হস্ত্-এ-হায়দরাবাদ
ইতিহাস খুঁজতে গেলে হাজার বছর পেরোবে। শহরটিকে এখন লোকে 'হায়দরাবাদ' নামে চেনে। মধ্যযুগের আগে তার যাই পরিচয় থাক, মুঘল পর্ব থেকেই তার নামডাক। দু'দল তুর্কো-ইরানি ভাগ্যান্বেষীর দৌলতে গড়ে উঠেছিলো এই শহর। ষোলো শতকের গোড়ায় কুতব শাহি শাসন বাহমনিদের থেকে দখল নিয়েছিলো গোলকুণ্ডা দুর্গের। পঞ্চম সুলতান মহম্মদ কুলি কুতব শাহের সময় থেকে দক্কনে সে কালের বিচারে একটা নতুন ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন হয়। যাকে এদেশের ইতিহাসে গঙ্গা-জমনি তহজিব বা সংস্কৃতি বলা হয়ে থাকে।
মহম্মদ শাহ ছিলেন যেন একজন উপকথার সুলতান। কবি, শিল্পী, সংস্কৃতি প্রেমী, উদার-হৃদয় নৃপতি, যাঁর সৃষ্টি এই হায়দরাবাদ শহর। কুতবশাহি শাসকদের মধ্যে মহম্মদ কুলি ছিলেন সব চেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্র।
মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি সুলতান হ'ন। তাঁর বৃহত্তম কীর্তি ১৫৯১ সালে মুসিনদীর দক্ষিণ তটে ভাগ্যনগর (হায়দরাবাদ) শহরের পত্তন আর চারমিনার নির্মাণ। তিনি ছিলেন কবি-রাজা। নিজে উর্দু, তেলেগু আর ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। ফারসি 'দিওয়ান' শৈলী তিনিই প্রথম ‘রেখতা’-য় (উর্দুভাষা) নিয়ে আসেন। তাঁর নিজের কাব্যশৈলীর নাম ছিল গ়জল-ই-মুসলসল'। আঠেরোশো পাতা দীর্ঘ 'কুল্লিয়ৎ-এ-কুলি কুতব শাহ' নামের কাব্যগ্রন্থটি তিনি রচনা করেছিলেন। তাঁর আগে পর্যন্ত এদেশে ফার্সি কবিতায় শুধু ঈশ্বরভজনা ছাড়া আর কোনও বিষয় ছিলোনা। তিনি বিষয়বৈচিত্র্যে ফার্সি কাব্যভুবনকে ভরিয়ে তোলেন। ঋতু, ফুলফল, তরিতরকারি, উদ্যান, সামাজিক জীবন ও প্রথা, উৎসব ইত্যাদি বিষয় নিয়েও যে লেখা যায়, আগে কেউ ভাবেনি। সবার উপরে ছিলো মানসিক উদারতার প্রসার। তাঁর দিওয়ানে (কাব্যসংগ্রহ) গ়জল, কশিদা, মসনবি, মর্সিয়া , সব ধরনের উর্দু কবিতা সংকলিত ছিল। স্থানীয় দেবদাসী নর্তকী ভাগ্যমতীর সঙ্গে তাঁর প্রণয়কাহিনী যদি সত্যি হয় তবে পৃথিবীতে আর এমন কোনও রাজা পাওয়া যায়না, যিনি তাঁর প্রণয়িনীর নামে শহরের নামকরণ করেছিলেন। বিশেষ করে সবাই জানেন মধ্যযুগে তুর্কি শিয়া মুসলিম সুলতান আর হিন্দু দয়িতা'র সম্পর্ক কখনও উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। পরবর্তীকালে বাদশা ঔরঙ্গজেবের চাপে শহরের নাম পাল্টে ভাগনগর থেকে হায়দরাবাদ করা হয়েছিল। তাও অবশ্য ভাগ্যমতীর নামেই। সুলতান মহম্মদ কুলি তাঁর কাব্যে ভাগ্যমতীর কাব্যিক নাম দিয়েছিলেন হায়দরমহল। ভাগমতীর নামাঙ্কিত একটি দেবী মন্দির এখনও চারমিনারের ভিতর রয়েছে। গোলকোণ্ডায় ছড়িয়ে আছে ভাগমতীর নামে নানা পুরাকীর্তি। গোলকোণ্ডা কিলার চূড়ায় রাজার দিওয়ান-ই-খাস প্রাসাদ বারাদরি থেকে সোজা দেখা যায় ভাগমতীর প্রাসাদ ।
ভাগমতীর এই গল্পটির অবশ্য কিংবদন্তি হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। নামকরণের দুটি উৎস থাকতে পারে। এক চতুর্থ খলিফা আলির উপাধি ‘হায়দ্র’ থেকে। অথবা ফার্সি ,'হায়দর' অর্থে সিংহপ্রতিম বীর্যবান। তাঁর আশা ছিলো নতুন বসতিটি বীরপুরুষদের শহর হবে। এছাড়া 'ভাগনগর' শব্দটি সম্ভবত 'বাগনগর' অর্থাৎ উদ্যানপূর্ণ নগরী হিসেবেই দেওয়া হয়েছিলো। কারণ যাই হোক, মহম্মদ কুলি কুতব শাহের শাসনপ্রণালীর কিছু এই দিকটা বেশ কৌতুহল জাগায়। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার ছাপ ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে গেছে।
তাঁর সময় দিল্লির অধীশ্বর ছিলেন বাদশাহ আকবর। মানসিকতার প্রসার বিচার করতে গেলে মহম্মদ শাহের চিত্তসম্পদ ও উদারতা গ্রেট মুঘল আকবর বাদশাহকেও ছাপিয়ে যেতো। যেসব দূরদর্শী মুসলিম শাসকদের প্রযত্নে এদেশে আক্রমণকারী বিদেশী রাজাদের ধর্ম ইসলাম বা তাঁদের ভাষা ফার্সি, দেশীয় ধর্মসংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বিত হয়েছিলো, মহম্মদ শাহ ছিলেন তাঁদের অগ্রপথিক। তাঁর সময়েই গোলকোণ্ডা রাজত্বে তেলুগু, রাজভাষার মর্যাদা পেয়েছিলো। এই সুলতান সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল ও প্রীতি বহুবিস্তৃত। হায়দরাবাদি ইতিহাসের একজন প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত নরেন্দ্র লুথার রচিত 'Muhammad Quli Qutb Shah- The Founder of Hyderabad' আগ্রহীদের অবশ্য পাঠ্য। হিন্দু-মুসলিম সমন্বিত সভ্যতার যে ধারণা আমাদের স্বপ্ন, তার কিছু রূপরেখা পাওয়া যাবে এই সুলতানের সৃষ্টিশীল আকাঙ্খার মধ্যে। তাঁর তৈরি করা পরম্পরার সুবাদে।
আঠেরো শতকের গোড়ায় বাদশাহ অওরঙ্গজেবের সেনাপতি মির কমরুদ্দিন সিদ্দিকি আসফ জাহ গোলকোণ্ডা দখল করে পত্তন করেছিলেন নতুন রাজবংশ। উপাধি নিয়েছিলেন নবাব নিজাম উল-মুল্ক। এই নবাবরা রাজত্ব করেন ১৭১৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হতে তাঁরা স্বাধীন নৃপতি হয়ে গিয়েছিলেন। সুচতুর রাজনীতির দৌলতে তাঁরা নতুন শাসক ব্রিটিশদেরও বশ করে ফেলতে পেরেছিলেন। বহুকাল ধরে বিশ্বের এক নম্বর ধনী ব্যক্তি হয়ে স্বীকৃত ছিলেন একাধিক নবাব নিজাম। তাঁদের ইতিহাসও খুব আকর্ষণীয়।
গোলকোণ্ডা আর কুতুবশাহি নবাবদের শানশওকত নিয়ে অনেকেই রীতিমতো রোমাঞ্চিত বিবরণ লিখে গেছেন। বিশেষ করে অ্যাবি কার বা ট্যাভারনিয়ের সাহেব তো উচ্ছ্বসিত চিলেন। নিজামদের সম্পর্কে সেরকম উল্লেখযোগ্য বর্ণনা সংখ্যায় অনেক কম। হয়তো কিংবদন্তি হয়ে ওঠার মতো উপাদান তাঁদের মধ্যে কম ছিলো। কিন্তু দুচার জন লিখিয়ে নিজামদের আমল নিয়ে রম্য আলোচনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একটি প্রধান নাম মির্জা তসদ্দুক হুসেন। তকল্লুফ, সিদ্ক জইসি। উত্তর প্রদেশে বরেলির কাছে জইস গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে হায়দরাবাদে নিজামের দরবারে এসেছিলেন। মুরুব্বি ধরেছিলেন নিজাম মির ওসমান আলি খানের কবিতা শিক্ষক নবাব ফসাহত জং জলীল মানকপুরি'কে। কিন্তু ভাগ্য তাঁর প্রতি সদয় ছিলো না। বহুদিন অপেক্ষা করার পর নিজামের ওয়জির-এ-আজম মহারাজা কিশন পরসাদের অনুগ্রহে ইশকুল শিক্ষকের চাকরি পেয়েছিলেন। পরে হায়দরাবাদ থেকে বদলি হয়ে অওরঙ্গাবাদে যেতে হয়েছিলো তাঁকে। সেখান থেকে অবসর নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামে। কানপুরে তাঁর ইন্তেকাল হয়।
হায়দরাবাদে থাকাকালীন সকালবেলা তাঁর কাজ ছিলো ইশকুলে পড়ানো। আর সারা রাত ধরে নবাবজাদা মির শুজাত আলি খান বা মুয়াজ্জম শাহের নৈশ দরবারে হাজিরা দিতেন। সাত বছর ধরে এই কাজ করার দরুন নিজামশাহি ও হায়দরাবাদ সম্বন্ধে তাঁর জানাশোনা বিস্তৃত হয়েছিলো। অবসর নেবার পর দেশে ফিরে গিয়ে তিনি এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে 'দরবার-এ-দরবার' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মেজাজের দিক দিয়ে বইটি আবদুল হলীম শরর-এর 'গুজিশতা লখনউ'-এর সঙ্গে মেলে। সিদ্ক জইসির বইটি উর্দু থেকে ইংরেজিতে তর্জমা করেন হায়দরাবাদ বিশেষজ্ঞ নরেন্দ্র লুথার মশায়। মূল রচনার সঙ্গে, সংক্ষিপ্ত, কিন্তু জরুরি টীকা-টিপ্পনিও যোগ করেছিলেন তিনি। দু হাজার চার সালে The Nocturnal Court-The Life of a Prince of Hyderabad' নামে সেটি প্রকাশিত হয়েছিলো।
সিদ্ক জইসির বইটি আমাদের ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্বের ছবি এঁকে গেছে। সামন্ততন্ত্রী ব্যবস্থার গোধূলি পর্যায়ে চার দেওয়ালের ভিতর এক কৃত্রিম 'রাজকীয়' জগতের ঘেরাটোপে ডুবে থাকা, এক সম্প্রদায়ের মানুষ ঠিক কীভাবে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবররণ থেকে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রাসাদের বাইরে দিন বদলের ঝড়, কিন্তু ভোরের আলো তখনও দূর অস্ত। চিনের শুং রাজা বা ফরাসি মারি আঁতোয়ানেতের মতো দিন কাটানো মধ্যসত্ত্বভোগীরা টেরও পাননি বহির্জগতের টালমাটাল। মজার কথা এই ইতিহাস কোনও দূর রজনীর স্বপন নয়। বিশ শতকের বাস্তবতা।
মওলবি আবদুল হক, যাঁকে আধুনিক উর্দু ভাষার জনক বলা হয়, সিদ্ক জইসিকে বলেছিলেন তাঁর এই স্মৃতিচারণ ইতিহাসের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গেছে। রাজপুত্র ও তাঁর অভিজাত সহচরদের অবক্ষয়ী, পচনশীল যাপনের ছবি বিশ্বস্ত ভাবে ধরে রেখেছ। বইটির ভূমিকায় আবদুল মজিদ দরিয়াবাদি লিখেছিলেন, জইসির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো তাঁর অনন্য কথাবাচনে। প্রমিথিউসের মতো তিনি এক ভুল স্বর্গের ছবি হরণ করে এনে নিজামি সংস্কৃতির অবসন্ন ছায়ার প্রতি সারা দেশের মানুষকে সচেতন করে তুলেছিলেন। আধুনিক উর্দু সাহিত্যের এক বিশিষ্ট অবদান এই গ্রন্থ।
তৎকালীন নিজাম মুআজ্জম শাহের অনুগামীরা সিদ্ক জইসির বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছিলেন। অভিযোগ ছিলো, যেহেতু জইসি উত্তর ভারতের মানুষ, তিনি দক্কন সংস্কৃতির হাল-হকিকৎ জানতেন না। তিনি নিজামের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করেছেন। উর্দু কথাকার মহম্মদ নূরুদ্দিন খান বলেছিলেন জইসি যদি না জানাতেন তবে মানুষের কাছে এই ক্ষয়িষ্ণু, সামন্ততন্ত্রী অবক্ষয়ের গল্প অজানাই থেকে যেতো।
শুধু ইতিহাস বা সমাজতত্ত্ব নয়, হায়দরাবাদের রাজকীয় যাপন ও তৎকালীন দরবারি সংস্কৃতির বিশদ ও বিশ্বস্ত বর্ণনা এই বইটিতে পাওয়া যায়। সভাসদ ছিলেন বলেই সিদ্ক জইসি চাটুকারিতা করতেন না। পরম রসিক ও কাব্যবিশারদ এই মানুষটি তাঁর নামের ('সিদ্ক' মানে সত্য) মর্যাদা রক্ষা করে গিয়েছেন। সিদ্ক জইসির বইটি হায়দরাবাদি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী সবার অবশ্যপাঠ্য।
মাঝের বইটি ডেকান হেরিটেজ ফাউন্ডশনের সৌজন্যে প্রকাশিত, মারিকা সর্দার সংকলিত, গোলকোণ্ডা ও হায়দরাবাদের একটি সহজ, সংক্ষিপ্ত, অথচ মনোরম বিবরণ। সুরেন্দ্র কুমারের আলোকচিত্র শোভিত এই বইটি কোনও মামুলি 'গাইড বই' নয়। কৌতুহলী পাঠক ও পর্যটকের জিজ্ঞাসা নিবৃত্তি ছাড়াও দক্কন সভ্যতার সমৃদ্ধ প্রান্তটির সঙ্গে আন্তরিক পরিচয়ও করিয়ে দেয়। যাঁরা সশরীরে হায়দরাবাদের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, অথবা নেহাৎ আরামকেদারার পর্যটক, উভয়েই হায়দরাবাদ-চর্চার প্রাথমিক সোপান হিসেবে এই তিনটি গ্রন্থের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ হয়ে নিলে প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। এটা নিশ্চিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন