বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

শাশ্বতী চট্টোপাধ্যায়

 

‘তরঙ্গ' এক আশ্চর্য উত্তরণের সিনেমা 




জীবন শিল্পের আধার। অগণিত শৈল্পিক মুহূর্তের অলিখিত সংশ্লেষ। তাকিয়ে দেখতে জানলে, ঐ যেন বাবুইয়ের বাসা, ঐ যেন অলৌকিক স্থাপত্যের কারুকাজে পড়ে থাকা একলা পাঁজরের খণ্ডহর, রোদজ্বলা পথের মরীচিকায় তিরতির লুকিয়ে থাকা মহার্ঘ্য ইন্দ্রধনু। ছায়াছবির কারিগর সেই অঘোষিত শিল্প ছেনে তোলেন, খড়কুটো মুড়িয়ে সেই অনাম্নী সূক্ষ্মতা কুড়িয়ে আনেন। বাস্তবের চাইতে বড় রূপকথা হয় না। আর পরিচালক যখন কবিতাকারও, তখন সেই কথা ও কাহিনী সময়ের নিক্তিতে আরো বেশি ক'রে উত্তীর্ণ হয়। কীটসের কথায়, কবিতা যদি গাছে পাতা গজানোর মতো স্বাভাবিকভাবে না আসে, তো সে না আসাই ভালো। পলাশ দে'র 'তরঙ্গ' সেই স্বাভাবিকভাবে ফুটে ওঠা আলোছায়ার কলমকারি, পাওয়া হারানোর স্বতঃপ্রবাহ।

'তরঙ্গ'। পলাশ দে'র ছবি। 'অসুখওয়ালা'র স্রষ্টা, 'ওস্তাদ'এর ঔপন্যাসিক এবার হাজির সমাজের বিপ্রতীপে অবস্থান করা বিচিত্র জীবন আর তাদের মুঠোয় বাঁধা লড়াইয়ের পটকথা নিয়ে। টিঁকে থাকার লড়াই আলোকপ্রাপ্ত সম্পন্ন শহুরে জীবনে একরকম, আবার শহর থেকে অনেক দূরে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের উঠোনের ধোঁয়ার ঝাপসায় অন্যরকম। প্রতিভা সেখানে দু'মুঠো ভাতের দরে হেলায় বিকোয়। পেটের দায়ে মুনাফালোভী আধুনিক মুখোশধারী মহাজনের কাছে মহার্ঘ্য শিল্প বাঁধা পড়ে। কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মুহূর্তও আসে। বিপ্লব মাহাতোর মতো দক্ষ ছৌ মুখোশশিল্পী অসহায়তার চরমে দাঁড়িয়ে, মার খেয়েও শোষকের চোখে চোখ মেলায়, বৈধ পাওনা দাবি করে, সাহস যোগায় সোহাগ। সূত্রপাত হয় নিঃশব্দ বিদ্রোহ তথা বিপ্লবের। বিপ্লবদের মতো মুখোশশিল্পীদের প্রতি ঘটে চলা শোষণ, বঞ্চনার প্রতিবাদে সোহাগ রাজীবদের প্রোজেক্ট থেকে সরে আসে, আর্থিক নিরাপত্তার লোভে সে বিবেককে বিসর্জন দিতে পারে না। গল্প নিজের গতিতে এগিয়েছে। সারথির প্রকট বা প্রচ্ছন্ন দাদাগিরির ছাপ নেই কোথাও, শুধু ছোঁয়া আছে। চাপিয়ে দেওয়ার বিড়ম্বনা, ভাবনার অতিরেক, নির্মাণকে দাগা দিতে পারেনি। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত প্রকৃতি, রোজকার ওঠাবসার ঘরদোর, লাল ধুলো মাটির মানুষের 'দিবারাত্রির কাব্য' - সব মিলিয়ে ম্যাট ফিনিশ 'তরঙ্গ'।

একদিকে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র সোহাগের ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়া। তার স্বামী অভিজিতের শরীরে নিঃশব্দে ঘটে চলা মারণরোগের তাণ্ডব, ফলস্বরূপ সোহাগের বিপন্ন দাম্পত্য, সম্পর্কের নিরাপত্তাহীনতা, তাদের দুজনকে দিনে দিনে যেন অনিরাময়যোগ্য নিস্পৃহতায় আচ্ছন্ন করে। অন্যদিকে, শোষিত, বঞ্চিত মুখোশশিল্পীদের জীবনযন্ত্রণা - দুইয়ের সমান্তরাল অভিযাত্রায় মৌনমুখর 'তরঙ্গ'।

সোহাগ খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিতে চায়। কিন্তু, স্বামীর অস্তিত্বকে তুচ্ছ প্রতিপন্ন ক'রে, সস্তা প্রলোভনে পা দিয়ে নয়; রাজীবের অত্যুৎসাহী প্রস্তাবকে মুহূর্তে প্রতিহত করে। কঠোর কণ্ঠের প্রত্যুত্তরে দর্শককে সে নিশ্চিন্ত করে, পাশের ঘরে এখনো আমার স্বামী ঘুমোচ্ছে। ফেলে আসা শখের সবুজ তাকে অক্সিজেন দেয়।  কাজ করতে এসে নতুন সত্যের মুখোমুখি হয়। খেটে খাওয়া শিল্পীদের সঙ্গে ঘটে চলা দুর্নীতি, প্রবঞ্চনার বিরুদ্ধে সরগরম হয় সে। কিন্তু, দাম্পত্যজীবনের শুষ্কতার অছিলায় সহজ শরীরী হাতছানির মোহে ভেসে যেতে চায় না। বরং মানুষের জন্যে, মানুষিক সৌকর্যে প্রাণের উদ্বৃত্তটুকু বিলিয়ে দিতে চায়। অপরদিকে  অভিনেতা রণোর ফেসিয়াল ফীচার্সের তীক্ষ্ণতাকে, রাজীব চরিত্রের ক্ষুরধার অ্যাপ্রোচকে নিখুঁত ফুটিয়ে তোলার কাজে পরিচালক বুদ্ধিদীপ্ততায় ব্যবহার করেছেন। রাজীব চরিত্রের শেডস্, তার আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, প্রবৃত্তিগত বাসনা, শঠতার খল উঁকিঝুঁকি দর্শক সংবেদে তীব্র দাগ রাখে। কেউ শিল্পের নামে বাণিজ্য বোঝে, আবার কেউ আতরের বাণিজ্যের নামে সুগন্ধী স্বপ্নকে খুঁজে পেতে চায়, জ্ঞাতসারেই জীবনের উপসংহারটুকু অজানার হাতে সঁপে নিরুদ্দেশ হতে চায়। স্বাস্থ্যে, আয়ুষ্কালের সম্ভাবনায় ক্ষীণ, অসহায় ও অনিশ্চিত হ'লেও সোহাগের স্বামী অভিজিত প্রাণশক্তিতে, স্বপ্ন দেখার নিবিড়ত্বে হীন নয়, রীতিমতো সমৃদ্ধ। আতর তৈরির স্বপ্ন তার আজও সমান সুবাসিত। চলে যাবার আগে বৃষ্টির মাঝে সুদৃশ্য শিশি থেকে আতর ছিটিয়ে দেবার দৃশ্য স্বয়ং এক দুর্নিবার কবিতা। এক কথায় অবিস্মরণীয়। বিচিত্র চরিত্রের স্বপ্ন, উদ্দেশ্য, উড়ান, অপসারী আলোকরশ্মির মত ছবি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

পাকা হাতের কাজ। সিরিয়াস ছবি। পলাশ দে-র ভাবনা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ঠাসবুনোটের নাতিদীর্ঘ 'তরঙ্গ'। মাটির গল্প, মানুষের গল্প, মানবিক সম্পর্ক ও মানসিক ওঠাপড়ার বাস্তব চলচ্চিত্রায়ণ। প্লটের প্রতিটি বাঁক, চরিত্রের শেডস্, আবহের ব্যবহার - সর্বত্র চরম পরিমিতিবোধের স্পষ্ট ছাপ। এতটুকু বাড়তি ভাবনা নেই। নেই পরিবেশনের অতিরেক। যেন শিল্পের প্রতি আজন্মের দায়বদ্ধতার ইস্তেহার তৈরি করেছেন পলাশ। সেইসঙ্গে মারণব্যাধি ও স্বভাবগত পার্থক্যের সুযোগ নিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের অনপনেয় আড়ষ্টতা, শীতলতা ও অসহায়তাকে দুরন্ত শৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত প্রাকৃতিক পরিবেশের বুকে ঐতিহ্যবাহী ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির কারিগরদের চরম বঞ্চনা, জীবনযুদ্ধ ও বিড়ম্বিত অস্তিত্বের দলিল 'তরঙ্গ'। কিন্তু শেষপর্যন্ত চলচ্চিত্রটির স্রষ্টা মানুষের শুভবোধ, চেতনা ও সচেতনতাকে জিতিয়ে দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধের পরিসরে তুলে এনেছেন প্রেমের অন্তঃসলিলা কথকতা।

পুরুলিয়ার প্রকৃতিকে বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে ব্যবহার করা হয়েছে। মাটির মায়া, মেঘের ছায়া, বৃষ্টিধারায় আতরের খুশবু ছড়িয়ে গতি বাড়ায়, গতি কমায় 'তরঙ্গ'। বাদশা মৈত্র ও সোহিনী সরকারসহ প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীর দায়িত্বশীল ও পরিণত কাজ গভীর ছাপ ফেলে যায়। এত বাস্তবধর্মী নির্মাণ যে, দেখতে দেখতে এটি যে ফিচারফিল্ম, ডকুমেন্টারি নয়, প্রায় ভুলে যাচ্ছিলাম। 'বিপ্লব‌ মাহাতো' র চরিত্রাভিনেতার কাজ বিশেষ উল্লেখের দাবি করে। সীমিত পরিসরে এতখানি ডিটেইলিং নিঃসন্দেহে মুগ্ধতা আদায় করে নেয়। যখনই ভাবা গিয়েছে, দক্ষ মুখোশশিল্পীর চরিত্রাভিনেত্রীকে শুধু সংলাপের ইঙ্গিতে নয়, সরাসরি মুখোশ সংক্রান্ত কাজের মধ্যে কখন দেখতে পাওয়া যাবে, তখনই পরবর্তী দৃশ্যে পরিচালক সেই আকাঙ্ক্ষা  মিটিয়ে দিয়েছেন।

পলাশ দে সুচিকিৎসক; সময় ও মানুষের নাড়ীর গতি বুঝে কাজ করেন। সে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য হোক বা ছায়াছবি। সুরস্রষ্টা দেবজ্যোতি মিশ্র 'ভালো লাইগছে না' গানে কথা সুর ও গায়কীতে একাই জাদু দেখিয়ে গেলেন। দর্শক-শ্রোতার কানে ও কণ্ঠে নিভৃতে বেজে রইল।

'তরঙ্গ' উত্তরণের ছবি। 'ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত' বললে এক অর্থে ভুল হয় না। একজন আপাদমস্তক কবির দৃষ্টিকোণের আনুকূল্যপ্রাপ্ত ছবি। সুতরাং পরিমিতিবোধ, ইঙ্গিতময়তার সুযোগ সে ছাড়বে কেন? স্তবকে স্তবকে পাঠ ক'রে পাঠক তথা দর্শকই তার মোড়ক উন্মোচন করে নেন। পরিশিষ্টে 'তরঙ্গ' তাই কবিতার মতোই রিক্ত করে যায়, পূর্ণ করে যায়।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন