বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩

সুদীপ্ত বিশ্বাস

 

কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস বনাম যুক্তিবাদ




আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে কেউ মুসলমান ছিল না। আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কেউ হিন্দু ছিল না। কিন্তু  তার আগেও বহুকাল ধরে মানুষ ছিল। মানুষের সাথে মানুষের বিবাদ বা বিভেদ যেটুকু ছিল তা ছিল খাদ্য ও বাসস্থানের। এরপর এল কিছু সুবিধাবাদী চালাক মানুষ। তারাই ধর্ম সৃষ্টি করল। পুঁতে দিল বিভেদের বীজ। এরপর মানুষ মানুষের থেকে এভাবে আলাদা হয়ে গেল যে আজ এতযুগ পেরিয়ে এসেও, এই স্মার্ট ফোনের যুগেও মানুষ এক হতে পারেনি। বরং ধর্মের বিষগাছটি শাখা প্রশাখা বিস্তার করে মানুষের রক্ত মজ্জায় ঢুকে গেছে। মানুষ হয়ে পড়েছে ধর্মান্ধ। শিক্ষা মানুষের জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন ঘটায় কিন্তু ধর্মের অন্ধত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে না। মানুষের জীবন, রাজনীতি, চিন্তাভাবনা সব কিছুর মধ্যেই ঢুকে পড়ে মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সেই অতীতকালে কিছু চালাক মানুষের তৈরি ‘ধর্ম’।

ধর্ম আমাদের অন্য ধর্মের মানুষের থেকে আলাদা করে দেয়। ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। আর সম্প্রদায় থেকেই আসে সাম্প্রদায়িকতা। অনেকে মুসলমান ধর্মের লোকজনকে বিশ্ব সন্ত্রাসের জন্য দায়ী করেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল সব ধর্মই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ায়। প্রকট বা প্রচ্ছন্ন ভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়াটাই ধর্মের উদ্দেশ্য। ধর্মের প্রধান কাজই নিজের আখের গুছানো আর অন্য ধর্মের নামে কুৎসা রটানো। পৃথিবীতে এমন কোনও ধর্ম নেই যেটা বলে অন্য ধর্মগুলোও ভালো আর মঙ্গলকর। বরং সব ধর্ম এই শিক্ষা দেয়, যে সেই ধর্মই একমাত্র ভালো আর সব ধর্মই ভয়ংকর খারাপ। এভাবে মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে যত লেলিয়ে দেওয়া যায় ততই জ্বলে ওঠে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ।ধর্ম ব্যবসায়ীরা মনের আনন্দে এই আগুন জ্বালিয়ে রাখে আর সাধারণ মানুষ পোকার মত আত্মাহুতি দেয় নিজের বাড়ি, পরিবার এমনকি জন্মভূমিও।

আমাদেরকে বলতে হয় না আমরা আগুনে বিশ্বাস করি, বা জলে বিশ্বাস করি।আগুনে বিশ্বাস করে আগুনে হাত দিলেও হাত পোড়ে, আগুনে অবিশ্বাস করে হাত দিলেও হাত পুড়ে যায়। জলে ডুবে যাওয়ার সাথে জলকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নেই। সুতরাং, যা কিছুর প্রকৃত অস্তিত্ব আছে তা আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের তোয়াক্কা করে না। যার অস্তিত্ব নেই তাকে আমাদের বিশ্বাসে ভর দিয়েই বেঁচে থাকতে হয়। আমরা যদি ভূত, প্রেত, জীন, পরি, হুর, ঈশ্বর এসবে বিশ্বাস না করি, তাহলে এদের কোনও অস্তিত্বই থাকে না আর। আর তাই আমরা ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ বললেই ধর্ম ব্যবসায়ীরা রে রে করে তেড়ে আসে। আমাদের অন্ধত্বই তাদের ব্যবসার প্রধান মূলধন। মানুষের মধ্যে যত বিদ্যা বুদ্ধি ও বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটে ততই অন্ধকার দূরে সরে যায়। অন্ধবিশ্বাস যত দূরে সরে যায়, প্রকৃত সত্য তত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। প্রকৃত শিক্ষা আমাদেরকে অন্ধবিশ্বাস ত্যাগ করে যুক্তিবাদী হতে অনুপ্রেরণা দেয়।

ঈশ্বর একটা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কেউ অলীক অবাস্তব কল্পনা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। কেউ চায় না। জোর করে কারো উপরেই কিছু চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অলীক ঈশ্বরের কল্পনাতে যারা খুশি থাকেন তারা অন্যদের উপরে সেটা চাপিয়ে দিতে চান। একটা শিশু কোনো ধারণা নিয়ে জন্মায় না। তার জন্মের পরেই তাকে অন্ধবিশ্বাসী করে তোলার জন্য উঠেপড়ে লাগে বাবা মা ও সমাজ। তার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় তার বাবা মায়ের পালিত ধর্ম। তার ভালো লাগা মন্দ লাগাকে আমল দেওয়া হয় না। বড় হয়ে নিজের যুক্তি-বুদ্ধি প্রয়োগ করে কেউ যদি কাল্পনিক অলীক ভাবনা নিয়েই খুশি থাকতে চায়, সেটা তার নিজের পছন্দের ব্যপার। কিন্তু কারো কোনো রাইট নেই তার নিজের কাল্পনিক ধারণা অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়াতে। এই যে ‘নাস্তিক’ শব্দটা, এটাও জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শব্দ। যারা ঈশ্বরের কাল্পনিক অলীক ধারণাতে বিশ্বাস করে তাদের বলা উচিত 'কল্পনা বিলাসী ভাবুক মানুষ'। যারা তা বিশ্বাস করে না তারা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। কিন্তু এই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদেরকেই 'নাস্তিক' বলে দেগে দিয়েছে অন্ধবিশ্বাসী মানুষেরা। যেহেতু তারাই দলে ভারি তাই এটা তারা করতে পেরেছে। তবে এটা অন্যায়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব একমাত্র অলীক কল্পনার জগতে। ঠিক আলাদিনের দৈত্য, রূপকথার গল্পের নায়ক, পাখা ওয়ালা ঘোড়া, ঘোড়ার ডিম বা আকাশ কুসুমের মতোই অবাস্তব কল্পনা হল ঈশ্বর। কেউ এগুলোকে নিয়ে ভাবনার জগতে থাকতেই পারে, এটা তার নিজের পছন্দ। কিন্তু সেটা অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়া, বিশেষ করে শিশুর উপরে চাপিয়ে দেওয়া চরম অন্যায়। এজন্য নিজে অন্ধবিশ্বাসী হলেও বাড়ির শিশুদের মধ্যে সেই অন্ধবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেবেন না। তাদেরকে ঠাকুর পুজো, নামাজ, প্রার্থনা ইত্যাদিতে অভ্যস্ত করানো মানেই অন্যায়ভাবে আপনার অন্ধবিশ্বাস তাদের কোমল মনে ঢুকিয়ে দেওয়া। এটা অনুচিত। ঠিক এই অন্যায়টাই কিন্তু ছোটবেলাতে আমাদের সবার সঙ্গে হয়েছিল। আগামী প্রজন্মকে কী আমরা এই ধরনের অন্যায়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারি না?

প্রশ্ন করতে শিখলে প্রথমেই আপনার মনে যে প্রশ্নটি আসবে, সেটা হল ঈশ্বর আছে না নেই? উত্তরে আপনি হয়তো ভাববেন নিশ্চয়ই আছে, নাহলে এত সুন্দর জগৎ, এত জীবজন্তু, মানুষ, গাছপালা  কীভাবে তৈরি হল? সবই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে। কোনো কিছুই একা একা তৈরি হতে পারে না। প্রশ্ন করতে শিখলে এরপরে আপনার মনে আসবে, তাহলে ঈশ্বরকে কে তৈরি করল? এর উওরে যদি আপনার মনে আসে ঈশ্বর একা একাই তৈরি হতে পারে, তখন আপনার মনে প্রশ্ন আসা উচিত যদি ঈশ্বর একা একাই তৈরি হতে পারে, তাহলে জগতেরই বা একা একা তৈরি হতে বাধা কোথায়? সুতরাং প্রশ্ন করতে শিখলেই উত্তর পাওয়া যায়।

প্রশ্ন করতে শিখলে আপনার মনে হবে ভগবান আল্লা বা গড কী একই না আলাদা? যদি একই হয় তবে এতগুলো ধর্ম আর এত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ কেন বানাতে বা লিখতে গেল ঈশ্বর?যেহেতু  বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে একটুও বনিবনা নেই, কাজেই এগুলো বিভিন্ন গড,আল্লাহ বা ভগবানের তৈরি। এত বিভিন্ন গড ঈশ্বর বা আল্লাহরা তাহলে নিজেদের মধ্যে মারামারি না করে আমাদের মধ্যে কেন মারামারি বাধিয়ে দেয়? প্রশ্ন করতে শিখলে আপনার মনে হওয়া উচিত, ভগবান এসে গীতা কোরান বাইবেল এতসব বই প্রাচীন কালে লিখে গেছিল, এখন আর নতুন বই লিখছে না কেন ভগবান বা গড বা আল্লাহরা? প্রশ্ন করতে শিখলে এসব প্রশ্নগুলো মনে আসবেই। এই যে আগের দিনে এত এত অলৌকিক বাবা, সাধু, ফকিরেরা ছিলেন, এখন আর কেউ তেমন নেই কেন? বিজ্ঞানের উন্নতি হতেই অলৌকিক বাবাদের কেরামতি সব ফুরিয়ে গেল কেন? বেদে বা কোরানে সব বিজ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বেদ বা কোরানের সাহায্যে সামান্য একটা মগ বা সূঁচ অবধি আবিষ্কার করতে পারল না কেন কেউ? বিজ্ঞান যেই কিছু আবিষ্কার করে, তার পরেই কেন সেই আবিষ্কারের সঙ্গে বেদ বা কোরানের আয়াত বা সুরার মিল পাওয়া যায়? আগে থেকে বেদ বা কোরানের অনুসারীরা কেন কিছুই আবিষ্কার করতে পারে না? প্রশ্ন করতে শিখলেই উত্তর পাওয়া যায়।

প্রশ্ন করতে শিখলে আপনার মনে আসতে পারে, আপনি কে? উত্তর হিসাবে আপনি ভাবতে পারেন আপনি দেহ নন, আপনি আত্মা, অর্থাৎ আপনিই ঈশ্বর। আপনি ঈশ্বর হলে অন্যরাও ঈশ্বর। আবার পিঁপড়ে হাতি কৃমি জীবাণু একই যুক্তিতে ঈশ্বর। আমার আপনার মলের মধ্যে কোটি কোটি জীবাণু বা ঈশ্বর বেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। সুতরাং ঈশ্বরকেই আমরা নিজেরা ঈশ্বর হয়েও মলত্যাগের মাধ্যমে ত্যাগ করছি! বাঘও ঈশ্বর, হরিণও ঈশ্বর। এক ঈশ্বর আরেক ঈশ্বরকে খাচ্ছে। ঈশ্বরই ঈশ্বরের শত্রু। সুতরাং প্রশ্ন করতে শিখলেই আপনি বুঝতে পারবেন আপনি ঈশ্বর টিশ্বর নন, আপনি একটা মানুষ, বাঘটা বাঘই, হরিণটা হরিণই, এবং জীবাণুগুলো জীবাণুই। আপনি আত্মা টাত্মা নন, আপনি আপনিই। একটা মানুষ। দুদিন পরে মারা যাবেন। মৃত্যুর পরে আপনার আত্মা স্বর্গ বা নরক কোত্থাও যাবে না। মৃত্যুতেই সব কিছুর শেষ হয়ে যাবে। স্বর্গ বা নরকের ভুল ধারণা আপনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে কিছু ধান্দাবাজ ভণ্ড মানুষেরা। প্রশ্ন করতে শিখলে কেউ মৃত্যুর পরে স্বর্গ বা নরক বোঝাতে এলে তাকে জিজ্ঞেস করুন সে স্বর্গ বা নরকের ব্যাপারে কীভাবে জানল? সে কি গিয়ে দেখে এসেছে? সে যদি অন্য কারো থেকে স্বর্গ বা নরকের ব্যপারে শুনে থাকে  সেই অন্য কেউ কী গিয়ে দেখে এসেছে? কেউ-ই যখন মরার পর স্বর্গ বা নরক থেকে ফিরে আসেনি তখন এই কাল্পনিক আজগুবি গল্প যারা রটিয়েছিল তাদেরকে কী আপনি ভণ্ড বলবেন না? প্রশ্ন করতে শিখলে আপনি ঈশ্বরকে মরার পরে স্বর্গ  বা অন্যান্য সুখের লোভ দেখানোর চেয়ে জ্যান্ত অবস্থাতে সুখ দিতে কেন বলবেন না? ঈশ্বর এল আইসির প্রিমিয়ামের মতো জ্যান্ত অবস্থায় শুধু স্যাক্রিফাইসই করতে বলে কেন? শুধু মরার পরেই বেনিফিট দেবে যে পলিসি তার কী-বা প্রয়োজন? প্রশ্ন করতে শিখলে আপনি ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করবেন সে এত লাজুক কেন? যদি আছেই, তো সামনে আসতে এত ভয় বা লজ্জা কীসের? সবই দেখছে, সবই করছে, কিন্তু নতুন বউ বা লজ্জাবতী লতার চেয়েও লাজুক ঈশ্বর সামনে এসে মুখটা দেখাতে পারে না কেন? এভাবে প্রশ্ন করতে শিখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, ঈশ্বর এক গল্পের গরু যাকে গাছে তুলেছিল কিছু ধান্দাবাজ চালাক মানুষ। তারাই ছিল ধর্ম ব্যবসায়ী বা ধর্ম প্রচারক। আলাদিনের প্রদীপের রূপকথার গল্পের মতো গল্প ফেঁদে ঈশ্বর নামক ঘোড়ার ডিমকে নিয়ে আজও ব্যবসা করে চলেছে কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী।

প্রশ্ন করতে শিখলে সবই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। সুতরাং যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন করতে শিখুন।

'অহম্ ব্রহ্মাস্মি' বা আমিই ঈশ্বর। ‘তত্ত্বমসি’ বা তুমিই ঈশ্বর। এই আমি বা তুমি হল প্রাণ। পিঁপড়েরও প্রাণ  আছে। তাই আমি, তুমি ও পিঁপড়ে তিনজনেই ঈশ্বর। এভাবে বাঘ হাতি গণ্ডার ডাইনোসর, এমিবা বা কৃমিদেরকেও ঈশ্বর বলা যায়। কৃমি ছোট ঈশ্বর, গন্ডার, বাঘ বা আমি বড় ঈশ্বর। আমাদের ক্ষুদ্রান্ত্র বৃহদন্ত্র ও পাযু অঞ্চলে যে অসংখ্য জীবাণু থাকে তারা প্রত্যেকেই ঈশ্বর। আমাদের মলের সঙ্গেও প্রচুর জীবাণু বা ঈশ্বর নির্গত হয়।কা রণ, আমি বা তুমি ঈশ্বর হলে জীবাণুও ঈশ্বর। এই হচ্ছে ঈশ্বর বিষয়ক মোদ্দা কথা বা  খেজুরে যুক্তি। কিন্তু আসল কথা হল এগুলো সব কথার কথা। ঈশ্বর একটা গুজব মাত্র যেটা রটিয়েছিল কিছু চালাক ধান্দাবাজের দল। তারা বলেছিল আকাশে গড, ঈশ্বর বা আল্লাহ থাকে আর সেই ঈশ্বরকে মন্ত্র বা প্রার্থনা দ্বারা তুষ্ট করার কায়দা তারা জানে। এরাই হল মোল্লা ফকির পাদ্রী বা পুরোহিত বা ধর্ম প্রচারক। এরাই আজেবাজে ধর্মগ্রন্থগুলো নিজেরা লিখে ঈশ্বরের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এই ঈশ্বরের অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে বেঁচে রয়েছে কৃমির মতো একদল পরজীবী প্রাণী তারাই হল সাধু, সন্নাসী বা মোল্লা ফকির। এরা আজকের এই ফাইভ জির যুগেও ঈশ্বর বিশ্বাস বিষয়ক ঢপ দেয়। সাধারণ মানুষের সরলতা আর অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে এইসব ঢপবাজেরা কেউ কেউ আবার মহাপুরুষও হয়ে উঠেছে! ঈশ্বরকে যেন তেন প্রকারেণ বাঁচিয়ে না রাখতে পারলে এইসব সামাজিক পরজীবী কৃমিরা খাবে কী? এরা না খেয়ে মরবে। তাই ঈশ্বরের বেঁচে থাকাটা জরুরি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কিছু মানুষ দ্রুত জেগে যাচ্ছে। ফলে ঈশ্বরের মনে হয় আর খুব বেশিদিন আযু নেই।

যে কাউকেই খুব সহজে ধর্মীয় মহাপুরুষ বানিয়ে দেওয়া যায়। মানুষ চিরকালই ঈশ্বর ও অলৌকিক ক্ষমতাতে  বিশ্বাস করতে ভালোবাসে। যদি কয়েকজন ব্যক্তি গুজব রটিয়ে দেয় কোনো একজন মানুষের অলৌকিক ক্ষমতা আছে তখন অন্ধবিশ্বাসী মানুষেরা খুব সহজেই তা মেনে নেয়। কেউই প্রতিবাদ করার কথা ভাবে না। এভাবে প্রচার যত বাড়তে থাকে, মানুষের অন্ধবিশ্বাসও বাড়তে থাকে। এভাবে চলতে চলতে গুজবের অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষটার যখন মৃত্যু হয় তখন ব্যাপারটি আরও জমে ওঠে। এবারে বিভিন্নরকম অলৌকিক ক্ষমতার গল্প রটানো আরও সহজ হয়ে পড়ে। কারণ মৃত ব্যক্তিকে কেউই আর চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। এই সুযোগে আরও জোরদার প্রচার শুরু করে দেয় ভণ্ডের ভক্তের দল। তারা এবারে মৃত ব্যক্তির মূর্তি বানিয়ে সেটাকে পুজো অবধি করতে শুরু করে দেয়। তার নামের সঙ্গে ঠাকুর শব্দটা জুড়ে দেয়। এরপরে যদি আরও প্রচার চালানো যায় তাহলে ধীরে ধীরে ওই ভণ্ড গুরুর টি আর পি শিব কালী ইত্যাদি দেব দেবীর চেয়েও বেশি করে দেওয়া সম্ভব। ঠিকঠাক ভাবে প্রচার বা মার্কেটিং করতে পারলে যে কোনো সাধারণ মানের ভণ্ডকে ধর্মীয় মহাপুরুষ বানিয়ে দেওয়া যায়।

শুধু তাই নয়, প্রচার ঠিকঠাক ভাবে করতে পারলে বাস্তব অস্তিত্বহীন কোনো অলীক কাল্পনিক ব্যক্তিকেও ধর্মীয় মহাপুরুষ বানিয়ে দেওয়া যায়। চাই শুধু জোরালো প্রচার। এরপর দিকেদিকে গজিয়ে ওঠে অলীক বাবার মন্দির, কোটি কোটি অন্ধবিশ্বাসী মানুষ ভিড় জমায় বাবার মন্দিরে। জমে ওঠে ব্যবসা। স্কুল কলেজের শিক্ষা পাবার পরেও মানুষ ধর্মীয় কুসংস্কার আর অজ্ঞানতার অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। এর মূল কারণ স্কুল কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হলেও বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের শিক্ষা দেওয়া হয় না। কুসংস্কার থেকে মুক্তিলাভ করতে বিজ্ঞানকে কীভাবে জীবনে চলার পথে প্রয়োগ করতে হয় সেটার শিক্ষা দেওয়া হয় না। এজন্য ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা গবেষক হবার পরেও ছাত্রেরা থেকে যাচ্ছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন অজ্ঞানতার অন্ধকারেই। ধর্মগুলো যে কিছু চালাক ধান্দাবাজ মানুষ নিজেদের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য প্রচলন করেছিল এমন একটা কথাও তারা নিজেদের ছাত্রজীবনে পড়া বা শেখার সুযোগ পায় না। ঈশ্বর যে কিছু চালাক মানুষের রটানো গুজব ছাড়া আর কিছু নয়, এমন একটা বাক্যও তাদেরকে কখনও শেখানো হয় না। ধর্ম বিশ্বাস বা অন্ধবিশ্বাস যে আমাদের চিন্তাভাবনাকে একপেশে করে দেয়, তা ছাত্রদের শেখানো হয় না। ঈশ্বর বিশ্বাস যে মানুষকে দূর্বল ভাগ্য বিশ্বাসী করে দেয় তা ছাত্রদের শেখানো হয় না। ঈশ্বর বিশ্বাস না করে, জ্যোতিষ তন্ত্র মন্ত্র, তাবিজ, কবজ, মাদুলি, তেলপড়া, জলপড়া,  মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, সাধু, ফকির, পীর, অলৌকিক যাদুমন্ত্রে বিশ্বাস না করে যুক্তিবাদী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠার শিক্ষা স্কুল কলেজে দেওয়া হয় না। উল্টে যে সব শিক্ষক শিক্ষিকারা শিক্ষকতার কাজে লিপ্ত তারা নিজেদের অন্ধবিশ্বাস কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। বিভিন্ন ধর্মীয় পুজোতে,ধর্মীয় মহাপুরুষ বা ধর্ম ব্যবসায়ীদের জন্ম বা মৃত্যুদিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির ব্যবস্থা কুসংস্কারকে আরও বদ্ধমূল করে দেয় শিক্ষার্থীদের মনে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের মুক্তচিন্তা করতে শেখানো হয় না, বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ করে কুসংস্কার মুক্ত হয়ে ওঠার শিক্ষা একদিনের জন্যও দেওয়া হয় না, সেই শিক্ষা ব্যবস্থাতে শিক্ষিত হবার পরে কীভাবে একজন ছাত্র বা ছাত্রী কুসংস্কারমুক্ত, অন্ধবিশ্বাস মুক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে? তারা তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা গবেষক ইত্যাদি হবার পরেও অন্ধবিশ্বাসীই থেকে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। যতদিন না শিক্ষাব্যবস্থাতে বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের প্রয়োগ করতে শেখানো শুরু হবে, অন্ধবিশ্বাসী না হয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখানো শুরু হবে, ততদিন সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা অসম্ভব।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন