শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

সমকালীন ছোটগল্প


পুরুষ

ঝুপসি অন্ধকার  ঝুলছে এগাছ সেগাছ থেকে। অন্ধকার নিয়ে লোফালুফি করছে চাঁদটা। এদিকটা কেউ আসে না। গ্রামের প্রান্ত। বিরাট মাঠের মাঝে সিঁথিপথ। রোজ রাতে ঘরে ফেরে সুশীল এক়থলে অন্ধকার নিয়ে। ঝাড়াঝাড়ি করলে চারটে আলু কি দুটো পটল বেরোয়। মা়ঠজোড়া এই অন্ধকার সুমন ভালোবাসে। নিশ্ছিদ্র নক্ষত্রবিহীন হলে আরো ভালো লাগে। আলোর অনুপস্থিতি অন্ধকার। সুশীল জানে অন্ধকারও জীবন্ত হয়। যেদিন মা মরবে সে রাতে একটা জীবন্ত অন্ধকারকে দেখেছিল সে। ছোটো আলমারীর কোণে বসেছিলো গুটিসুটি এক বুড়ি। বসে়ছিলো, যতক্ষণ না মায়ের প্রাণটা বেরোলো। যোগাড়ে মিস্ত্রী সুশীল। অন্ধকারের নেশা তার। অণু পরমাণু কীভাবে চলাচল করে অন্ধকারে... কালো কালো সচল মলিকিউল। পৃথিবীর সব আলোকে হজম করে একরাশ অন্ধকার ইলেক্ট্রন আর প্রোটন কণা। তারপর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। সুশীল চেনে অস্পষ্ট অন্ধকার, আবছায়া আর জমাটবাঁধা অন্ধকার। এভাবেই অন্ধ অণু আর পরমাণুদের ভেঙে ভেঙে এই মাঠে সৃষ্টি করেছে সে এক ছায়ামানুষের। পৃথিবীর অস্তিত্ব শব্দ তরঙ্গের নানা মিশ্রণের প্রতিফলন। শব্দের না থাকা নিঃশব্দ। নিঃশব্দ বাঙ্ময় হয় তরঙ্গের মিশ্রণকে একটু বদলে নিলে। সুশীল নিঃশব্দের ভাষা শুনতে পায়। ওই অন্ধকার মানুষটি অনেক কথা বলে। তাই তার মাঠ পেরোতে দেরী হয়।

ছোটো টালির ঘর। ভাত ফুটছে কাঠের আগুনে, সারা বাড়ি ফুটন্ত ভাতের গন্ধ মিশে যাচ্ছে হাওয়ায়। বাসন্তি সেই গন্ধ ছাপিয়ে গন্ধ পায়। মৃত ইঁদুরের গন্ধ। সুশীলের গায়ের বাস। আগুনের আঁচে ঘেমে উঠছে দেহ। ভাঁজে ভাঁজে ঘাম, বাসন্তি কাপড় আলগা করে। একটুকরো জমি। দুজনের ছোট একটি ঘর। একটি রোগামতো গরু। আর অনেকটা অন্ধকার।

বউ ভাত বাড়ে। মুখোমুখি বসে ওরা। বাইরে ঝিঁঝিঁ ডাকে। আওয়াজ করে খায় সুশীল। কানে লাগে। গলা খাঁকড়ি দেয়,

-কাল যাবে নাকি গাজিবাবার মেলায়?

-কেন?

-ইয়ে এমনি, কোথাও যাও না তো...

-যাব।

-বেশ তবে কাল তাড়াতাড়ি ফিরে আসব।

-হুম...

তারপর রাত নেমে আসে। নিঃশব্দে ছায়ামানুষটা দুজনের মাঝে এসে বসে। সুশীলের দিকে চেয়ে হাসে। কলতলায় গিয়ে মুখ ধোয়। পুকুর পারে বসে বিড়ি ধরায়। বাসন্তি কাপড় ছাড়ে। পাশে এসে বসে ছায়া। সুশীল নানা রকম অন্ধকার দেখতে পায়। ফিকে, অস্পষ্ট নিকষ। তার ওখানটায় একডেলা নিকষ অন্ধকার। একটু বড়ো হবার পর টের পেয়েছিল। কালো জলে, ঢোড়া সাপ চলে যায় পায়ের ওপর দিয়ে। একটু বড়ো হতে সুশীল টের পেল তার অন্ধকারের কথা। জাগে না। ফণা তোলে না। ছায়ামানুষ পিঠে হাত রাখে। কথাবার্তা হয়। অনেক জমে থাকা কুয়াশা আবছা হয়। ছায়ামানুষ তাকে বলে অন্ধকার অথবা জাগরণে  পৌরুষ বাঁধা নেই। সেই যে ওয়াগন ব্রেকারদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাল আর সারা চারটে গ্রামের কেউ নয় শুধু এই সুশীল এগিয়ে এসে গণধর্ষিতা বাসন্তির সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল, সেই প্রাচীন উপাখ্যান মনে করিয়ে দেয়। সুশীল আরো জমাট অন্ধকার হয়ে যায়। কৃতজ্ঞতা প্রেম নয়। ভালোবাসাহীন বাসন্তী কেয়া ফুলের গন্ধ নেয় সুবলের কাছে আজকাল। জানে। ঋণ ক্ষণস্থায়ী।

-বাসন্তির বাপটা ছিলো একেবারে নিরন্ন, ঝুপড়িতে থাকত রেল লাইনের ধারে...

সর্ সর্ পাতা পড়ে বাতাসে। ছায়া হাত রাখে পিঠে।

-একদিন ওরা তুলে নিয়ে গেল বাসন্তিকে।

-কারা, ওই লালমাঠে? কালু ওয়াগন ব্রেকারদের দলটা?

-বাসন্তির বাপটাকে অনেক সেবা করলে শেষতক। তোমার মনটা বড়ো সুন্দর। হাল্কা নরম অন্ধকার সুশীলের মাথায় বিলি কেটে দেয়। অপুরুষ সুশীল চোখ মোছে। বুকে হাত বোলায়। অস্বস্তি হয় কাঁচা পাকা চুল বুকে। বাসন্তির জীবনটা নষ্ট, গভীর শ্বাস ফেলে সুশীল। রাতপাখি কর্কশ ডেকে ওঠে।

বাসন্তি তারা গোনে। ভাবে শূন্য ঘরের কথা। নীলার কোলের ছেলেটার কথা। কেমন চুক চুক দুধ খায়। ভাবে সুবলের কথা। দূর থেকে গন্ধ পায় বাসন্তি। কাঁচা পেঁয়াজ আর রসুনের।

-মাচাটা ঠিক করে বাঁধো, চালটা ঠিক করো জল পড়তিছে!

সুশীল ঘাড় কাত করে। দুপুর হয়ে যায়। গনগনে রোদে পাথরে কোঁদা মানুষটার গা দিয়ে ঝরে ঘাম। বাসন্তি আড়চোখে চায়। মানুষটা খাটতে পারে বটে। না খাওয়া না দাওয়া। মুখে রা কাড়ে না। যেন জন্ম অপরাধী।

তবু সুবল টানে। যৌবন বড়ো জ্বালা। একপুকুর জলেও জুড়োয় না। টিঙ টিঙে চেহারা সুবল। বৌটাকে ঠেঙায় রোজ।

আজ পুন্নিমা। বাসন্তি মাদুলি আনতে যায় গাঙপাড়ের নতুন ফকিরের থেকে। বাঁধতে হবে সুশীলের হাতে। পথে গাছ গাছালি, বন অন্ধকার, ছায়া ছায়া পথ। বাসন্তী গন্ধ পায় কাঁচা পেঁয়াজের। সতর্ক হয়। সুবল বেরিয়ে আসে আড়াল থেকে।

-কিরে বাসু কোথা গেছিলি?

-গাঙপাড়।

-ফকিরের থানে?

হা হা করে হেসে ওঠে সুশীল। দেশি মদের গন্ধ বেরোয় মুখ থেকে। মাথা হেঁট করে বাসন্তি। হঠাৎ জাপটে ধরে সুবল। রক্ত গন্ধ পায় বাসন্তি। সুবল সাঁড়াশি হাতে পিষতে থাকে... মুহূর্তে ঢিলে হয়ে নেতিয়ে পড়ে সুবল। নিথর। চাঁদ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার যমদূতের মতো। সুশীল।

আজ রাতে আবার বাসন্তি স্নিগ্ধ ফুলের গন্ধ পায়। সুশীলের বুকে মাথা রাখে। কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তার পুরুষ। বাসন্তি প্রাণভরে আদরে ভরিয়ে দেয় তার পুরুষমানুষটাকে।

অন্ধকার ভালোবাসে এখন বাসন্তি।

ছায়ামানুষ মিলিয়ে যায় অন্য কোনো আরেক অন্ধকারের দিকে। চাঁদ হাসে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন