কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২০ |
রঙ
অদ্রীশ একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। কোনো এক ঘরোয়া উৎসবে কেউ একজন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, “এ বাড়ির সবাই ফর্সা, তুই এমন কাউয়া-কালো কীভাবে?” অদ্রীশ ওর প্রয়াত ঠাকুরদা’র রঙ পেয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে ব্যাখ্যানের আগেই নেমন্তন্নে আসা পাশের ফ্ল্যাটের কাশেম সাহেবের পুত্র, অদ্রীশের সহপাঠী, রফিক, এই শব্দবন্ধটি লুফে নিয়েছিল। অতঃপর বিকেল না-হতেই বিল্ডিঙের সমস্ত বাচ্চা ‘কাউয়া কালা’ সুর কাটতে লেগে গিয়েছিল। রফিকেরই কাজ, বুঝেছিল সবাই। কাশেম সাহেবের কাছে নালিশ চলে গিয়েছিল তুরন্ত। কড়া শাসন করেছিলেন তিনি। ফলাফল? পরদিন স্কুলেও পৌঁছে গিয়েছিল সেই নাম।
এর পরেই ঘরে-বাইরে সবখানে অদ্রীশের জীবন দূর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। সবচেয়ে কঠিন ছিল ভ্যানগাড়িতে অন্যদের সঙ্গে ওকে স্কুলে পাঠানো। এ নিয়ে নিত্য অশান্তি লেগে থাকতো। একদিন সকালে বকাঝকায় কাজ না হওয়ায় পিটিয়েছিলেন বাবা। তারপরেও স্কুলে যায়নি সে। বাবা অফিসে চলে গেলে সবার অগোচরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল অদ্রীশ। ভাগ্যিস ভ্যানগাড়ির চালক মনু মিয়া দেখেছিল! বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছিয়ে ফেরার পথে উদ্ভ্রান্ত অদ্রীশকে দেখে বুঝে ফেলেছিল- ঘটনা গড়বড়। অনেকটা জোর করেই ফিরিয়ে এনেছিল বাড়িতে। রফিকের বাবা-মা বিকেলেই রফিককে মাফ চাইতে নিয়ে এসেছিলেন - “অতঃপর বালকেরা হরিহর আত্মা বনিয়া গিয়াছিল”- শেষ বাক্যটি বলেই বেশ নাটকীয়ভাবে তিনি অদ্রীশকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি মানে রফিক। তাঁর বাড়িতেই ঈদের ভোজ আজ। আমন্ত্রিত অতিথিদের ওদের পরস্পরকে খুঁজে পাওয়ার গল্পটি শোনাতে গিয়েই অদ্রীশের বাড়ি পালানোর ঘটনাটি বললেন। আমি যারপরনাই অবাক হলাম; আমার বিয়ের উনিশ বছরে ওদের বাড়ির কারো মুখে এই ঘটনা শুনিনি। আমার চোখ জ্বলছে।
এই শহরে ওরা ছিল একসময়, জানতাম। শ্বশুরমশাই বদলি হয়েছিলেন রাজধানীতে। অদ্রীশ তখন ক্লাস সেভেনে। অদ্রীশের নতুন পোস্টিঙয়ের সূত্রে দুই বছর আগে আবার এই শহরে ফেরা আমাদের। ক’দিন আগে ব্যাংকের ম্যানেজারের কক্ষে রফিক সাহেবের সঙ্গে অদ্রীশের দেখা। অদ্রীশ গিয়েছিল চেক জমা দিতে, তিনি গিয়েছিলেন ডলার ভাঙাতে। ম্যানেজার সাহেব তাঁর প্রবাসী দামী ক্লায়েন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই পঁয়ত্রিশ বছর আগের বালকবেলা আড় ভেঙেছিল।
সেই সন্ধ্যাতেই তিনি আমাদের বাসায় চলে এসেছিলেন। অনেক গল্প করেছিলেন। বেশিরভাগই তাঁর আমেরিকার জীবনের গল্প। জেনেছিলাম দেশে অনেক লগ্নি তাই মিলেঝুলে থাকেন এদেশ-ওদেশে। ওদের ছেলেবেলার গল্পও হয়েছিল। আশ্চর্য! এই গল্প ওদের আলাপে আসেনি!
আমি ফর্সা বলেই অদ্রীশের বাবা-মা
আমায় পছন্দ করেছিলেন; এতে লুকোছাপা ছিলো না কোনো। আর আমার নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা-মা, বিনা-যৌতুকে ‘সুপাত্রে’
কন্যাদানকেই সৌভাগ্য ভেবেছিলেন।
প্রথম সন্তানের সময় দেয়ালজুড়ে অগুন্তি
সাদা শিশুর ছবিকে আদিখ্যেতা ভেবেছিলাম। আমাদের প্রথম সন্তান ঋভু ফর্সা না হলেও অদ্রীশের
মতো কালো হয়নি।
ঋভুর জন্মের সাতমাস পরেই টের পেলাম,
ফের মা হচ্ছি। বাচ্চার রঙ নিয়ে অদ্রীশের উৎকণ্ঠা তখন আমার অস্বাভাবিক লাগছিল।
আল্ট্রাসনোতে আমাদের মেয়ে আসছে
জেনে বলেছিলাম, ফর্সা হলে নাম রাখব রাই আর কালো হলে কৃষ্ণকলি। অদ্রীশ আঁতকে উঠেছিল।
বলেছিল, “রাইয়ের কথাই ভাববে”।
কৃষ্ণকলি জন্মেছিল - প্রাণহীন,
নিথর।
বুকে মোচর দেয়ার মতো যন্ত্রণার অনুভব হলো...
উত্তরমুছুন"অদৃশ"! পড়লাম রন্জনাদি । বুকে মোচর দেয়ার মতো যন্ত্রণা করে উঠলো। ___ সুপ্তা
উত্তরমুছুন