সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

হৈমন্তী রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


ফেরা

 

(১)

দরজা খুলতেই বিদিশার গা গুলিয়ে উঠল। একটা পচা গন্ধ সারা বাড়ি জুড়ে। পাড়ার লোকেদের ইতস্তত জটলা, সবার চোখেই আজ ও অপরাধী। পাঁচ বছর হলো ও এই বাড়ি ছেড়ে অন্য একটা অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকে। আজ পাঁচবছর পর বিদিশা আবার দেখল তাঁকে। ঠান্ডা, শক্ত, ফ্যাকাশে শরীরময় একটা দম আটকানো দুর্গন্ধ। প্রভাময়ী, এই দেহ অভ্রর মা, বিদিশার শাশুড়ি, প্রভাময়ী দেবীর। চোখের কোণটা ভিজে গেল একটু।

মানুষ এক এক সময় কত অসহায়, কতটা একা হয়ে যায়! কেউ জানল না, কতটা কষ্টে, কতটা অসহায়তায় এই নির্জন বাড়িটায় তিনি মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন! মনে মনে কি একবারও তিনি বিদিশাকে পাশে চেয়েছিলেন? কে জানে! কেউ তো জানবে না শেষ সময় এই অসহায়, মানুষটার পাশে কেন সে ছিল না, নাহ, কারুরই জানার কথা নয়। শুধু তিনি জানতেন, আর জানে বিদিশা।

-অনেকদিন পর দেখলাম। সেই যে চলে গিয়েছিলে আর আসোনি বোধহয়, না?

-না, আসা হয়নি।

-মানুষটা অভ্রর মা ছিলেন বিদিশা। তুমি কি এটা…

-এসব কথা বলে কোনও লাভ আছে? যা যা করার সেসব করাটা বেশি দরকার। পোস্টমর্টেম হবে নিশ্চয়ই।

-সে তো হবেই।

 

(২)

সবকিছু মিটতে দুদিন যে কীভাবে কেটে গেল! বাড়িটায় এখন বিদিশা একা। যে বাড়িটা তার কোনওদিনই ছিল না, সেই বাড়ির মালিক সে এখন। কেউ নেই, অভ্র চলে যাওয়ার পর যে কটা দিন বিদিশা এই বাড়িতে ছিল প্রভাময়ী প্রতিপদে তাকে বুঝিয়ে দিতেন সে এখানে কতটা ব্রাত্য, কতটা অপ্রয়োজনীয়।

-এখানে কতদিন থাকবে?

-মানে?

-মানে বুঝতে পারছ না? আমি তো সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি এখানে আর কতদিন থাকবে?

-আপনি কি আমাকে চলে যেতে বলছেন?

-হ্যাঁ। তুমি বুঝতে পারো না? তোমাকে দেখলেই আমার সারা শরীরে আগুন জ্বলে। আমার একমাত্র সন্তানকে খেয়েছ তুমি! আর কি চাও?

-মা!

-ওই নামে ডাকবে না আমাকে। একটা অপয়া মেয়ে! কী দিতে পেরেছ এই সংসার কে? একটা বাচ্চা, সেটাও…

বারান্দা থেকে উঠে এবার শোবারঘরে এল বিদিশা। পাঁচ বছর তিন মাস, হ্যাঁ, আজ থেকে পাঁচবছর তিন মাস আগে এই ঘর তার ছিল। এই ঘরে সে আর অভ্র থাকত।

 

(৩)

অভ্রর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল অফিস ক্যান্টিনে। তারপর বন্ধুত্বে যে কখন ভালোবাসার রঙ লাগল, কীভাবে যে অভ্রর মতো মানুষ বিদিশার প্রেমে পড়ল, কে জানে! অমন সুপুরুষ বিদিশা আগে দেখেনি। সাহেবের মতো গায়ের রঙ, ছ’ফুট দু ইঞ্চি, টিকালো নাক, বড় বড় চোখ, পেটাই চেহারা। বিদিশা ওকে মজা করে বলত,

-তুই তো অভ্র নয়, আর্য। আমার মত অনার্যর প্রেমে পড়লি কী করে বলত?

-তুই ও তো বিদিশা নোস… বাব্বা, যা ঘ্যামা রেজাল্ট তোর! তুই কি আর যেমন তেমন নারী, যাকে বলে পুরো বিদুষী, বস।

বলেই হা হা করে হেসে উঠত অভ্র। দুজনের কী অদ্ভুত মনের মিল ছিল! দুজন দুজনকে এত ভালো বুঝতো, এমন সহজ সম্পর্ক ছিল ওদের মধ্যে, যে ওরা ছাড়া বোধহয় গোটা অফিস জানত ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। তবে ওদের বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। যেদিন প্রথম অভ্র বলল,

-তোর সঙ্গে থাকব ভাবছি।

-কী সব বলছিস পাগলের মতো, থাকবি মানে?

-মানে তো সোজা। তোকে বিয়ে করে নিলেই তো একসঙ্গে থাকা যাবে।

বিদিশা সেদিন অভ্রর মুখটা দেখে এত হেসেছিল যে বেচারা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল  যেন।

-কিরে বস, অন্য কোনও সিন আছে নাকি? থাকলে বল।

-যদি থাকে? কী করবি?

-তাকে কাটিয়ে নিজের জায়গা পাকা করব। আবার কী? তোকে ছাড়া তো আর বাঁচা যাবে না বস। তোকেই চাই।

ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই কন্যাকুমারীর সমুদ্রে অভ্রর ঢেউয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর মুহূর্তেরা ভিড় করে এল চোখের সামনে। হঠাৎ ঢেউয়ে বেসামাল অভ্রর ছবিটা তুলেছিল বিদিশা। সেই মুখময় অনাবিল হাসি! তার ঠিক পাশেই ওদের বিয়ের ছবি।

আজ থেকে আট বছর আগে এক শ্রাবণের রাতে ওদের বিয়ে হয়েছিল। সময়টা ঘোর বর্ষা হলেও সারাটা দিনছিল রোদ ঝলমলে, তেমনই রাতের মেঘহীন তারা বোঝাই আকাশটায় চাঁদেরও ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। পরদিন সকালে প্রভাময়ীর সংসারে বিদিশার অনধিকার প্রবেশ।

বিদিশার মতো মেয়ে প্রভাময়ীর যে একেবারেই পছন্দ হবার নয় তা বিদিশা ক দিনেই বুঝে গিয়েছিল। কোথায় প্রভাময়ীর কল্পনার লাল টুকটুকে বৌ, যা তিনি তাঁর কন্দর্প কার্তিক ছেলের জন্য এতকাল ভেবে এসেছেন, আর কোথায় বিদিশার শ্যামলা রঙ, ছোট চুল, সাদামাটা চেহারা! তারওপর অভ্রর থেকে পাক্কা চার বছরের বড়, পাড়ার লোকজন, আত্মীয় স্বজন সকলেরই একটাই প্রশ্ন মনে,

এই মেয়ের মধ্যে অভ্র কী এমন দেখল যে প্রেমে পড়ল! একমাত্র সন্তানের পছন্দের ওপর যদিও কোনও কথা তিনি বলেননি, বিয়ের পর বিদিশাকে তিনি বহুবারই বুঝিয়ে দিতেন সে অভ্রর পাশে কতটা বেমানান। তাছাড়া বউসুলভ কোনও গুণই তো ওর ছিল না। বিদিশা কাজ পাগল মানুষ, অফিসেই মন, সংসারে অবহেলা কোন শাশুড়িই বা ভালো লাগে? তবে সবথেকে যেটা প্রভাময়ীর অসহ্য লাগত তা হলো বিদিশার প্রতি ছেলের আনুগত্য। মেয়েটা যে কী জাদু করেছিল অভ্রকে কে জানে।

 

(৪)

বিদিশার সঙ্গে কাটানো দুটো মানুষের হাজার স্মৃতি গোটা বাড়িময় ছড়ানো। একে একে কত ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মানুষগুলো আজ নেই, তবুও এই বাড়ির প্রতিটি কোণেই তাদের থেকে যাওয়া, ঘরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে, আলমারীর তাকে রাখা জামার ভাঁজে, বিছানার চাদরে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয়, জানলার গ্রিলে, পর্দার রঙে… ঘরটায় ঢুকেই বিদিশা যেন আর একবার খুঁজে পেল তার অভ্রকে।

-কী ভাবছিস?

-তোর মায়ের কথাটা তোর ভাবা উচিৎ ছিল। উনি তোকে একা হাতে মানুষ করেছেন। সেটা ভুললি কী করে?

-কে বলল ভুলে গেছি। মা আমার কাছে কী সেটা তুই জানিস তো!

-তাহলে আমার মত উড়নচন্ডী বউ কেন আনলি ঘরে?

-তোকে ছাড়া থাকতে পারব না, তাই।

-মা কিন্তু মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছেন অভ্র।

-জানি। তবে মা তো জানে আমার জীবনে তুই কতটা ইম্পর্টেন্ট। তাছাড়া বিয়েতে মা অমত করেনি তো।

-আমি যে বড্ড অন্যরকম। ওঁর মনের মত হওয়া আমার কম্ম নয়।

-কে বলেছে কারুর মনের মত হতে? তুই যেমন ঠিক তেমনটাই যে আমার পছন্দ বস। দেখিস, কোনওদিন পাল্টে যাস না যেন!

হঠাৎ দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে চোখ পড়ল ওর। মুখময় সেই অনাবিল হাসি, চোখদুটোর দিকে তাকাতেই বিদিশার বুকের কাছটায় একটা চিনচিনে ব্যথাঅভ্র, বিদিশার অভ্র, আজ কি ওর মনখারাপ? বিদিশার আজ বারবার মনে হচ্ছে অভ্র বড় কষ্ট পেল, এমনটা তো ও চায়নি। বিদিশাও তো চায়নি, তবু এমনটা তো হলো!

-তুই কি বুঝতে পারছিস, অন্তত তুই নিশ্চয়ই আমাকে ভুল বুঝবি না। তুই তো আমাকে সবথেকে বেশি চিনতিস, বল! জানিস, আজ সবার চোখে তোর বিদিশা অপরাধী।

 

(৫)

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়িতে দুটো বিয়াল্লিশ। এই নিয়ে বার চারের। ঘুম ধরতেই হাজার স্মৃতিরা ঘিরছে, চাপা একটা কষ্টে ঘুম ভাঙছে বারবার। নাহ, আর ঘুমোনোর দররার নেই। বরং বারান্দায় গিয়ে বসলে হয়ত এই গুমোট গরমটা কম লাগবে। এই বাড়িতে এসি নেই। অর্থাভাবে নয়, প্রভাময়ী দেবীর পছন্দ ছিল না ওই ঠান্ডা কনকনে ঘর, পুরোনো আমলের চওড়া দেওয়াল, লাল মসৃণ মেঝে, গাছগাছালি ঘেরা বাড়ির দক্ষিন দিকে একটা পুকুর, সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস করার মত গরমও ছিল না আগে। মনে আছে বিদিশা একবার বায়না করে দুটো এসি লাগাতে চেয়েছিল, একটা ওদের জন্য একটা শাশুড়ি মায়ের ঘরের। আসলে দিনের বেশিরভাগ সময়ই তো অফিসের ঠান্ডা ঘরে থাকতে হয়। বাড়ি ফিরে বেশ কষ্ট হতো।

-তোরা লাগাতেই পারিস, আমার ঘরে ওইসব ঠান্ডা মেশিন ঢোকাস না বাবু।

প্রভাময়ী দেবীর আপত্তির ওপর আর কথা এগোয়নি বিদিশা। এমনিতেই তাকে নিয়ে ভদ্রমহিলা বেশ বিরক্ত, আরও জটিলতা বাড়িয়ে কি লাভ!

এমন হাজারো ত্যাগের পরও বিদিশার জন্য একফোঁটা মায়া ছিল না প্রভাময়ীর। সেই বিতৃষ্ণা চরমে পৌঁছায় যেদিন অভ্র হারিয়ে গেল ওদের জীবন থেকে।

আকাশের এক কোণে এক চিলতে চাঁদ! বাগানে আগাছার জঙ্গলের মধ্যে থেকেও চাঁপার গন্ধ টের পাওয়া যায়! এই বাগান একসময় প্রভাময়ীর যত্নে কত যে রঙীন ছিল! আচ্ছা, এই আগাছা দেখে ওঁর কী খুব কষ্ট হোতো? লোক লাগিয়ে পরিস্কার করতে তো পারতেন! হয়ত সে শক্তিও ছিল না। কেমন ছিলেন শেষ কটা বছর? কখনও অসুখ হলে একাই ডাক্তারের কাছে যেতেন কি? শেষের কটা দিন কি একবারও বিদিশার কথা ভেবেছিলেন তিনি? অভিমানে রাগে হয়ত ফোন করতে পারেননি!

বিদিশা শেষ কবে খবর নিয়েছিল ওঁর? পাঁচ পাঁচটা বছর কোনও যোগাযোগ রাখেনি সেও। অভিমান থেকে? নাকি অপমানের জ্বালা সইতে আপত্তি ছিল তার? অভ্র কি কষ্ট পেত না? ও কি ওপর থেকে অসহায় তাকিয়ে থাকত? অপেক্ষা করত বিদিশা কবে ফিরবে?

কী ভীষণ যন্ত্রণা, কী আত্মগ্লানি!

ঘরে এসে অভ্রর ছবিটা নামিয়ে বুকে চেপে ধরল বিদিশা।

অঝোর ধারায় শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়ছে সে!

মনে পড়ছে হসপিটালে শুয়ে থাকা অসহায় মুখ! কোনওরকমে অভ্র বিদিশার হাতটা ধরে বলেছিল ‘মা’! নাহ, ও বলে যেতে পারেনি মারে দেখিস, কিন্তু বিদিশা তো পারত, ওর সব না বলা কথা বিদিশা বুঝতে পারত। বিদিশা জানে, অ্যাক্সিডেন্টে তালগোল পাকানো রক্তাক্ত শরীরে যেটুকু শক্তি ছিল তাই দিয়ে ও বলতে চেয়েছিল এই গোটা পৃথিবীতে তার মা প্রভাময়ী বড় একা! বিদিশাকে নিয়ে ও ভাবেনি, তার বিদিশা যে শক্ত, সক্ষম, কিন্তু প্রভাময়ীর অসহায় মুখটা বোধহয় ও দেখেছিল কল্পনায়। বিশ্বাস করেছিল বিদিশা সেই দায়িত্বটুকু থেকে পালাবে না। বিদিশা যে অন্যরকম।

-পারিনি অভ্র, বিশ্বাস কর, অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এত ঘেন্না, এত অপমান সহ্য করে থাকতে পারিনি রে! চলে গিয়েছিলাম! আজ মনে হচ্ছে, ফিরতে দেরি হলো বুঝি!

বিদিশার চোখের জলে অভ্রর ছবি ঝাপসা হচ্ছে যেন! অভ্র কি বুঝলো? বিদিশা প্রভাময়ীর ঘরে ঢুকে খাটির পাশে চুপ করে বসে রইল। কে বলে দেবে, প্রভাময়ী তার ফেরা মেনে নিলেন কিনা!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন