সমকালীন ছোটগল্প |
গ্রামার
দীপশিখাদিকে গ্রামার বইটা দিতে গিয়ে দেখলাম ও ওর সেই খাতাটাতে ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখছে! ওটা ওর স্পেশাল খাতা। ওর লুকানো খাতা। শুধু আমিই জানতাম তার অস্তিত্ব। টেবিলে বইটা রেখেছি দেখে তাকালো। যেন সাদা দেওয়ালের দিকে তাকালো।
এই খাতাটা ওকে লুকিয়ে বানাতে হতো। হ্যাঁ, ওর স্কুলের খাতাগুলো সব নিজের হাতে বানানো। দিস্তা কাগজ চারভাঁজ করে মুড়ে একটা একটা করে রেখে গুনছুঁচ আর মোটা সুতো দিয়ে সেলাই করে বানানো। এক্সারসাইজ খাতা ওর একটাও ছিল না। সব খাতার থেকে একটা করে কাগজ সরিয়ে রেখে বানানো ওর ওই বিশেষ খাতাটা। যাকে দীপশিখা মা বলে ডাকতো তার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা। সেখানে সবার অলক্ষ্যে সে শব্দ সাজাতো। সেদিন শব্দ সাজাতে সাজাতে আমায় বললো, না কি নিজেকেই বলছিল, ‘শব্দ’ শব্দটা কেমন দ্ব্যর্থবোধক দ্যাখ! শব্দ’কে অক্ষররূপ দেওয় যায়। আবার অক্ষরকে শব্দে বাজিয়ে দেওয়া যায়। আমি অত শত বুঝিনি। অবাক হয়ে সেদিন চেয়েছিলাম সেই অন্যমনস্ক দীপশিখাদির দিকে।
যেদিন মুক্তির আনন্দে দীপশিখা ঠাকুরঘরের সন্ধ্যাপ্রদীপের সলতের মতো নিজেকেও জ্বালাতে গেল, সেদিন বুঝতে পারেনি বা জানতো না, নিজেকে ঠিকমতো জ্বালাতে গেলে শুধু ওই সলতের আগুন ইজ নট এনাফ। পেট্রোল কেরাসিনের মত দাহ্যের সহযোগিতা না থাকলে মুক্তির বদলে আধপোড়ার কটূচিহ্ন নিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়!
জ্বলতে জ্বলতে মুক্তির আনন্দ সাময়িক ভুলে পোড়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ও ঘর থেকে সামনের বাগান পেরিয়ে গেট খুলে রাস্তায় এসে চিৎকার করে ফেলেছিল। যা লুকিয়ে করতে চেয়েছিল তা সকলের কাছে জানাজানি হয়ে গেলো দেখে ও হাহাকার করছিল। শীত-সন্ধ্যের সেই ফাঁকা রাস্তাও পনেরো পেরনো দীপশিখার সাথে হাহাকার করেছিল কিনা জানা নেই, তবে পাড়ার নামকরা ছেলে মধু ঘোষ কী কারণে রাস্তায় বেরিয়ে ওই জ্বলন্ত আগুনের ছটফটে ঘোরাফেরা দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে ওকে আগুনমুক্ত করতে জড়িয়ে ধ’রে এবং সেখান থেকেই গল্প ঘুরে গিয়ে অন্য গল্প শুরু হয়। মধু যখন বুঝতে পারে যে এই কারণে নিজের সার্টেও জায়গায় জায়গায় আগুন ধরে গেছে তখন তারও চিৎকার ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু এতে কোনও গল্প তৈরি হওয়ার কথা তার মাথায় আসেনি। কিন্ত পাড়ার লোকের মাথায় ততক্ষণে খুব তাড়াতাড়ি গল্পের প্লট এসে গেছে। যদিও মেয়েটাকে আগুনমুক্ত করার কথা পাড়ার লোকের চট করে মাথায় আসেনি। কী কারণে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে একসাথে আগুনে পুড়ছে সেই বিষয়ে গবেষণারত পাবলিকের রিফ্লেক্স এ্যাকসন আগুন নেভানো থেকে সরে মুখরোচক গল্পের দিকে নিমগ্ন হয়ে পড়েছে। আগুন নেভাবার ইন্সট্যান্ট বুদ্ধি আগে না এসে সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। কারণ মানুষ স্বভাবতই সংস্কৃতিবান। কিছু বোকা মানুষজন তখন বালতি বালতি জল দিয়ে ওদের হাইড্রোথেরাপি শুরু করে দিয়েছিল। আগুন তারপর আর ছড়াতে পারেনি। এ যাত্রা কিছু অসাংস্কৃতিক মানুষের জন্য দুটি প্রাণ হয়তো বেঁচে যাবে এই আশায় তারাই ট্যাকসি ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল দীপশিখা আর মধুময়কে। যারা হাসপাতালে গিয়েছিল সেই নির্দোষ বোকাদের মধ্যে কয়েকজন অবধারিত পুলিশ কেসের হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েছে। গল্প বানানোর দল সযত্নে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে।
কিছুটা অর্ধচেতনায় ফিরে দীপশিখা কি ভাবছিল, ‘আর একটু সহ্য করতে পারলাম না কেন! সহ্যগুণের পরীক্ষায় এতবছর তো আমি ফেল করিনি!’ অথবা এ হয়তো আমারই অনুমান! ওর ঠোঁটে বসিয়ে দিয়েছি। কেননা আমি তো জানি বাড়িতে দীপশিখাদিকে কী কী সহ্য করতে হয়!
মধুময়ের বলার কিছু নেই, কারণ ওর কোনো কথাই পুলিশ বিশ্বাস করবে না বলে পণ করেছে। পুলিশও পাড়ার লোকেদের মত গল্প খুঁজছে সত্য প্রমাণ করতে। মধুময়কে কেস খাইয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে খোলাখুলি ঘুস চাইছে ওর কাছ থেকে। মধুময় তখন কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করছে। ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। তার মধ্যে এই ঘোটালা।
সন্ধ্যের পাড়াবেড়ানো সেরে বাড়ি ফিরে দীপশিখার মা প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলেন, দীপু পুড়ে যাবার জন্য নয়, পুলিশের জেরার জন্য। অনেক কথা পুলিশ টেনে বের করবে। মেয়েটা যদি সব কথা পুলিশের কাছে বলে দেয় তবে তাঁর হাতেই তো সবার আগে হাতকড়া পড়বে! ধীরে সুস্থে যখন শুনলেন মধুময়ের কথা, খুব স্বস্তি পেলেন। সব অপরাধ তাহলে মধুর ওপরেই পড়ছে। মুক্তির আনন্দ উনিও পেতে চাইছিলেন বোধহয়!
আমি ভাবছিলাম, গতকাল একসাথে স্কুলে যাবার সময় দীপশিখাদি এইজন্যই কি আমাকে বলেছিলো, আমার ডাকনাম আর স্কুলের নাম দুটোই ভুল রাখা হয়েছিল রে! দুটো নামের একটাও আমার জন্য এ্যাপ্রোপ্রিয়েট নয়। দুটো নামের কোনটাই আমার সাথে যায় না। কে যে রেখেছিল কে জানে! বোধহয় সেই মানুষটি আমায় খুব ভালোবাসতো! ভালোবাসলে কি নামের গ্রামারে এত ভুল হয়!
দীপশিখাদির ভালোনামটি ছিল সুলগ্না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন