রঙ্গালয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত
(পর্ব – ২)
গতদিন যে প্রশ্নে এসে লেখাটা শেষ করেছিলাম সেটা ছিল ধনী বাবুদের শখের ও ইংরেজি ধাঁচের নাট্যচর্চায় কতটুকু যোগ ছিল কলকাতার সাধারণ নিম্নবিত্ত বাঙালির৷ কেন এই প্রশ্ন বারবার থিয়েটারের ইতিহাসে উঠে এসেছে, আগে তা একটু বিস্তৃত বলি। আসলে উনিশ শতকের গোড়া থেকেই কলকাতা শহরে বৃত্তিগত স্বাধীনতা বা occuupational freedom তৈরি হওয়া এবং সেই সঙ্গে জমিদারদের গ্রাম ছেড়ে ক্রমাগত শহরে বসবাসের ফলে তাদের বিত্ত ও বিলাস কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল এই থিয়েটারে। বিনয় ঘোষ বলছেন – “উনিশ শতক শেষ হতে দেখা যায়, কলকাতা শহরের আঞ্চলিক রূপায়ন খানিকটা বৃত্তিপ্রধান রূপ (dominant occupational zones) ধারণ করেছে। এর ফলে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কলকাতা শহরের কূলগত বৃত্তিবন্ধন একেবারে ছিন্ন না হলেও অন্তত বেশ খানিকটা শিথিল হয়ে যাচ্ছিল”।
ফলে থিয়েটার করতে যাঁরা উদ্যোগী হলেন, দেখা যাচ্ছিল সেখানেও নাট্যশালাগুলোর যাবতীয় আর্থিক দায়ভার কখনো এককভাবে একজন ধনী ব্যক্তি বা কখনো বা তাঁরই দু একজন সহযোগী মিলেমিশে নিচ্ছিলেন। আর যেহেতু থিয়েটারে অর্থখরচের দায়িত্ব একজন ধনী ব্যক্তিই নিতেন এবং স্বচ্ছন্দে নিতেন, সেহেতু সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনই মনে করেনি এই অবাণিজ্যিক থিয়েটার। অর্থের ঘাটতি না থাকায় থিয়েটার করে অর্থপ্রাপ্তি বা উপার্জনের প্রত্যাশাই জন্ম নেয়নি তখন থিয়েটারে। প্রায় উনিশ শতকের অর্ধভাগ জুড়েই উচ্চবিত্তশাসিত এই থিয়েটার সাধারণ মানুষের রুচি ও ভাবনাকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পেরেছিল, যা স্বয়ং লিয়েবেদিয়েফও পারেননি। টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা তো ছিলই না, আমন্ত্রণমূলক অভিনয়ের বাতায়নগুলো ছিল পুরোপুরি মঞ্চমালিকের সহচর ও পরিজনবর্গের আওতায় - বলা ভালো কব্জায়। আরো বলে নেওয়া যেতে পারে, কিছু বিশেষ দর্শক ছাড়া ইংরাজি বা সংস্কৃত নাটকের দুরূহ অনুবাদ শুধু নিম্নবিত্ত কেন, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের কতদূর বোধগম্য হচ্ছিল, এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। এমনকি সাহেবরাও যে এসব অভিনয় দেখে খুশি হয়েছিলেন, তার প্রমাণ নেই। খানিকটা
আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রভূত অর্থগরিমায় সমৃদ্ধ একটি ব্রিটিশ-অনুগৃহীত সম্প্রদায়ের আত্মশ্লাঘা সামান্য মাত্রায় স্ফীত হয়েছিল কেবল। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত জনসংযোগবিচ্ছিন্ন এইসব অসংগঠিত নাট্যপ্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ছবি পাওয়া যায় অধ্যাপক মন্মথমোহন বসুর লেখায় ৷ অধ্যাপক বসু লিখছেন “গণশিক্ষার বাহন ও ভগবৎপ্রেমের পরিবেশকরূপে যাত্রা ছিল আমাদের একটি শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেইজন্য যাত্রার আসরে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু অভিজাত-সম্প্রদায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নবযুগের রঙ্গালয় সমূহে নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণ দূরে থাকুক, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভদ্রলোকগণ পর্যন্ত সহজে প্রবেশ লাভ করিতে পারিতেন না ৷ সেগুলিতে কেবল পরিচালকবর্গের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ব্যতীত সম্ভ্রান্তব্যক্তিগণ ও সাহেবসুবারা নিমন্ত্রিত হইতেন এবং সাহেবদের প্রশংসালাভের জন্য তাহারা এত ব্যগ্র ছিলেন যে, যে সকল সাহেব অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাদের থিয়েটার দেখিতে আসিতেন তাঁহাদের বোধ ও সৌকর্য্যার্থ বহুব্যয় করিয়া অভিনীত নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করাইতেও তাঁহারা কুণ্ঠিত হইতেন না”।
তবুও ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটল। আত্মসঙ্কট থেকেই বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকদের আত্ম-আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটল। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমঝোতায় অবিশ্বাস দানা বাঁধতে শুরু করল -- পেশা ও জীবিকা নিয়ে শাসক শাসিতে মনোগত লড়াইটা অন্তত বড় হতে লাগল। ১৮৫৮-এ হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বুদ্ধিজীবী এই সময়ের সবথেকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলেন তাঁর ‘Who is to blame’ প্রবন্ধে। কী ছিল সেই প্রশ্নগুলো? দেখে নিই একবার --
১) ইংরাজের প্রতি ভারতবাসীর অন্তরে সংগোপনে সঞ্চিত হচ্ছে ক্ষোভ ও ঘৃণা ৷ এর জন্য দায়ী কে?
২) ভারতবর্ষে
শাসক ও শাসিতে পারস্পরিক বিদ্বেষ বিস্তৃত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে?
৩) ভারতে বর্তমান
শাসকেরা নরম্যানদের ঘৃণা করলেও এখন নিজেরাই ঘৃণার পাত্র। এর জন্য দায়ী কে?
আজ এই অব্দি ৷ পরের দিন বলব ১৮৫০-৭৬ এই দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের বাঙালি ভদ্রলোকদের সামূহিক রদবদলের কথা, যা কিনা নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলেছিল বাঙালির নাট্যবিষয় নির্বাচনে, নাট্যসংগঠনের নতুন রূপ ও ইতিহাস নির্মাণে।
এই পর্বের উৎসনির্দেশ :
১) বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (১৮০০-১৯০০), সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র গ্রন্থমালার শেষ (পঞ্চম খণ্ড), নভেম্বর ১৯৬৮, গ্রন্থকার ৷
২) মন্মথমোহন বসু, বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫৯ ,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
৩) Nares Chandra Sen Gupta ed. Selections from the Writings of Hurrish Chunder Mookerj, Compiled from the Hindu Patriot, The Cherry Press, Dhurrumtola.
বাঙ্গলা নাট্য মঞ্চের ঐতিহাসিক যাত্রা পথের চড়াই উৎরাই এর বস্তুনিষ্ঠ বর্ণণা উপভোগ করছি।
উত্তরমুছুন