সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩

ময়ূরী মিত্র

 

রঙ্গালয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত

 


(পর্ব – ১)

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে

ইংরাজ মহলে বাঙালি

ভদ্রলোকের হাল-হকিকত

ভিনদেশি বণিকের কাছে স্বেচ্ছাকৃত আত্মসমর্পণ এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহাবস্থানে যখন উনিশ শতকের শুরু হচ্ছে, ঠিক সেই সময় বিদেশিনী গ্রাহাম বেল ১৮১০ নাগাদ কলকাতায় এসে ইংরাজ ও এদেশীয়দের  মধ্যে বিস্ময়কর দূরত্ব দেখে লিখেছিলেন ---

The distance kept up between the Europeans and the natives ...is such that I have not been able to get acquainted with any native family. This mixture of nation ought, I think, to weaken national prejudices, but among the English at least, the effect seems to be diametrically opposite. Every Briton appears to pride himself on being outrageously a John Bull.

যদিও রামমোহন রায়ের দক্ষিণ্যে কলকাতার নগরকেন্দ্রিক বাঙালি সমাজে গণতন্ত্রের দূরস্থিত পদধ্বনি উনিশ শতকের প্রথম পর্বেই শোনা যাচ্ছিল -- কিছুটা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বাধীন মতামত প্রকাশ ও খানিকটা সমাজিক আন্দোলনের মধ্যে -- ফরাসি বিপ্লবের পীঠস্থান থেকে বহুযোজন দূরে থেকেও যদিও ডিরোজিও নিজেকে বৈপ্লবিক চিন্তায় উত্তেজিত করেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন A New Brave World এর, স্বপ্ন সঞ্চারিত করেছিলেন কিছু চরিত্রে অপরিণত ও বুদ্ধিমত্তায় তীক্ষ্ণ তরুণের মধ্যে তথাপি লালবাজার, বৌবাজারের ট্যাভার্ণে-কফিহাউসে, কিন্তু তার কোনো প্রতিধ্বনিই শোনা যায়নি৷ আপামর বাঙালির সঙ্গে এ জাতীয় ব্রিটিশ সংস্কৃতিচর্চার নূন্যতম সম্পর্কও ছিল না বললে চলে৷ এমনকি হার্মানিকের মতো অভিজাত ট্যাভার্ণেতে কোনো সম্ভ্রান্ত বাঙালি, যাঁরা ইংরাজ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে খানাপিনা উৎসবে যথেষ্ট মেলামেশা করতেন, তাঁরাও যেতেন না ৷ সম্ভ্রান্ত বাঙালিদের সামাজিক মেলামেশা ক্রমশই সীমায়িত হয়ে আসছিল শহরের বাবুদের বৈঠকখানায়, আখড়াই-কবিগানের আসরে অথবা বটতলার নিধুবাবুর টপ্পাগানের মজলিশে ৷

বঞ্চিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী এইসময় দেশের শাসকের সঙ্গে একটি তাৎক্ষণিক ও সমান্তরাল রাজনৈতিক সমীকরণ করে নিচ্ছিলেন সমঝোতা ও সাহচর্যকে  বাহ্যত দৃশ্যমান রেখে ৷ বস্তুত বঙ্গীয় ভদ্রলোকদের এই ব্রিটিশ ভক্তি এমনই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল যে ব্রিটিশকে এঁরা অত্যাচারী জেনেও আত্মসমর্পণ করতে চাইছিলেন ৷ এমনকি  জনসাধারণ যাতে রাজভক্তির ক্রমঅনুশীলনে পোক্ত হয়ে ওঠে সেজন্য ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকা যে রাজভক্তিমূলক গ্রন্থ প্রচারে সবিশেষ উদ্যোগী হয়েছিল সে খবরও পাই সিপাহি বিদ্রোহের বছরখানেক বাদে প্রকাশিত ‘হিন্দুদের রাজভক্তি’ বিষয়ক সম্পাদকীয়টি থেকে৷ অনেকসময় জাতিগত আত্মপরিচয় এবং বৌদ্ধিক স্বকীয়তা ও অনুকরণধর্মিতা নিয়ে শাসক -শাসিতের মধ্যে রীতিমতো সাংস্কৃতিক রাজনীতি চললেও এই সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বনাম সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ অনায়াসেই বাঙালি ভদ্রলোকের আত্মগত ব্রিটিশভক্তির সঙ্গে মিশ খেয়ে যাচ্ছিল ৷ অন্তত সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত তো বটেই ৷ তো এই একটানা আনুগত্যের অভ্যেস থেকে যেমন শাসক - শাসিতে রাজনৈতিক ভারসাম্য ও স্বাচ্ছন্দ্য আসতে শুরু করেছিল ঠিক তেমনি ১৮১ -তে হিন্দু কলেজ তৈরি হওয়ায় বাঙালি ভদ্রলোকের মনে পশ্চিমমুখী টানটি সজীব হয়ে উঠছিল ৷ তৈরি হচ্ছিল দেশীয় আমোদে তীব্র অনীহা ৷

সাহেবি মজলিশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজস্ব সামাজিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রটিকে শোভন ও সমান করার প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়ে ১৮৩০ -এর দশকে দেশের ভূস্বামী ও ধনীশ্রেণির কর্তৃত্বে যে শৌখিন নাট্যশালার সূত্রপাত ঘটেছিল তার প্রধান শর্তটিই  ছিল ইওরোপীয় নাট্যরীতির অনুসরণ এবং ইংরাজি নাটকের মূল বা অনুবাদের মঞ্চায়ন ৷ এমনকি তার  সাংগঠনিক আদলটিও হবে 'As The Englishmen have done '. এখানে অবশ্যই বলে নেওয়া দরকার, তিরিশের দশক থেকে উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালির নাট্যশালাগুলো যে প্রয়োগে পশ্চিমী কাঠামো ও শেকসপিয়রের প্রভাব এড়িয়ে থাকতে পারেনি তার একটি বড় কারণ ইংরাজরা তাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এদেশীয়দের ঢুকতে  না দিলেও সম্ভ্রান্ত বাঙালিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিজের উদ্যোগে ক্রমেই ইংরাজিশিক্ষিত, প্রগতিশীল ও নতুন ভাবনার শরিক হয়ে উঠেছিলেন ৷ কেউ কেউ আবার সাহেবপাড়ার থিয়েটার সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন ৷

সামগ্রিকভাবে দেখলে একটা কথা পরিষ্কার - দ্বারকানাথ ঠাকুর, মতিলাল শীল, রমানাথ ঠাকুর, রসময় দত্ত বা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের মতো প্রতিভাবান বিদ্বান - যাঁরা সেকালের সমাজ ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন বা করতে চাইতেন - সকলেই পেশায় ও ভাবনায় ইংরাজি ধারার প্রবল অনুরাগী হয়ে উঠছিলেন ৷ ১৮৩১-এর ২৮ ডিসেম্বর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটারের সূচনা তাই শেকসপীয়ারের জুলিয়াস সিজর এবং অধ্যাপক উইলসনের অনূদিত ভবভূতির উত্তররামচরিত-এর মঞ্চায়নে ৷ প্রচলিত লোকনাট্য কিংবা যাত্রার ধাঁচে নয় ৷ সাহেবপাড়ার চৌরঙ্গী থিয়েটারের অনুরাগী উইলসন তাই এখানে শুধু নাট্যানুবাদক নন, নাট্যশালার উদ্যোক্তা অভিনয়শিক্ষক এবং অভিনেতাও বটে ৷ সেকালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীর ইংরাজি থিয়েটারের ঝোঁক সম্বন্ধে ইন্ডিয়া গেজেট লিখছে ----

It affords us pleasure to observe such a number of respectable natives among the audience every play -night: it indicates a growing taste for the English drama, which is an auspicious sign of the progress of general literature among our native friends .

এখানে যে প্রশ্নটি খুব সঙ্গতভাবে উঠে আসে সেটি হল সাহেব শাসকদের বৌদ্ধিক স্তরে নিজেদের চেষ্টাকৃতভাবে হিঁচড়ে তোলার এই আত্মম্ভরী প্রয়াসে কতখানি অংশীদার হতে পেরেছিল আপামোর বাঙালি দর্শক? সাধারণ মানুষের রুচির সঙ্গে কতখানিই বা সাযুজ্য রেখে চলছিল ধনী বাবুদের নাট্যনির্মাণ? পরের পর্বে বলি ৷

(ক্রমশ) 

 

এই পর্বে যে বই ও সাময়িক পত্রগুলো  ব্যবহার করেছি --

১) T.G.P Spear ,The Nabobs, A study of the social life of the English in Eighteenth century India 1932,  Humphrey Milford , Oxford Univ press .

২) রামনিধি গুপ্ত, 'ভূমিকা', গীতরত্ন : গ্রন্থ /, জয়গোপাল গুপ্ত কর্তৃক সংগৃহীত, তৃতীয় সংস্করণ , ১২৭৫, নৃত্যলাল শীল ৷

৩) বিনয় ঘোষ, সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, সংবাদ প্রভাকর-এর নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ, নতুন পরিকল্পনায় বর্ধিত ও মার্জিত সংস্করণ, নভেম্বর ১৯৭৮, প্যাপিরাস৷

৪) Asiatic Journal, vol XXVIII, 1829.


২টি মন্তব্য:

  1. তৎকালীন শাসক সমাজ ও বাঙালি সমাজ এবং তারসাথে নাট্যশৈলীর বিষয়টি লেখার মাধ্যমে যেভাবে দৃশ্যায়িত হলো তাতে জানার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. সুকুমার ভট্টাচার্য্য-নাটক বহুল চর্চিত হলেও কলকাতা তথা ভারতে তার ইতিহাস এবং ক্রমবিবর্তন নিয়ে এই ধরণের তথ্যভিত্তিক প্রবন্ধ (না গবেষণা পত্র) লেখা প্রচুর পরিশ্রম দাবী করে। ময়ুরী মিত্রকে ধন্যবাদ তাঁর ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও এই লেখা শুরু করা। শুরু চমৎকার। মুদ্রণ প্রমাদ দু’একটি চোখে পড়েছে (যেমন হিন্দু কলেজের শুরু)। প্রকাশক নজর দিলে ভাল হয়।

    উত্তরমুছুন