিফনও চলে যাচ্ছে। নাহ্। একবারও তাকায়নি। তোতন ঠিকই বলে, শালা ও মেয়ের পিট্যুইটারিই নেই। সেকেন্ড ব্যাচ উঠে যাওয়ার পর থার্ড ব্যাচের তোড়জোড় চলছে। প্যান্ডেলের পিছন দিকটায় সার সার তাল গাছ। পরপর হওয়ায় খানিক নিরিবিলি আর আড়াল আছে জায়গাটায়। পরিবেশনের জায়গাটা থেকে খানিক সরে এসে এখানটাতেই দাঁড়িয়েছে বুকাই। একটা ছোট চারা পায়ে বারবার জড়িয়ে যাচ্ছে। নতুন পোশাক, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে বেরনো, কাল ভাই-বোনদের প্লানিং সবই ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। সবাইকে এবার না করে দেবে কি? এখন একবার বাড়ি ফিরে শুতে পারলে ভাল হয়। মনখারাপ হলেই ওর ঘুম পায়। ফ্রিজে কাল রাতের কিছু খাবার আছে, খেয়ে শুয়ে পড়বে? বন্ধুদের সামনে গেলেই তো এখন ফের ওই একই প্রসঙ্গ। ভালো লাগছে না। কিছু ভালো লাগছে না বুকাইয়ের। শরীর খারাপ বলে ফিরে যাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই তালগাছটার আড়াল থেকে বেরতে যাবে, এমন সময় একটা গলা । ‘এই যে বাজারসরকার, এদিকে...।’

নিজের চোখকে মানুষ কেন বিশ্বাস করতে পারে না বুকাই এতকাল বুঝত না, আজ বুঝল। ম্যাট শিফন আবার এখানে এল কী করে!

‘এবার থেকে আবাসনের পুজোয় খাওয়ার দায়িত্বটা আপনিই নেবেন। ওটা বেশ পারেন দেখলাম।’

মেয়েটা কী যেন বলছে! ঠোঁট নড়ছে যে! কোন শেডের লিপস্টিক ওটা? ‘আমায় কিছু বলছেন?’ বোকার মতো প্রশ্নটা করে বসল বুকাই।

‘এখানে তো আমি-আপনি ছাড়া আর কাউকে দেখছি না, যদি বলেন, অন্য কাউকে দরকার, তবে খুঁজে নিয়ে আসি?’

এই রে! এখানে আবার অন্য কাউকে আনছে কেন রে বাবা! ধুর, বুকাই স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল, ‘তাহলে মাটন, মাছটা দুটোই বেশ ভাল ছিল বলছেন?’

মেয়েটা বুকাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করল না বোধহয়। ঘাড়টা ঈশৎ বেঁকিয়ে দু’পা এগিয়ে বলে উঠল, ‘আর এই যে শুনুন, রোজ রোজ জানলা দিয়ে অমন তেরচা চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাবেন না। সাহস থাকলে সামনাসামনি দেখবেন। বুঝলেন? আমি ভীতু ছেলে একদম পছন্দ করি না।’ বুকাইকে আর একটা কথা বলারও সুযোগ না দিয়ে ওই দূরে হেঁটে যাচ্ছে একটা মেয়ে। ভরদুপুরে যেন চোখের সামনেই গোধূলি নামছে ধীরে। বুকাইয়ের মনে হল এই উৎসবমুখর গোধূলির সব আলোকে লজ্জা দিতে পারে ওই বারো হাতের ম্যাট ফিনিশ শিফনটা।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন