রঙ্গালয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত (পর্ব – ৩)
আচ্ছা এই পর্বে কী সাবটাইটেল বানাই? গতপর্বে দেখিয়েছিলাম -- কীভাবে নীলবিদ্রোহের পর থেকে এতকালের অনুগত বাঙালি ভদ্রলোকদের মনে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অসন্তোষ ও প্রশ্নের সূত্রপাত হয়েছিল ৷ শাসক শাসিতে এই দূরত্ব জন্ম নেওয়া ছিল অনিবার্য বা সবথেকে স্বাভাবিক ৷ কারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক ব্রিটিশ সভ্যতাকে স্বাগত জানিয়েছিল বুদ্ধির স্তরে এবং প্রকাশ্যে ৷ তাঁদের শ্রেণি পরিস্থিতি, পশ্চিমী শিক্ষা, যুক্তিবাদ ----এই সবকিছুর একটি সুচতুর রসায়ন ছিল এই মেনে নেওয়ায় ৷ অন্যদিকে আবেগ ও বিশ্বাসের গহীন স্তরে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের প্রতি বিরূপতাও ছিল সমান দৃঢ় ৷ তাই ১৮৫৮ এর পর তড়িঘড়ি ক্ষমতা হস্তান্তরের পর নতুন শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো থেকে শিক্ষিত বাঙালিদের যখন যখন দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছিল তখন থেকে একটি চোরা ক্ষোভ দেখি উভয় পক্ষে ৷ মধ্যবিত্ত এবং শিক্ষিত বাঙালির সঙ্গে প্রশাসনিক তরফের প্রথম লড়াই শুরু হয় পেশায় ও জীবিকায় ৷ লড়াই কখনো কর্মদক্ষতার কখনো সম্ভ্রমের ৷ একটি প্রায় সমান্তরাল পরিবর্তন এসেছিল বাঙালির দর্শন ও দেশচেতনায় --যেটিকে সম্যক না বুঝলে নাটক ও নাট্য সম্পর্কে বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গির আমূল প্রসারণ ও উথালপাতালকে বোঝা যাবে না ---বোঝা যাবে না নাট্যবিষয় নির্বাচনে স্বদেশবাদের প্রবেশ এবং প্রেক্ষাগৃহের গণতন্ত্রীকরণকে৷ তাই এ পর্বের নাম দিই --
শতকের মধ্যভাগ :
উত্তরণে
সামাজিক চেতনায়
সপ্রতিভ বাঙালি
উনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের পর থেকে বাঙালির বুদ্ধিচর্চায় মূল প্রশ্নটি ছিল পাশ্চাত্যধারা ও পশ্চিমীভাব গ্রহণ করা উচিত কিনা , গ্রহণ করলেও কতটুকু গ্রহণীয় আর কতটুকুই বা ফেলে দেওয়া যেতে পারে ৷ নীরদ সি চৌধুরীর মতে এই বিতর্কে অন্তত প্রথম কুড়ি বছর পাশ্চাত্যবাদীদের জিত হলেও ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক কর্মে পশ্চিমমুখী ধারা আমূল বদলে যেতে থাকে ৷ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ডিরোজিও প্রভাবিত তরুণ সম্প্রদায়ের পশ্চিমমুখীনতা স্তিমিত হতে প্রজন্মগত ব্যবধান ঘুচে গিয়ে দেশের উন্নয়ন ও অবনতির প্রশ্নে মিল হয়ে প্রাচীন-নবীনে ৷
Yes Yes and Yes -- দেশের ভালো মন্দের প্রশ্ন আর বিভিন্ন দর্শন বহন করা বাঙালির এই মিলের স্রোত ---দুটোই সেসময়ের বাঙালির সমাজের মঙ্গলভাবনা এবং সংস্কৃতি চর্চাকে নতুন এক প্রেরণা যোগায়৷
১৮৬৬ তে রাজনারায়ণ বসুর জাতীয় গৌরব
সম্পাদনী সভা অথবা ১৮৬৭ তে নবগোপাল মিত্রের
হিন্দুমেলার সময় থেকেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীর আত্মস্থিতি ,আত্মপ্রস্তুতি ও আত্মনির্ভরতার
শুরু ৷ পূর্বকৃত যাবতীয় ভুল সংশোধনের ব্যস্ততায় বাঙালি তখন একটি স্বস্তিদায়ক আত্মপরিচয়
খুঁজতে উন্মুখ হল জাতীয় সংস্কৃতির সার্বিক পরিবেশে --দেশীয় ভাষা শিল্পের পুনর্গঠনে
,ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ বা নতুন ব্যাখ্যায়নে ৷ সেই হিসেবে আমরা অবশ্যই ধরে নিতে পারি বঙ্কিমচন্দ্র --যাঁর আবির্ভাবে উনিশ শতকের
Elitist Culrure তার উৎস বদলেছিল---তাঁর ' বাঙ্গালার কলঙ্ক ' ,' বাঙ্গালা শাসনের কল
', 'বাঙ্গালার ইতিহাস ' , 'বাঙ্গালার ইতিহাস সম্বন্ধে কয়েকটি কথা ' এবং ' বাঙ্গালার
ইতিহাসের ভগ্নাংশ ' -এই পাঁচটি প্রবন্ধ শুধু ঐতিহাসিক তত্ত্ব তথ্য নির্ধারণের নিস্পৃহ
বস্তুগত আলোচনা ছিল না ৷ তা ছিল বাঙালি জাতির বহিরজীবন ও অন্তরজীবন বিকাশের ইতিবৃত্ত
কিংবা হতে পারে বাঙালির অমোঘ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মহিমা ৷ তাই হয়ত কমলাকান্তের দপ্তর
-এ লেখকের বঙ্গচিন্তা ভারতচিন্তায় এসে জমাট বাঁধে ৷ অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে ৷ আত্মাদরে
বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তখন এমনই মাতাল যে সে সময়ের অন্যতম স্বদেশবোধ সম্পন্ন
নাটককার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যচর্চার
পাশাপাশি স্বদেশি স্টিমার পরিচালনার কারখানা খুলতে দ্বিধাবোধ করেননি ৷ এ ব্যাপারে তাঁর
ভাষ্য ছিল --
"...আমি পুনর্বিক্রয়ে স্বীকৃত হইলাম না ৷ অস্বীকৃত হওয়ার প্রধান কারণ এই হইল যে , বাংলায় বাঙালি কর্তৃক আমিই সর্বপ্রথম "জাহাজ" চালান প্রবর্তন করিব, এই গর্ব ৷ "
১৮৬৭ এর হিন্দুমেলা পার করে বাঙালির রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার শুরু সত্তরের দশকে ৷ সত্তরের দশকেই ভারতবাসী যে পার্লামেন্টারি বা প্রতিনিধিমূলক শাসনের সম্পূর্ণ উপযুক্ত একথা শিশিরকুমার ঘোষ তাঁর অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশ করেন ৷ ১৮৭৫ - এর মধ্যে শিশিরকুমারের অগ্রজ হেমন্তকুমার ঘোষের রাজনৈতিক শিক্ষায় মফস্বলের মধ্যবিত্ত বাঙালি তৎপর হয়ে উঠতে থাকে ,গড়ে ওঠে একাধিক পিপলস এসোসিয়েশন ৷ ১৮৭৫ এর ২৫ সেপ্টেম্বর যখন শিশিরকুমার ঘোষ " মুখার্জিস ম্যাগাজিন " এর সম্পাদক শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে ইন্ডিয়ান লীগ গড়লেন তখনই বোঝা গিয়েছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের জমিদারি মেজাজের দিন শেষ , মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ শুরু ৷
ঠিক এইসময় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায় আই .সি. এস পদ ছেড়ে রাজনীতিতে জড়ালেন ও প্রথম পাবলিক মিটিংয়ে বক্তৃতা
দিলেন ৷ একই বছর স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন স্থাপন করলেন ভারতের প্রথম কেমব্রিজ রাংলার আনন্দমোহন
বসু ৷ এরপর ১৮৭৬ -এ ভারতসভা প্রতিষ্ঠা ৷ সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন ---
" আমাদের মনে এই ধারণা কাজ
করছিল ,তা হল এই যে ,আমাদের এই এসোসিয়েশন একটি সর্বভারতীয় আন্দোলনের কেন্দ্ররূপে কাজ
করবে ৷ সমিতি দ্রুত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গণ -ভাবনার উপর আলোকপাত করা এবং শিক্ষিত বাঙ্গালীদের প্রতিনিধিস্থানীয় হয়ে উঠল ৷"
১৮৫৭এর পর থেকে শুরু হয়ে ১৮৭৬ ---জাতীয়তাবাদের নির্ণায়ক মুহূর্তে এটিই ছিল বোধহয় বাঙালি মধ্যবিত্তের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক আশ্লেষ ৷ শুধু তাই নয় --বাঙালি মধ্যবিত্তের
ক্রমঅর্জিত জাতীয়তাবাদ মাঝে মাঝে তার চিরাচরিত অভিমুখও বদল
করছিল ৷ বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোক বুঝতে শিখছিলেন -- ভারতীয় জাতীয়তাবোধ উজ্জীবনে সমাজ হিতৈষণা
ও সামাজিক সাম্য একটি আবশ্যিক শর্ত৷ এ ব্যাপারেও আমার বলতে দ্বিধা নেই --বাঙালি মধ্যবিত্ত
এইসময় সমাজের মূল স্রোতের বাইরে থাকা মানুষের পিছুটানে ফিরে দাঁড়াচ্ছিল ৷ অন্তত ১৮৬০-
এ দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ লেখা এটাই প্রমাণ করে --যেখানে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের
কথা লেখা না হলেও ব্রিটিশরাজের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রশ্রেণির
একটি অর্থনৈতিক স্বার্থের বন্ধন তৈরি হয়েছিল ৷ শুধু নীলদর্পণ নয় --অর্থনৈতিক শোষণ এবং
ব্রিটিশের Master plan "Drain Of Wealth " নিয়ে বেশ কটি নাটক এ সময়ের বাঙালি নাটককাররা লিখেছিলেন
৷ পরে নিশ্চয় এ প্রসঙ্গে নিশ্চয় কখনো বিস্তারিত বলব ৷ আপাতত সে সময়ের এক ব্রাহ্ম শ্রমিকদরদী
নেতা শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলে শেষ করব --যা থেকে হয়ত পাঠক বুঝতে পারবেন অর্থনৈতিক
শোষণ এবং সেই সূত্র ধরে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের কতটা নাড়া দিচ্ছিল
৷ শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সমকালে লেখা হয়েছিল ----
Hardly any native, and
certainly no European ,could hope to wield the same influence over the poorest
classes as that exercised by a man of Mr. Sasipada Banerji's position .A
despised outcast feels himself fully honoured when a Brahmin in the teeth of
old tradition and time - honoured custom not only enters his poor hut ,but
actually eats with him and chats with
him as a man and a brother .There must be an eloquence in these alien visits more potent than that of works .
বাঙালি মধ্যবিত্তের নিজস্ব নাট্যভাবনা অথবা একটি ভিন্ন আদলের নাট্যসংঠনের নির্মাণ পরিকল্পনা যে উনিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের কর্মপ্রবণ ,ভবিষ্যৎমুখী --যাকে বলে Achievement Oriented আদর্শবাদ এবং শতকের উল্লিখিত Collective Situation থেকে দিশা খুঁজছিল বলার অপেক্ষা রাখে না ৷
দিশা খানিকটা পেয়েছিল কি বাঙালি তার নাট্যবিষয়ে ও থিয়েটার বানানোয়? পরের পর্বে
--সবুর please
এই পর্বে যে যে বইপত্তর পড়েছি –
১. নীরদচন্দ্র চৌধুরী, আত্মঘাতী বাঙালী, প্রথম খণ্ড, ২৩ নভেম্বর ১৯৮৮, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স ৷
২
বসন্তকুমার চট্টপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবন-স্মৃতি, স.প্রশান্তকুমার পাল, প্রথম
সংস্করণ, ২০০২, ইন্দ্রনাথ মজুমদার, সুবর্ণরেখা ৷
৩.
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথা, অনু.নলিনীমোহন
দাশগুপ্ত, মার্চ১৯৮৯, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ ৷
৪.
Albion Rajkumar Banerji, An Indian Pathfinder, being the memories of Sevabrata
Sasipada Banerji (1840 - 1924 ) Kemp Half Press, Oxford.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন