বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


শেষপর্যন্ত

 

-কী বলছিস! সারারাত তোর বর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাল! কী ভালো রে! আহা, পূর্ণিমার রাত… তা কী কী গান গাইল সে সুমিতা?

- উফ! শাট আপ! ‘সুমিতা’ নিজের নামটাই ভুলে গেছি আমি, সারারাত আমায় লাবণ্য বলে ডেকে গেছে। তিনি নাকি অমিত, আর আমি লাবণ্য। তারপর দুনিয়ার যত প্রেমের রবীন্দ্রসঙ্গীত আমায় শোনাল! জাস্ট ইনকরিজিবল, ফুলশয্যাটা মাঠে মারা গেল।

-এমন ফুলশয্যা কজনের ভাগ্যে জোটে বল তো? অমিত আর লাবণ্য, প্রেমের দুই প্রতীক, তুই আর তোর বর, কী গান গাইল রে - সেদিন দুজনে দুলেছিন বনে? তুই কী কিছু গেয়েছিলি নাকি?

-আমি উচ্চাঙ্গসঙ্গীত গাইছিলাম। মনে মনে।

-মানে?

-স্থিতা! এই সাদা চুল, দাড়িওলা বুড়োর প্রতি তোদের এই গদগদভাব দেখে আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। রাতের ফ্রাস্ট্রেশন মেটাতে তোর সঙ্গে কফি খেতে এলাম, তুইও সেই জোব্বাতেই আটকে আছিস দেখছি!

-তা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শুনল তোর বর?

-স্থিতা! তুইও দেখছি নিজের বুদ্ধিটা তোদের কবিগুরুর চরণে অর্পণ করেছিস! ওরে আমি মনে মনে নিজের মেজাজটি সপ্তমে চড়িয়ে উচ্চস্বরে মনের জ্বালা মেটাচ্ছিলাম, নিজের সঙ্গে কথা বলে।

-আচ্ছা তোর মন তখন উচ্চস্বরে সঙ্গীত সাধনা করছিল। বুঝেছি। তা তোর বর কী এই উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে পেয়েছিল সুমিতা?

-জানি না। তিনি তখন মনের সুখে রবি ঠাকুরের পুজো করে চলেছেন। গান গেয়ে, কী যেন গান, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী… অসহ্য লাগছিল আমার। আমি কি বিদেশে থাকি বল? আদ্যোপান্ত কলকাতায় বড় হওয়া আমি ফুলশয্যার রাতে হঠাৎ করে বিদেশিনী হয়ে গেলাম! তোদের ওই দাড়িওলা বুড়োর জন্যে! কার সহ্য হয় বল তো?

-আরে তুই তো ভালোবাসার কথাগুলো বুঝতেই পারিসনি সুমিতা।

-মানে? কী বলতে চাইছিস বলতো স্থিতা!

-এই যে তুই তোর বরের রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রীতি মোটেই গলাধকরণ করছিস না, আর মনে মনে উচ্চ মেজাজে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইছিস, তা কিন্তু তিনি ভালোই বুঝেছিলেন। তাই তো তোকে বিদেশিনী আখ্যা দিয়েছিলেন, মানে অন্য জগতের মানুষ তুই, সেটাই বলতে চেয়েছিলেন, বুঝলি?

-ওয়েট! ওয়েট! তার মানে তুই বলছিস তোদের এই দাড়ি-বুড়োর প্রত্যেকটা গান দিয়ে ও আমায় কোন ফিলিংস বোঝাতে চাইছিল?

-অবশ্যই!

-তা বাবা এত লুকোচুরির কী আছে রে? আমি তবে ওর সব গান কবিতা শুনে দারুণ, চমতকার এসব বলে বেশ একটা উত্তেজনার ভাব আনার চেষ্টা করছিলাম। একদম পাকা অভিনেত্রীর মত।

-কিন্তু তোর অভিনয় কী আর ধরা পড়েনি রে?

-তুই এত নিশ্চিত কী করে হচ্ছিস বল তো স্থিতা?

 -কবিগুরুর গান দিয়ে যারা ভালোবাসা বোঝায় তারা সব বুঝতে পারে?

-আবার শুরু করলি তুই? সারারাত দিব্যি তার গান শুনলাম, ভালো বলে প্রশংসা করলাম, তারপর ও আমায় শেষে শোনাল যেন কী একটা গান, আমার প্রাণের পরে চলে গেল যে… সারারাত অত্যাচার সহ্য করার পর শুনতে হল আমি নাকি চলে গেলাম, এরপরও তোরা রবীন্দ্রজয়ন্তী এলেই সব ভুলে রবিপুজোয় মেতে উঠবি, আর আমরা এমন অভিনয় করেই যাব।

-তুই তো কিছু বুঝিসনি আসলে সুমিতা, তোর পতিদেবতাটি আসলে ভালোবাসার উদযাপন করতে চাইছিল কবিগুরুর গানে, তুই না বুঝে মনে মনে যে তার মুণ্ডপাত করছিলি তাও তিনি বুঝেছিলেন। তারপরও তুই কিছু বুঝিসনি, তাই তিনি গান গেয়েছেন অমন…

-বুঝলাম না রে স্থিতা, তোদের এই সাদা চুলদাড়ির বুড়ো এত জটিল না, আমার অসহ্য লাগে…

-মোটেই জটিল না, তাকে বুঝতে গেলে শুধু মনের চর্চার দরকার, আর তুই তো মাথা দিয়ে ভাবিস সব সুমিতা!

-মোটেই না, কী সব বলিস বল তো? আমার বর একটু বিয়ের প্রথম রাতে ভালোবাসার কথা বলবে এই আশা করাটাকে মাথার চিন্তা বলছিস তুই?

-সে তো বলেছে রে! কবিগুরুর গান দিয়ে প্রকাশ করেছে!

-তার মানে ওই কী সব দাঁত চেপে গান গাইছিল, ওগুলোই ভালোবাসার কথা, কী যেন গান সব… আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিল… তারপর তুমি রবে নীরবে… এসব লুকোচুরি কবে করলাম বল তো যে এসব গান গেয়ে রাত কাবার করে দিল। সবই তো নীরবেই সহ্য করলাম, তারপরও বলছে এখনো নীরবে থাকতে হবে… আবার প্রাণ দিয়ে চলেও গেলাম… উফ! তুই আবার বলছিস এসবই নাকি ভালোবাসার কথা!

-তুই যে কয়েকটা গানের কথা বললি, সব প্রেমের গান, কবিগুরু নিজে আমাদের এইসব গান দিয়ে ভালোবাসার পথের খোঁজ দিয়েছেন, তোর বর ভালোবাসার কথাই বলেছে রে, তুই-ই বুঝিসনি!

-সত্যিই… তাই বলছিস তুই?

-একদম নিশ্চিত হয়ে। তবে এতক্ষণে তিনি তোর বিরহে কাতর হয়ে আরেকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন বাড়িতে,  ফুলশয্যার পরের দিন বৌ বাড়ির বাইরে, বর কিন্তু দুখের গানই গাইবে…

-আমার কী করা উচিত বল তো?

-আগে বরের জন্যে একটা রিংটোনটা সেট কর রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে।

-কী গান দেব বল তো, আমি তো জানি না কিছুই…

-এই যে তোর মত এমন মাথা দিয়ে ভাবা জেদী মেয়েও যখন মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করে, কয়েকমাস আগে পরিবারের ঠিক করে দেওয়া ছেলেটার জন্যে চিন্তা করে, তখন বুঝতে হবে ছেলেটা জয় করতে পেরেছে তোকে। একেবারে রাজার মত। তুই বরং মহারাজ এ কী সাজে গানটাই সেট কর রিংটোন হিসেবে, তারপর বরকে একটা মেসেজ করে ফোন করতে বল, তিনি যখন তোর ফোনের রিংটোনেও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন, আমার বিশ্বা্‌স, বিরহের গান বন্ধ করবেন নিশ্চিতভাবে।

-তারপরেরটা আমি বলছি স্থিতা, ওর নামটা প্রথমে অমিত বলে সেভ করব ফোনে, তারপর এই ক্যাফেতেই ডেকে নেব ওকে, আর ওর গানে গানে সাজিয়ে নেব আমাদের মুহূর্তে…

-তার আগে এই ক্যাফেতে স্পেশাল পারমিশন করিয়ে শুধু তোদের দুজনের ঘন্টাখানেকের থাকার ব্যবস্থাটা পাকা করে নে সুমিতা, থুড়ি লাবণ্য!

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন