শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধারাবাহিক উপন্যাস   

 

দিগন্তসেনা

 


(১৯)   

‘সভ্যতার ইতিহাস হল, তার মানে, ক্ষমতাবান, বিশেষ করে বুদ্ধিমান একদল মানুষের, অপেক্ষাকৃত সরল সাদাসিধে বেশির ভাগ মানুষকে পদানত করে রেখে তাদের ভাগের জিনিসটা কেড়ে খাওয়ার এক অনবদ্য ইতিবৃত্ত মাত্র!’ শ্যামাঙ্গীর কথাটা শোনা মাত্র রেঁনোয়া আগামেনন, হেলেন থ্যালেস আর শুভেচ্ছা চমকে উঠে ওর দিকে তাকাল। শুভেচ্ছার মনে হল সভ্যতা শব্দটার মধ্যেই যত গণ্ডগোল লুকিয়ে আছে। কথাটা কানে শোনা মাত্র শরীর এবং দৃষ্টির অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না করেই শ্যামাঙ্গী নীরবে হেসে উঠল, যে হাসির মধ্যে কসাইয়ের খাঁড়ার গায়ে আলো পড়ে ঝিলিক দেওয়ার মতই তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ যেন ঝকঝক করে উঠল। সকলে চুপ। কারুর মুখেই যেন কোনও কথার যোগান নেই।

ঠিক এইরকম একটা সময় রেঁনোয়া আগামেনন আর হেলেন থ্যালেস মিলে কিছু গোপন আলোচনা সেরে নিল একটু আড়ালে গিয়ে যার ফলস্বরূপ ওরা সকলে আবার ভেসে যেতে লাগল। ক’মিনিটের মধ্যে যে  মাটিতে ওরা পা রাখল তার নাম আথিনা। অল্প দুচার পা এদিক ওদিক ইতস্তত ঘোরাফেরার পর একজন হতভাগ্য মানুষের ওপর ওদের চোখ আটকে গেল, দেখতে ভালো নয় বললেও যাকে কম বলা হয়। বরং বলা ভালো কুৎসিত দর্শন। পরনের জামাকাপড়ের অবস্থায় তার চাইতেও হতদারিদ্রের ছাপ, ছেঁড়া, ফাটা। পায়ে একটা জুতো অব্দি জোটেনি বেচারার।  অথচ মানুষটা অন্য যাদের সঙ্গে কথা বলছে তারা সকলেই আদ্যপ্রান্ত সম্ভ্রান্তবংশীয়। পোষাকেই শুধু নয়, তাদের পরনেও দামী পশমে মোড়া জুতো। এমনকি ঠান্ডা প্রতিরোধের জন্য তাঁরা এক একজন এক একরকমের শীত প্রতিরোধক বস্ত্র পরেছে। অথচ কি অবলীলায় সেই লোকটা উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে কথা বলে চলেছে। সেইসব কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকেই মাঝে মাঝে হাসছে দিব্যি, যখন কিনা অন্যরাও হাসছে। তবে তাদের হাসির মধ্যে মিশে রয়েছে এক ধরনের আনুগত্য আর সম্ভ্রমের বোধ আর সেটা ওই লোকটার প্রতি।

আগামেনন দূরেই দাঁড়িয়ে পড়ল ওদের নিয়ে। দূর থেকে শ্যামাঙ্গীকে দেখিয়ে ওই লোকটার যে পরিচয় দেবার প্রথম ধাপে তার নামটা উচ্চারণ করল ‘সক্রাতেস’, তাতে শ্যামাঙ্গীর সুগভীর অস্তিত্বের অতল থেকে উঠে এসে সমস্ত শরীরে বয়ে গেল এক শিহরণ। ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই থাকল। অনেকক্ষণ পর অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ‘প্রকৃত জ্ঞানের উপাসক যারা সিদ্ধিলাভ করেন, শুধুমাত্র তাঁরাই এরকম হতে পারেন, হন !’  আগামেনন এবার অন্যান্য দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের ভেতর থেকে দুজন বিশেষ ব্যক্তিকে দেখিয়ে বলল, ‘এদিকে ক্সেনোফন আর ওদিকে প্লাতন।শ্যামাঙ্গী যখন ওদের দেখছে, তখন শুভেচ্ছাকে হেলেন আরও বিশদে দিল তাদের পরিচয়। দিয়ে বলল যে সম্ভবত তিনি সেইসব মানুষদের মধ্যে অন্যতম যারা পঞ্চ ইন্দ্রিয় আর ষড়রিপুর ওপর প্রভূত্ব করার ব্যাপারে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। 

আগামেনন সক্রাতেসকে একটু ডেকে ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই তিনি নিজেই বললেন আগামেননকে দেখিয়ে যে সে একরকম ঠিকই বলেছে। সক্রাতেসই হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ  জ্ঞানী মানুষ। কেননা সে নিজের মধ্যে নিজে এই কথাটা জানে যে আসলে সে কিছুই জানে না। তার জানা জ্ঞানও আসলে কোথাওই কোনও কাজে লাগে না। তখন শ্যামাঙ্গী বলল যে সেই জন্যেই তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। তা শুনে তিনি বললেন যে তিনি আদৌ কোনও রকম জ্ঞানের আধার নয়। সমস্ত জ্ঞানই আসলে প্রকৃতির নিজস্ব এবং তা পঞ্চভূতে বিলীয়মান।

শ্যামাঙ্গী স্মিত হাসিতে যখন একটু পাশ ফিরে ডান দিকে তাকালো তখন দেখল তার পাশে শুভেচ্ছা  বা পেদ্রোর বদলে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ওর মনে পড়ে গেল একটু আগেই সম্ভবত আগামেনন ওই ভদ্রলোকেরই নাম বলেছিলেন প্লাতন। শ্যামাঙ্গী তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ’মাননীয় মহাশয়, আপনাকে, এবং আপনাকেই একমাত্র দিগন্তসেনার পক্ষ থেকে আমার অভিবাদন গ্রহন করতে অনুরোধ করব। কেননা একমাত্র আপনিই সেই ব্যাক্তি যে সময়ের ওই বিন্দুতে দাঁড়িয়েও বুঝতে পেরেছিলেন যে সামান্য কিছু পার্থক্য বাদ দিলে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। স্বভাব ও মগজ – এইদুটো  ক্ষেত্রেই তারা অভিন্ন।সঙ্গে সঙ্গেই কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে যে শ্যামাঙ্গী ধন্যবাদটা আসলে কাকে দিতে চায়। সক্রাতেস না প্লাতনকে? তখন সে জানায় যে প্লাতন বর্ণিত সক্রাতেসকে এবং অবশ্যই  প্লাতনকেও’। এর ফলে সমস্ত বিরোধ মীমাংসা সম্ভব হতে চলেছে যখন, ঠিক তখনই শ্যামাঙ্গী আবার বলল, ‘তবে আপনার সাম্যবাদকে যখন আপনার পরিবারের মধ্যে প্রয়োগ করে স্ত্রীর ওপর বেশ ভালো রকম একটা সার্বজনীন  অধিকার সকলকে দিতে চান, তখন আমি বিস্মিত হয়ে যাই এই ভেবে যে আপনাদের মতো জ্ঞানী মানুষজনেরও কারুরই মাথায় একবারের জন্যও ঢুকলো না যে একজন স্বতন্ত্র স্বভাব ও চিন্তাভাবনাসম্পন্ন মানুষকে ব্যবহার করার সার্বজনীন অধিকার সকলের মধ্যে বন্টনের অধিকারটা আপনি কোথা থেকে পেলেন বা কে আপনাকে দিল!’

সঙ্গে সঙ্গে সকলের মধ্যে গুঞ্জণ শুরু হল। দুজন বলল, ’সবই রাষ্ট্রের স্বার্থে, রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনায়। শ্যামাঙ্গী বলল, ‘না,মাননীয় মহাশয়! আদতে আপনারাও ঐতিহ্যের দাসত্ব এড়াতে অক্ষম হয়েছিলেন। আপনাদের সেই ঐতিহ্য, পিতৃতন্ত্রই এখনও ধর্ষণের অধিকার আর লাম্পট্যের অধিকার একচেটিয়াভাবে নিজেদের কাছে গচ্ছিত রেখেছে। দেখুন একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, গোটা সভ্যতাটার কি হাল হয়েছে। প্রতিদিন প্রতি ঘন্টায় কত সংখ্যক নারী ও শিশু কন্যা অত্যাচারিত আর ধর্ষিত হবার পর খুন হচ্ছে! এর কোনও সমাধান না করে, আমি জানি না, আপনারা আপনাদের স্বপ্নরাজ্য, সে গণতন্ত্রই হোক বা সাম্যবাদই হোক, সেটা কিভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন!’ তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল শ্যামাঙ্গী যে সে ওঁদের সুত্র ধরে পাওয়া জ্ঞানের ঐতিহ্যকে অবশ্যই শ্রদ্ধা করে এবং সেজন্য সে সবার কাছেই ঋণী। দয়া করে কেউ যেন তাকে ভুল না বোঝে।

ইতিমধ্যেই আরও নতুন একজন এসে তাঁদের মধ্যে অবলীলায় ঢুকে পড়লেন। কথাও বলতে শুরু করে দিলেন স্রেফ এইজন্যে ওদের আড্ডায় যে কারুর অংশগ্রহনের অধিকার সার্বজনীন ও স্বীকৃত। কিন্তু আগামেনন তটস্থ হয়ে ঊঠে তাড়াতাড়িই তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, তার নাম আরিস্তেতেলেস। প্রাথমিক সৌজন্যবিধির পর শ্যামাঙ্গী বলল, ‘মান্যবর, আপনাকে আপনার সর্বগ্রাসী জ্ঞানের দ্বারা আমাদের সমৃদ্ধ করার জন্য আমি সক্রাতেস, প্লাতন ও অন্যান্যদের যেমন  শ্রদ্ধা জানিয়েছি, তেমন শ্রদ্ধা জানাবার পাশাপাশি আরও অন্য একটা কারণের জন্যও আপনার কাছে সকলের মত আমি কৃতার্থ যেটাকে আপনি নিজেই আসলে আপনার সময় নষ্ট করেছেন বলে ভাবেন। ঠিক সেই সময়ই একটি তেরো বছর বয়সের কিশোর ঘোড়ার ওপর চাবুক মারতে মারতে এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। শ্যামাঙ্গীকে বলল,’ আমার অভিবাদন গ্রহন করুন,’ বলে মাথাটা সামান্য নোয়াল।

উপস্থিত কেউই তাকে চিনতে পারল না। সবাই এ ওর, ও এর দিকে মাথা নাড়তে শুরু করল। শ্যামাঙ্গী বলল,’মাত্র তিনটি বছর আপনি এই দূর্বিনীত ছাত্রটিকে পড়িয়েছিলেন। মনে পড়ে?’ কলেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। আরিস্তেতেলেস এই দূর্বিনীত ছেলেটি আসলে কে তা হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। কেননা একসময় তিনি তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা এমনভাবে মন থেকে মুছে ফেলেছিলেন যে এখন আর শত চেষ্টাতেও তা মনে করতে পারলেন না। শ্যামাঙ্গী এবার ছেলেটির আসল পরিচয় দিতেই সবাই চমকে উঠল।

‘আলেক্সান্দ্রস! মনে পড়ে?’ শ্যামাঙ্গী বলল,’এই উদ্ধত, মদ্যপ, নিষ্ঠুর, প্রতিহিংসাপরায়ণ, কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষটিই কিন্তু আপনাদের সবাইকে আমাদের সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে! এ না থাকলে সেই সব কিছুই ‘নেই হয়ে যাওয়াটা মাত্র কয়েকটা দিনরাতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। কেননা ও ছাড়া গ্রীক সভ্যতার ঐতিহ্য, জ্ঞানভান্ডার আর কার রক্ষা করবার সাধ্য ছিল, মান্যবরগণ?’ অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে আরিস্তেতেলেস বললেন,’আমি এই কথা ভেবে গর্ব বোধ করছি যে এতে আমার অবদান ছিল শূন্য। ‘সেটা আপনার অভিরুচি মান্যবর। শ্যামাঙ্গী বলে চলল, ’কিম্বা হয়ত সত্যিই তাই।‘ কেউ একজন বলল,’ধর্ষককে কি আপনি তার কোনও গুণের জন্য কদর করতে রাজি আছেন মহামাননীয়া?’ বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে চাবুকের মত শ্যামাঙ্গীর উত্তরটা সকলের কানে গিয়ে আছড়ে পড়ল, ’অবশ্যই হ্যাঁ। কোনও সন্দেহ আছে?’ তারপর বলল, ’আপনারা এত জ্ঞানী মানুষজনই কেউ ঐতিহ্যের দাসত্ব এড়াতে পারেন নি। সেখানে ওর জন্য এই আশাটা কি ব্যাতুলতা হয়ে যাচ্ছে না মান্যবরগণ! এটা একটা ব্যবস্থা। উৎখাত করতে হলে সেই ব্যবস্থাটাকেই উৎখাত করা উচিত। নয় কি?’

দিগন্তসেনায় আসা এক নতুন সাংবাদিক জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে শুভেচ্ছা লিভ ইন  করতে শুরু করেছে। সেই সুবাদে সে এ বাড়িতেই থাকতে শুরু করে দিল। প্রথম প্রথম কেউই খাবার সময় বা টুকিটাকি অন্য দরকার বাদ দিয়ে  বাইরে বেরাতো না। দরজাও প্রায় সারাক্ষণই বন্ধ থাকত। শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে শুভেচ্ছার যোগাযোগ বলতে ছিল শুধুই মোবাইল ফোন।  প্রথম দিকে বাড়ির  কাজের মেয়েটা একদিন কোমরে কাপড় গুঁজে একেবারে রনং দেহি মূর্তিতে এসেছে শ্যামাঙ্গীকে নালিশ করতে যে তার মেয়ে আর ছেলেটা চব্বিশ ঘন্টাই দরজা বন্ধ করে যে আছে তাতে শ্যামাঙ্গী ওদের ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেবে কিনা। শ্যামাঙ্গী পরিস্কার করে জানিয়ে দেয় যে না। তেমন কোনও কিছু সে ভাবছে না। ওরা যা করেছে বা করছে সেটা ঠিকই করছে। কেননা দরজাটা ওরা বন্ধ করেছে। তখন সে গজগজ করতে থাকে। শ্যামাঙ্গী পেদ্রোকে ওর সামনেই ওকে টাকাপয়সা দিয়ে বিদেয় করতে বলে আর তার বদলে নতুন লোক দেখার কথা বলতেই সে এসে হাতে পায়ে পড়ে। তখন ও ওকে কাজ করতে বলে । কিন্তু কারুর ব্যাপারে নাক গলাতে বারণ করে দেয়।

শুভেচ্ছাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে শ্যামাঙ্গী তার অন্য ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে বেশি না হলেও অল্প সল্প চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করে। তার মনে হয় যে শুভেচ্ছার যেমন একটা নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সময় যাপনের জন্য থাকার জায়গার দরকার হচ্ছে, ঠিক সেই রকম প্রয়োজন নিশ্চয় অন্যদেরও হচ্ছে যেটা ওর আরও আগে থেকে ভেবে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু ও তা করে উঠতে পারেনি। তখনই শ্যামাঙ্গী ঠিক করল কোনও ভালো জায়গা দেখে তার সাধ্য মত আঠেরোটা ফ্লাট কিনবে।  পেদ্রোকে একথা বলতেই পেদ্রো কয়েকটা খোঁজ এনে দিল আর তারই মধ্যে থেকে শ্যামাঙ্গী তার সাধ্য মতো আঠেরোটা ফ্ল্যাট বেছে নিয়ে তার ছেলেমেয়েদের জন্য কেনার ব্যবস্থা করল। শুভেচ্ছা সবটা শুনে বলল যে ওর কোনও ফ্ল্যাটের দরকার নেই। যখন দরকার হবে তখন সেটা ও নিজেই করতে চায় এবং সেটা এখানে নয়, মূল ভূখন্ডের কোনও শহরে। ততদিন সে শ্যামাঙ্গীর সঙ্গেই থাকতে চায়, অবশ্য তাতে শ্যামাঙ্গীর যদি না কোনও অসুবিধে হয়।

শ্যামাঙ্গীর অন্য সব ছেলেমেয়েরা সত্যি সত্যিই এবার তাদের জীবনযাপনে যে সব নানা অসুবিধা হচ্ছিল সেগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেল। সকলেই তাদের পছন্দ মতো সঙ্গী নিয়ে লিভ ইন করতে শুরু করে দিল। শকুন্তলার প্রথম চার ছেলেমেয়েরা ওই বাড়িতেই লিভ ইন শুরু করে দিল। যাজ্ঞসেনী তো অনেক আগেই সে পর্ব শুরু করে দিয়েছে লিপিকার সঙ্গে। এবার বেদও শুরু করল আলেসসান্দ্রোর সঙ্গে। লগ্নলতা তার বিদেশের পাট চুকিয়ে এখানেই দুটো ফ্ল্যাট কিনেছে, একটায় ছেলেরা থাকে যে যার মতো লিভ ইনে আর একটায় নিজেরা থাকে স্বামীস্ত্রী মিলে। আগমনী লন্ডনেই থাকে তার  বাড়িতে উত্তরা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে আর সাসা নিহিতপাতালপুরীর বাড়িতেই আছে এখনও একাই। শকুন্তলা অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে তার সব ছেলেমেয়েদের জন্যেই একটা করে বড় ঘর সঙ্গে বাথরুমওয়ালা পাকা ব্যবস্থা একটা জায়গায়ই করে রেখেছে। চৈতিও তাই। এই প্রজন্ম তাদের বাবামার সহযোগিতার জন্য খুব সহজে নিজেদের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারছে যেটা শ্যামাঙ্গী, সুদাম বা সম্রাট স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নে কোনও দিনই ভাবতে পারত না। দিগন্তসেনায় ছেলেমেয়েদের জন্য যে পরিবেশ আছে মূল ভূখন্ডে কিন্তু আজও অব্দি জনসাধারণের মধ্যে সেই চেতনা বেড়ে ওঠেনি দু একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা বাদ দিলে। ফলে সেখানে কিন্তু এখনও লুকোচুরির ব্যবস্থা হয়ে আছে বয়ঃসন্ধির সময়টাকে নিয়ে।

শ্যামাঙ্গী যখন আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে তার যোগদান ও বক্তব্য রাখার পর ফিরে আসছিল এবার, তখন একজন কমবয়সী যুবক নিজে থেকেই এল আলাপ করতে তার সঙ্গে। প্রাথমিক সৌজন্যবিধির পর্ব চুকলে সে জানায় যে তার নাম অভিমন্যু রায়চৌধুরী আর যদিও তার ভবিষ্যতে শ্যামাঙ্গীর মতোই এ ধরনের কাজ করার ইচ্ছে আছে, কিন্তু আপাতত সে হার্ভার্ড  বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ব নিয়ে পড়াশুনোর শেষ পর্যায়ে আছে। তার বাড়ি মূলভূখন্ডের বেগমবাহার বলে একটা জায়গায়। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সে তার সঙ্গী মেয়েটির কোনও পরিচয় দেয় না। শ্যামাঙ্গী নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করাতে সে কিছুটা খাবি খাওয়ার মতো করে বলল যে ও ওর সহপাঠিনী, যদিও ওদের দৈহিক ভাষা কিন্তু বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে সম্পর্কে ওরা একে অন্যের ঘনিষ্ঠ।

কিছুটা চলতে চলতেই মানময়ী হঠাৎ করে পড়ে যায়। তাই অনেক চিকিৎসা, অপারেশন আর দৌঁড়দৌঁড়ির পর মানময়ী এখন গৃহবন্দী। তবুও সে যতটা পারে সংসারের কাজ করে এক জায়গায় বসে বসেই। কখনও আনাজপাতির খোসা ছাড়ানো, কখনও লুচি কিম্বা রুটি বেলে দেওয়া, কখনও আবার স্বামী সেবা - অনঙ্গর গা-হাত-পা টিপে দেওয়া। বলে, কাজ না করে শুধু শুধু খাবো?  নানারকম ব্যাধি যেন তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে ধরেছে। সমস্ত শরীরটা যখন হাঁসফাঁস করতে থাকে, তখন একটু দম নিয়ে বলে,’বাব্বা!’ অনঙ্গ অমনি উঠে পড়ে লাগে তার পেছনে। ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করে তার মনপ্রাণ ওষ্ঠাগত করে তোলে। বলে, ‘ননীর পুতুল একেবারে। আর যেন কারো শরীর খারাপ হয় না’, আর ভ্যাংচাতে থাকে। মানময়ীর চোখে জল চলে আসে। শ্যামাঙ্গীকেও  কাছে পায় না। আর পেলে বলে,’আমি সত্যিই তোদের বোঝা হয়ে গেছি। ভগবান যে কেন সত্যিই আমাকে তুলে নেন না জানি না। এবার যেতে পারলে বাঁচি। কথাগুলো শুনে শ্যামাঙ্গী ধমকায়। তার মনে হয়, কেউ যেন তার কানে গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে, যদিও সে জানে না সেই অভিজ্ঞতাটা বাস্তবে কেমন।

ন’মাস সতেরো দিন পর শুভেচ্ছা ঠিক করে জনসংযোগ বিষয়টা নিয়ে সে পড়াশুনো করবে। ততদিনে জাহাঙ্গীর খানের ব্যাপারটা চুকেবুকে গেছে। সেই ছেলেটিও বিদেশে পারী দিয়েছে। শ্যামাঙ্গীর অন্য ছেলেমেয়েরা দিগন্তসেনায় ফিরে এসেছে। থাকতে শুরু করেছে ওদের জন্য নির্ধারিত ফ্ল্যাটে। দ্বিধা, পিপীলিকা আর মহিমা – শ্যামাঙ্গীর তিন কন্যা মিলে হিসেবচরিত্রচিত্তির বলে একটি নতুন দল খুলেছে। পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলোতে ওদের দলের খুব কদর। এরা বিয়ে বা পরিবার প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান করে। বিয়েও করেনি তারা এই কারণেই। শুনেই শ্যামাঙ্গীর চক্ষু ছানাবড়া। ও বার বার করে জিজ্ঞেস করল, ‘এইসব বদবুদ্ধি ওদের মাথায় কে ঢোকালো?’ শকুন্তলা আর চৈতি বলল, ছাড়ো তো পিপি।শকুন্তলা তো বলেই ফেলল,’ একটা কথা ভুলে যেও না পিপি। ইটের বদলে পাটকেলটা তো খেতেই হবে, বল। তাই না?’ শ্যামাঙ্গী শকুন্তলার দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাইল। চৈতি বলল, ‘এতদিনে একটা কাজের মত কাজ হয়েছে। সত্যিই তো। আমরা মেয়েরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি না আমাদের বাবা মায়েরা বানের জলে ভেসে এসেছে যে বিয়ের পর আমাদের ছেলেদের বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে। তাদের পদবী ধারণ করতে হবে, সন্তানও ওদের বংশের সম্পত্তি হয়ে যাবে। যা হবে এবার থেকে ফিফটি ফিফটি, বুঝলে পিপি? এতদিনে একটা কাজের মতো কাজ হয়েছে। ‘শ্যামাঙ্গী ওদের দুজনকে অবাক হয়ে দেখতে লাগল। শকুন্তলা বলল,’আমি বাবা ওদের দলে। সঙ্গে সঙ্গে চৈতিও বলল, ‘আমিও ওদের দলে। শকুন্তলা বলল, ‘আমার মেয়েরা ফোন করেছিল। ওরা সবাই ওদের দলে। ‘চট করে কথা বলা শ্যামাঙ্গীর স্বভাব নয়। তাই ও একেবারে গুম মেরে বসে রইল। একবার শুধু মুখ ফুটে বলল,’এ রকম করলে তো সৃষ্টি থমকে যাবে একেবারে! সে খেয়াল আছে?’ ওরা বলল, ‘হ্যাঁ। যাবেই তো! সেটাই স্বাভাবিক!’ শ্যামাঙ্গী বলল, ‘তাহলে?’

 (ক্রমশ)                                       


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন