শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

কবি কুনভার নারায়ণের কবিতা

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

কবি কুনভার নারায়ণের কবিতা

(অনুবাদ : রুমা ঢ্যাং অধিকারী)




 

কবি পরিচিতিঃ কুনভার নারায়ন হিন্দিভাষী একজন কবি, আলোচক ও অনুবাদক। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নতুন কবিতা আন্দোলনের পথিক ছিলেন। ২০১৭ সালে ৯০বছর বয়সে কবির মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে, ২০০৫ সালের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে তিনি  ভূষিত হন এবং ২০০৯ সালে পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপ্ত হন। এমএম করার মাত্র পাঁচ বছর পরে, ১৯৫৬ সালে, ২৯ বছর বয়সে, 'চক্রব্যূহ' নামে তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণে, তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই পরিচিতি লাভ করেন এবং ফলস্বরূপ, অজ্ঞেয় জি কেদারনাথ সিং, সর্বেশ্বর দয়াল সাক্সেনা এবং  বিজয়দেব নারায়ণ সাহির সাথে ১৯৫৯ সালে 'তিসরা সপ্তক'-এ তার কবিতা অন্তর্ভুক্তিকরণ। এখান থেকে তিনি অনেক খ্যাতি পেয়েছেন। ১৯৬৫ সালে, 'আত্মজয়ী'-এর মতো প্রবন্ধ কাব্য প্রকাশের মাধ্যমে, কুনভার নারায়ণ অসীম সম্ভাবনার কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

 

অদ্ভুত একটি দিন

সমস্তদিন আজ ঘুরে বেড়ালাম

কই কোথাও তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না!

সারাদিন লোকজনের সঙ্গে কত কথা

অথচ অপমানিত হইনি কোথাও।

সত্যকে উগড়েই চললো আমাদের কথোপকথন

তারা কেউ মনে নিল না।

সবাইকে করেছিলাম বিশ্বাস

কেউই কিন্তু ধোঁকা দেয়নি।

আর আশ্চর্য হলো এই যে

ঘরে ফিরে অন্য কাউকে পেলাম না,

নিজেকেই যেন ফিরে পেলাম সম্পূর্ণরূপে।

 

বাজারের দিকেও

আজকাল বেশিরভাগ সময়

নিজের সাথে কাটাতেই অভ্যস্ত

এমনটা নয় যে ওই সময়ে

দ্বিতীয় কেউ আমার সাথে থাকে না

আমার স্মৃতিতে

কিংবা চিন্তা-ভাবনায়

কিংবা স্বপ্নে

সর্বদা সে আমন্ত্রিত

এইজন্য অত্যধিক প্রিয়

আর অত্যধিক আপনও

যতক্ষণ আমার চাওয়া ততক্ষণই তার থাকা

অথবা আমাকে আনমনা দেখে

চুপচাপ কোথাও তার সরে পড়া

কখনও কখনও হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়ি

বাজারের দিকেঃ

না না, কিছু কেনার অভিসন্ধিতে না

শুধুমাত্র এইটা দেখার জন্য যে

আজকের দিনে কী জিনিস বিক্রি হচ্ছে কত দামে

হাল ফ্যাশনের গতিবিধির খোঁজ

যদিও সত্য এই যে আমার জন্য

বাজার এমন একটি জায়গা

যেখানে আমি পেয়েছি সর্বদা

এমনই এক একাকীত্ব যেমনটা

বড়-বড় জঙ্গলেও খুঁজে পাইনি কখনও,

আর একটা আনন্দ 

সক্রেটিসের মতো কিছু কিছু

এত গাদা গাদা জিনিসপত্র

যা আমার কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

 

চক্রব্যূহ

যুদ্ধের প্রতিধ্বনি জাগিয়ে

হাজারবার পুনরাবৃত্তি যার,

রক্তের বিপরীত রঙে রাঙিয়ে

ঘুমপাড়ানি গানের সাথে গাওয়া হয়েছিল যাকিছু---

সেই ইতিহাসের স্মৃতি,

সেই ভুবনে ফিরে যেতে যেতে,

হে যোদ্ধা, কে তুমি? 

 

আমি নবাগত সেই অপরাজিত অভিমন্যু

মায়ের গর্ভ থেকেই যার প্রারম্ভকাল নিশ্চিত

অপরিচিত জীবনকে ব্যূহে নিক্ষিপ্তকারী এক উন্মাদ,

রচিত সমস্ত পঙক্তিকে ভেঙে

ক্রমশঃ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া সেই জয়নাদ

 

আমার হাতে ভাঙা চাকা,

গলিত আগুন-সন্ধ্যাও,

গায়ে আমার ফুটো বর্ম

সারাদেহ ক্ষত-বিক্ষত,

ধরিত্রী-রক্তে যেন ভিজে যাওয়া এক লাশ,

মাথার ওপরে শকুনের ঘোরাফেরা করা আকাশ...

 

এই সংঘর্ষে উৎসর্গিত

আমি সেই তর্কের কটু ব্যঙ্গ

যে জীবনের নামে পরাজিত,

প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে আমন্ত্রিত

সেই নিষ্পাপ জীব আমি

যাকে হত্যা করা হয়েছে পুজিত করে

সেই বোতল যার থেকে বহু শতাব্দীব্যাপী রক্ত বয়

সেই যন্ত্রণা যা নির্দোষী সয়

এই মহাসংগ্রাম,

যুগ যুগান্তের মহাভারত,

হাজার যুদ্ধ, উপদেশ, উপাখ্যান, কথায়

মুদ্রিত পৃষ্ঠাটি আমার কথাই বলে

যেখানে শতাব্দী পুরনো ব্যূহ, যা দুর্ভাগ্যজনক, ভেঙেছে

যেখানে অভিমন্যু আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েছেন:

যেখানে বিজয়ের সেই সর্বনাশা মুহূর্তে জানলেন

তার উদ্ধত ব্যূহ-রক্ষক আসলে বীর-কাপুরুষের জন্য প্রস্তুত

--যিনি নিজের পক্ষকে সত্যের থেকে বড় মেনেছেন--

যেখানে পৌঁছে সে মৃত্যুকে নিরপেক্ষ, নিরন্তর এক ঘেরাটোপের ভেতর

নিজের অস্তিত্বকে ঘিরে প্রতিটি দলকে চিনেছেন।

 

সমুদ্রের মাছ

ব্যস ওখান থেকেই ফিরে আসি প্রতিবার

নিজেকে অসম্পূর্ণ রেখে

যেখানে মিথ্যা, অন্যায়, কাপুরুষতা, মূর্খতা --

প্রত্যেক বাক্যের মাঝে আমি ভেঙে-মুচড়ে দিয়ে,

প্রত্যেক শব্দকে একলা ছেড়ে,

নিজের অসহনীয় যন্ত্রণার কাছে 

একার অনুশাসনে ফিরে আসি

কোনোরকমভাবে আবার শুরু করার জন্য।

নিউজিপ্রিন্টের অক্ষরে ছাপা

অনেকের মধ্যে এক বিস্ময়কর মুখ

অপরাধীর মতো বারবার ধরা পড়তে থাকে,

তার বেঁচে থাকার অদ্ভুত গোপন প্রচেষ্টার মাধ্যমেঃ

কিন্তু প্রতিবারের মতো সাজা পাওয়ার পর সে প্রৌঢ় হতে থাকে

যেখান থেকে উৎপাটিত হয় সেখান থেকেই সে ওঠে,

ওই নির্দয় দুনিয়ায় বিশৃঙ্খল জাঁকজমকে

নির্লজ্জভাবে বাঁচার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে। কোনোরকমে

বাকি জীবন টেনে খিঁচে চালিয়ে দিলে

এক থেকে দুই আর দুই থেকে বহুগুণ, অথবা

নিজেকে ঘিরে কোনো নতুন বিস্তারে

মাছের মতো অত ছোট করে

আর এমনভাবেই শুরু আবার যেন কোনো অন্য সমুদ্র।

 

সম্ভাবনা

প্রায় মেনেই নিয়েছিলাম আমি

মৃত্যুর অন্তিম যুক্তিতে

যে তুমি আসবে

আর এরকমভাবেই কিছু ভাবনা রেখেছি

ছড়ানো ছিটানো

জীবনের জাদু

এক সাবলীল ইন্দ্রজাল

মনে হয়েছে এই প্রস্তাব

নিশ্চই সফল হবে।

ভুলের মধ্যে ভুলই ছিল ওই

হিসাবে,

তবুও মনে হয়েছে

গলির ভেতর গলি ছিল ওই

অনেক সম্ভাবনার

ব্যস, এক হাত দূরত্বে

যাকে পাবার।

ভুল ছিল শুধু ওই দূরত্বকে বুঝতে

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন