পরিবার ধর্ষণ ও বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত
ঐতিহাসিক সময়ের নিরিখে বিচার করলে পিতৃতন্ত্রের তুলনায় মাতৃতন্ত্রের আয়ু বেশি নয়। মাতৃতন্ত্রের আবির্ভাব পিতৃতন্ত্রের চেয়ে সভ্যতার অনেক অনেক ঊষা লগ্নে। তখন মানুষের সমাজও খুব একটা জটিল ছিল না। তাই মাতৃতান্ত্রিক পৃথিবীর বিভিন্ন সামাজিক কাঠামোগুলোও ততটা বেশি উন্নত ও জটিল ছিল না। সেই সময়কার বিভিন্ন অনুশাসনগুলো, যেগুলো আমরা পরে তৈরী হওয়া গবেষণালব্ধ বিভিন্ন ডকুমেন্টগুলো থেকে জানতে পারি, সেগুলো একটু নেড়ে ঘেঁটে দেখলে দেখব যে সেখানেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মতোই বিভিন্ন এমন পরম্পরা ছিল যেগুলো প্রথমে গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম মা ও তার মেয়েরা ভোগ করত, আধিপত্য করত। ছেলেদের ওপর অধিকার কায়েম রাখা, তাকে যৌনসঙ্গী রূপে পাওয়া – এসবই ঘটত তাদের মতামতের, ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না রেখেই। তবু পাঠক, ব্যক্তিমানুষের ওপর শোষণ আধিপত্য কায়েম রাখার সেইসব পদ্ধতিগুলো খুবই কমজোরি ছিল মূলত যে কারণে সেটি হল সেইসময় প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খল সেভাবে সমাজের ওপর গেঁড়ে বসেনি এবং সেই সমাজটাও আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে খুব কম দূরত্বেই ছিল। সর্বোপরি গোটা সমাজ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মাতৃতন্ত্র খুব অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়েছিল। সেই তুলনায় পিতৃতন্ত্র দীর্ঘায়ু। শুরু হয়েছিল মাতৃতন্ত্রের পরে পরেই এবং চলেছে আজও এখনও পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই। এই চলার পথে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খল তাকে শক্তিশালী করেছে। সমাজের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন পুরুষ আধিপত্য বজায় রাখা হয়, তেমন বজায় রাখা হয় পরিবারের মধ্যেও। একজন পরিবারের পুরুষপ্রধান সবসময় নজর রাখে তাদের এই সার্বভৌমত্ব প্রতি মুহুর্তে অটুট থাকছে কিনা বা কোথায় কোথায় কখন কখন এই সার্বভৌমত্ব খুন্ন হচ্ছে বা তাদের অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে। এই নজরদারি এতটাই কড়া যে পরিবারের মধ্যে থেকেও অন্য সদস্যদের ক্রমাগত মনে হতে থাকে এ যেন অন্য কোথাও, অচেনা কোনও আঙিনায় তারা এসে পড়েছে। করেছে অনধিকার প্রবেশ। মুখোমুখি হয় এক অস্তিত্বের সংকটে এক অপর হিসেবে। এভাবেই পরিবারের মধ্যে গড়ে ওঠে আরও একটা সমান্তরাল পরিবার, আত্মীয়তার মধ্যে গড়ে ওঠে সমান্তরাল আরও একটা আত্মীয়তার দাপট। গড়ে ওঠে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী শুধুমাত্র জৈবিক লিঙ্গের ভিত্তিতে। বৃহত্তর সমাজেও গড়ে ওঠে অন্য একটা সমান্তরাল সমাজ যারা শুধু ক্ষমতা ও আধিপত্যের আধার হয়ে ওঠে। স্বামীস্ত্রীর জন্মজন্মান্তরের ধারনাটা আসলে একটা ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। নারী পুরুষের একটা অংশ এতে বিশ্বাস করত এবং করে। বিশেষ করে আগেকার দিনের প্রায় সব নারীরাই এতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ সংখ্যক পুরুষদের কাছে এটা ছিল নারীদের চোখে ঠুলি পরাবার একটা অস্ত্র মাত্র।
নারীকে নারী হিসেবে আর পুরুষকে পুরুষ হিসেবে জন্মের পর থেকে পিতৃতন্ত্রের নিজস্ব নির্মান চলে কঠোর নজরদারিতে। এর ফলে ক্রমশ ক্রমশ একটি শিশু জৈবিকভাবে পুরুষ হয়ে জন্মাবার কারণে যে অসীম ক্ষমতা ও আধিপত্যের আধার হয়ে ওঠে তার মনস্তাত্বিক প্রকাশ আমরা দেখে থাকি বিভিন্ন রকম সামাজিক জয় পরাজয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যে। নমনীয়োতা, কমনীয়তার মতো অনুভূতির প্রকাশ পুরুষবিরুদ্ধ ও মেয়েলি হিসেবে চিনহিত করার মধ্যে দিয়ে সমাজে ও পরিবারের মধ্যে ক্ষমা, কৃতজ্ঞতা এইসব গুণ গুলোকে সভ্যতার বৈরী হিসেবে চিনহিতকরণের কাজ চলে এসেছে এত শত সহস্র বছর ধরে। মর্ষকামীতা সভ্যতার এক অঙ্গাঙ্গী উপাদান হয়ে ঊঠেছে এমনভাবে যেন ব্যপারটা এরকম যে যত বেশি আধুনিক ও উন্নত হবে সে তত বেশি সভ্য ও মর্ষকামী হবে। আর এরই ফলাফল হিসেবে একবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে এসে মানুষ হয়ে উঠেছে ক্রুর, নিষ্ঠুর, স্বার্থান্বেষী। সমগ্র সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে এক অভূতপূর্ব খাদের কিনারে। যত রকমের ধ্বংসাত্বক অস্ত্র আমরা আবিস্কার করেছি গোটা পৃথিবী জুড়ে যত পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে, তা দিয়ে বিশ্বের সকলের দুবেলার আহার চলে যেতে পারত অতি অনায়াসে। গন্ডায় গন্ডায় যত্র তত্র অনাকাঙ্খিত শিশুদের জন্ম না দিয়ে পৃথিবীকে জনঘনত্বের ভারমুক্ত রাখা যেতে পারত। করা যেতে পারত প্রকৃতির সঠিক পরিচর্যাও।
নিজেদের যোগ্য উত্তরপুরুষ নির্মানের ছুঁতোয় প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারেই বাবারা, কখনও কখনও পিতৃতন্ত্রের সুযোগ্য সফল এজেন্ট হিসেবে মায়েরাও কিভাবে তাঁদের প্রতিভাবান, যোগ্য নারী সন্তানদের ওপর দিয়ে অত্যাচারের রোলার চালিয়ে দেন, দিচ্ছেন আজও সেটা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের পুরুষরা উপলব্ধি করতে পারে তাদের জীবনের, আবির্ভাবের মাহাত্ম। আর ঠিক তখনই তারা এই শিক্ষা পেয়ে যাচ্ছে এই পৃথিবীতে পুরুষ হয়ে জন্মে তারা কতটা সুবিধেজনক পরিস্থিতিতে আছে। এই উপলব্ধিই তাদের শিক্ষা দিয়ে দেওয়ার পক্ষে তো যথেষ্ট যে একজন নারীর চাইতে একজন পুরুষ শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্ব বোধের কারণেই একজন ছেলে কোনও মেয়েকে বিবাহ প্রস্তাব দিয়ে যদি নেতিবাচক উত্তর পান, তার পৌরুষ আহত হয়। তিনি সেই মেয়েটিকে যে কোনও ভাবে আক্রমণ করতে পিছপা হন না। এমন কি এসব ক্ষেত্রে পুরুষটির কোনও সামাজিক বা শিক্ষাগত যোগ্যতা বিচারেরও বা পর্যালোচনারও দরকার পড়ে না এই একবিংশের মাঝামাঝি এসেও। আবার পুরুষ অহং বিপর্যস্ত বোধ করে যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় সে কোনও নারীকে ব্যক্তিগত বার্তালাপে আমন্ত্রণ জানায় এবং নেতিবাচক উত্তর পায়। তখন সেই বিষাক্ত পৌরুষ চিৎকার করে ওঠে, ’দেখেছেন, কত বড় আস্পর্ধা দেখেছেন?’
ব্যপারটা যেন এমন, আমি (সেই পুরুষ) তাকে ডেকেছি বা প্রস্তাব দিয়েছি, ও তো একটা মেয়ে। ওর ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা। তা না করে একটা মেয়ে তাকে প্রত্যাখ্যানের স্পর্ধা দেখাচ্ছে, এটা একটা মেয়ের যেন অনধিকার আচরণ। সমাজের যে কোনও স্তরের যে কোনও প্রস্তাবে ঘাড় কাত করাটা নারীজীবনের পরম ধর্ম। গুড গার্ল সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে এত এত শত সহস্র বছর ধরে নারীরা যে পুরুষের দাসত্ব করেছে নানাভাবে, সেই সমস্ত সমীকরণগুলো কে যত দিন না নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে ততদিন ব্যর্থ পৌরুষের হাহাকার, যন্ত্রনা, আত্মবিশ্বাস তাদের পৌরুষ প্রমাণের ও প্রতিষ্ঠার জন্য একের পর এক ঘরে ও বাইরে, চেনা ও অচেনা পৃ্থিবীতে ধর্ষণকে হাতিয়ার করে লড়ে যাবে, লড়তেই থাকবে সমাজে গোটা পৃথিবী জুড়ে। এর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া খুব সহজ তো কিছুতেই হবে না, যদি না আমরা সমাজে নতুন মূল্যবোধ তৈরী করতে পারি যা হবে যথার্থভাবে যুগোপযোগী।
অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে এই আধুনিক পৃথিবীতেও প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে
স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের এত চরম ভয় পেয়ে থাকেন তাদের জীবনের কোনও কোনও ক্ষেত্রে যে
তারা নিজে নারী হয়েও তার নিজের মেয়ে সন্তানটির পাশে দাঁড়াতে পারেন না নিজেরই স্বামীর
বিরুদ্ধে। অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আজও শুনতে হয় এটা করলে তো আমার স্বামী
আমাকে মেরেই ফেলবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একবিংশের প্রায় মাঝামাঝি এসেও একজন নারীকে তার স্বামীকে, কখনও তার বাবাকে, কখনও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের ভয় পেতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। ভয় পেয়েও সেই বিয়ের মধ্যে থেকে যেতে হয়। আমি সত্যিই জানি না এ হেন একটা ‘বিবাহ’ বা ‘পরিবার’ নামক প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়, সেটা মানবসভ্যতার কোন কল্যাণের ব্রত উদযাপনে লাগে বা ভবিষ্যতে লাগবে। বস্তুত পরিবার হল মানবাধিকার লঙ্ঘনের আঁতুরঘর। হেন কোনও কাজ নেই যা এখানে হয় না। সেটা ছেলেদের দিক দিয়ে হোক বা মেয়েদের দিক দিয়ে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে পরিবার না থাকলে কি এই সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আরও বেড়ে যেত না? শিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠার দায়িত্ব তাহলে কার ওপরে বর্তাতো? পরিবারের অনুপস্থিতি কি গোটা মানবসমাজকে নৈরাজ্যবাদের অন্ধকারে ছুঁড়ে দিত না? এই ধরনের গাদাগুচ্ছের প্রশ্নের হামলে পড়ার মধ্যে অনেক সুধী তার্কিকই বেশির ভাগ সময় হা হা করে তেড়ে ছুটে আসেন, আসবেন জানি। কিন্তু সে নিয়ে আলোচনা করার পরিসর এখানে নেই।
বলা বাহুল্য এ অতি উত্তম ও মোক্ষম প্রশ্ন সন্দেহ নেই। মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের এ হেন সুযোগ সুবিধা ও দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল বলেই সম্ভবত তাকে অকালে বিদায় নিতে হয়েছিল। অন্যদিকে পিতৃতন্ত্র সম্ভবত এই কারণেই এত এত শত সহস্র বছর ধরে তার রাজত্ব কায়েম করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেখবার বিষয় তো হওয়া উচিত কোন কোন প্রাতিষ্ঠানিকতা বা অপ্রাতিষ্ঠানিকতাকে গ্রহণ বা বর্জনের মধ্য দিয়ে মানবসমাজ আরও আরও বেশি উন্নত ও সভ্য হয়ে উঠতে পারে, সেটা। নয় কি? উন্নত ও সভ্য বলতে বৃহত্তর মানবসমাজের শোষণ মুক্তিই তো আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। নয় কি? পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের মুক্তিই সভ্যতা বিকাশের চালিকা শক্তি হওয়া উচিত এবং সেটাই হয়েছেও এ যাবত কাল অবধি।
আর সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে সভ্যতার বর্তমান পর্যায়ে পিতৃতন্ত্র তার উপস্থিতি ও অবস্থানের সার্বিক গ্রহনযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা অনেকদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছে এবং এবার সময় হয়েছে তার সমস্ত অন্ধত্বকে কবর চাপা দেবার। গোটা মানবসভ্যতার বোধ হয় পিতৃতন্ত্রের কাছ থেকে আর কোনও কিছুই পাবার নেই। তাই দিকে দিকে ক্ষয়িষ্ণু পিতৃতন্ত্রের অন্ধত্ব উদযাপনের ও জয়গান গাইবার বদলে তার হাত থেকে নিজেদের মুক্ত করবার একটা প্রচেষ্টা আমরা দেখতে পাই রাষ্ট্রসংঘের সিডও কনভেনশনের আবির্ভাবে।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন