ধারাবাহিক উপন্যাস
একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী
(৩১)
সে হয় না। হৃদয় সরাসরি নাকচ করে দেয়। এ লেখা কিছুই হয়নি। মেয়েটা শুধু জানে না তাই নয়, ফুল নিয়ে ওর কোনও কৌতূহল আছে বলেও মনে হয় না। তবু ও লিখেছে কেন? এই লেখা কেন ও ছাপাতে চায়? ওকে কেন আমরা উৎসাহ দিতে যাব? এটা তো অত্যন্ত অসৎ কাজ হবে...
মুখের অন্ধকার আরও ঘন হয় অতলান্তের। মেলায় থাকার সব উৎসাহও
যেন ওর ফুরিয়ে যায়। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, এবার ওকে যেতে হবে, ও অসুস্থ। সাঁঝকে নিয়ে বেরিয়ে
যায় সে। অন্যদিকে চলে যায় আগ্নেয় আর মেহুলী। ওদের দুজনেওরও মুখ কালো হয়ে আছে।
গোটা ব্যাপারটা বিশ্রুতকে খুলে বলে হৃদয়। বিশ্রুত অবাক
হয়ে বলে, মেহুলীর লেখা ছাপানো নিয়ে অতলান্তেরই বা অত আগ্রহের কী আছে? মেহুলীকে ফুল
বিশেষজ্ঞ প্রমাণ করে ওর কী লাভ?
লাভ আছে। পেছন থেকে অনির্বেদ বলে ওঠে।
তাই নাকি? বিশ্রুত বলে ওঠে। কী রকম?
মেহুলীর মামা কে জানিস? প্রাইভেট সেক্রেটারি।
এতক্ষণে ব্যাপারটা স্পষ্ট হল ওদের দুজনের কাছে। অতলান্ত
আসলে প্রাইভেট সেক্রেটারিকে খুশী করতে চায়। কিন্তু ফুলের বাগানের একটা সুনাম আছে। সেটার
কথা একবারও ভাবল না সে?
কিন্তু কয়েকদিন পর যা ঘটল, তা শুনে একদম তাজ্জব বনে গেল
হৃদয়। ফোনটা অতলান্তই করেছিল।
খুশীতে ঝলমল করছিল সে। বলল, একটা দারুণ খবর আছে হৃদয়।
তাই নাকি? হৃদয়ও খুব উৎসাহ বোধ করে।
মেহুলী বিদেশ যাচ্ছে। একদম দেশের প্রতিনিধি। স্বয়ং ম্যানেজিং
ডিরেক্টর সুপারিশ করেছেন।
একটু অবাকই হয় হৃদয়। তখনও সে পুরোটা শোনেনি। তবু বলে,
দেশের প্রতিনিধি? মেহুলীর এমন কোনও গুণ আছে নাকি? কী ব্যাপারে যাচ্ছে সে?
ফুল নিয়ে বলতে। দেশের একজন তরুণ ফুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে ওকে
পাঠানো হচ্ছে।
হঠাৎ সব উৎসাহ নিভে যায় হৃদয়ের। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের
মধ্যেই অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। এটা দারুণ খবর? কীভাবে এটা দারুণ খবর হয়? দেশে
আর কোনও তরুণ ছিল না? ফুলের ব্যাপারে কী জানে মেহুলী? এদেশে ফুল নিয়ে দিনের পর দিন
সাধনা করে চলেছে কত ছেলেমেয়ে। কত যোগ্যতা তাদের। কত প্রতিভা। তাদের সবাইকে বঞ্চিত করে
একটা আনাড়িকে দেশের প্রতিনিধি করে পাঠানো হচ্ছে? এটা তোর কাছে দারুণ খবর হতে পারে,
আমার কাছে এর চেয়ে জঘন্য অবিচার আর কিছু হয় না। এভাবে কি দেশের মুখ উজ্জ্বল হবে? হৃদয়পুর
সম্পর্কে কী ধারণা হবে বাইরের লোকের? ছীঃ!
অসম্ভব হাঁপাতে থাকে হৃদয়। ততক্ষণে অতলান্ত নিজের ভুল
বুঝতে পেরেছে। কোনও মতে অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য সে বলে ওঠে, শান্ত হ’ হৃদয়, তুই আর উত্তেজিত হয়ে কী করবি? ঘোষণা
তো হয়ে গেছে...
সত্যিই নিজেকে সামলে নেয় হৃদয়। সে টেরও পায়নি কখন আগ্নেয়
এসে দাঁড়িয়েছে। হৃদয় ওর দিকে ফিরে বলে, তুই জানতি এসব?
সন্দেহ করছিলাম। কয়েকদিন ধরেই খুব ম্যানেজিং ডিরেক্টরের
বাড়ি যাচ্ছে। লোকটার নাকি মেহুলীকে খুব পছন্দ। রোজ রাতে ওকে ফোন করত। ঘুমনোর আগে মিষ্টি
মিষ্টি কথা বলত। মেহুলী নাকি সেসব শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে যেত। আসলে সবই ওর মামার মদত।
ওই প্রাইভেট সেক্রেটারির। নিজের শরীর বেচে এখন বিদেশ যাচ্ছে। রাবিশ!
রাগে ফুঁসতে থাকে আগ্নেয়। কিন্তু একটু পরেই শান্ত হয়ে
যায় সে। কোনও মেয়েকে ভুলতে তার বেশী সময় লাগে না। বিশেষ করে, মেয়েটির কাছ থেকে যদি
আর পাওয়ার কিছু না থাকে। মেহুলী এখন অনেক উঁচু ডালে উঠে গেছে। ওকে এখন মন থেকে ঝেড়ে
ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে সামলে নেয় আগ্নেয়।
কিছুদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায় অতলান্ত। কয়েকদিন পর অনির্বেদ
এসে যে খবর দেয়, তাতে একদম তাজ্জব বনে যায় হৃদয় আর বিশ্রুত।
আজ তো বিরাট পার্টি অতলান্তর বাড়িতে, সে বলে।
কীরকম? বিশ্রুত জানতে চায়।
মেহুলী বিদেশ যাচ্ছে। তাই পার্টি দিয়েছে অতলান্ত। এলাহি
আয়োজন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর আসছেন। প্রাইভেট সেক্রেটারিও।
ও এত টাকা পাচ্ছে কোথায়? হৃদয় অবাক!
সাঁঝ দিচ্ছে।
জল তাহলে অনেকদূর গড়িয়েছে। বিশ্রুত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আর আমরা কিছুই জানিনা?
কেউ উত্তর দেয় না এই প্রশ্নের। কয়েকদিন পরেই এ-সি বসে
অতলান্তের বাড়িতে। ফুলের বাগানে যে ক-জন ছিল, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়। এর আগেই অবশ্য প্রাইভেট
সেক্রেটারির উদ্যোগে সে চাকরি পেয়ে গেছে তাদের কম্পানিতে। প্রাইভেট সেক্রেটারি নাকি
বলেছিলেন, তোমাকে যদি চাকরি দিতে আর দেরি করি, ম্যানেজিং ডিরেক্টর তবে আমারই চাকরি
খেয়ে নিতে পারেন।
এখন ওদের কম্পানিতে ফুল নিয়ে কাজ করতে অনেককেই ডাকে অতলান্ত।
আগ্নেয় গিয়ে কার্টুন আঁকে, অনির্বেদ জোকস লেখে, সমিধা চিত্রনাট্য লেখে, এইরকম। কিন্তু
হৃদয় বা বিশ্রুতকে কখনও ডাকে না।
ওদের কম্পানি থেকে ষোল পৃষ্ঠার একটি রঙিন জার্নাল বেরোয়।
তার বিষয়ও ফুল, তার সৌন্দর্য, তার পরিচর্যা, ফুলের বিপনন, ইত্যাদি। সেখানেও অতলান্ত
অনেককেই লিখতে বলে। কিন্তু হৃদয় বা বিশ্রুতকে কখনও বলে না।
অনির্বেদ নিজেই একদিন জানতে চায়, তুই কম্পানিতে যোগ দেওয়ার
পর থেকে বেশ কয়েকটা সংখ্যা বেরিয়ে গেল। এখনও পর্যন্ত হৃদয় বা বিশ্রুত কাউকে লিখতে বললি
না। আগামী সংখ্যায় অন্তত বল...
না না, সে হয় না। কথাটা যেন উড়িয়েই দেয় অতলান্ত।
কেন? হয়না কেন? অবাক হয়ে জানতে চায় অনির্বেদ। ওদের লেখা
অন্যরকম। এই জার্নালে চলবে না। নিজের মত স্পষ্ট জানিয়ে দেয় অতলান্ত।
অনির্বেদ আর অতলান্তকে ঘাঁটাতে সাহস করে না। অতলান্তের
সুনজরে আছে সে। নিয়মিত লেখার সুযোগ পাচ্ছে। শুধু শুধু ওকে চটিয়ে লাভ কী?
কয়েকদিন পর আবার অনির্বেদ জানতে চায়, তুই অনেকদিন ফুলের
বাগানে আসিস না। ব্যাপারটা কী? সবাই কিন্তু এখনও তোকে আমাদেরই একজন বলে মনে করে।
আসলে হৃদয়ের অনেক সমস্যা আছে। অতলান্তের আবার কেমন একটা
এড়িয়ে যাওয়া ভাব।
সমস্যা? অনির্বেদ অবাক। কী সমস্যা?
আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলতো!
অনির্বেদ কিছুটা ত্রস্ত হয়েই শুনতে থাকে।
অতলান্ত বলে, প্রতিমাসেই আমরা কিছু না কিছু চাঁদা দিই।
সব টাকা কি ফুলের বাগানের পেছনে খরচ হয়? মনে তো হয় না। বাকি টাকা কোথায় যায়? বলতে পারিস
আমাকে? হৃদয় এত আরামে আয়েশে আছে কী করে? সবটাই ওর নিজের খরচে?
অনির্বেদ এবার তাজ্জব বনে যায়। কী বলতে চায় অতলান্ত? হৃদয়
সম্পর্কে এমন কথা যে ভাবাও যায় না।
অতলান্ত আবার বলে, কে টাকাগুলো রাখে? কে হিসাব রাখে?
টাকা রাখে হৃদয়। হিসাব রাখে বিশ্রুত। কিন্তু ওরা তো প্রতিটা
পয়সার হিসাব বাকিদের নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে রবিবারের আড্ডায় বুঝিয়ে দেয়। বাকিরাই বরং
শুনতে চায় না। বিরক্ত হয়। পিছনে ওদের নামে যা তা বলে। সবাই আসে খোশগল্প করতে। তখন এসব
ভালো লাগে কারও?
এসব কথাই অনির্বেদ বলতে চায় অতলান্তকে। কিন্তু মুখে ভাষা
জোগায় না। কেমন যেন থ’ মেরে যায় সে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, তুই কি ওদের সন্দেহ করিস?
সন্দেহ? অতলান্ত চতুরভাবে হাসে। তারপর বলে, ফুলের বাগানে
অর্থ নিয়ে যথেষ্ট কারচুপি চলে। আর এ নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহই নেই। এ আমার সিদ্ধান্ত।
অতলান্ত যে এত নীচে নেমে ভাবতে পারে, অনির্বেদের কাছে
তা কল্পনারও বাইরে ছিল। খুব উঁচু উঁচু ভাবের কথা বলত অতলান্ত। মানুষের কল্পনাকে অনেক
উঁচুতে নিয়ে যেতে পারে সে। অথচ তারই মধ্যে এত নীচ সঙ্কীর্ণ নোংরা একটা মন লুকিয়ে আছে?
এই দুটো ব্যাপারকে যেন মেলানোই যায় না। একটু ধন্দেই পড়ে যায় অনির্বেদ। বুঝতে পারে না
কোনটা আসল কোনটা নকল। কোনটা মুখ আর কোনটা মুখোশ। কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা। অতলান্ত
ক্রমেই একটা ধাঁধাঁর মতো হয়ে ওঠে ওর চোখে।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন