বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩

যশোধরা রায়চৌধুরী

 

সমকালীন ছোটগল্প


কে ওখানে?

 

কে, কে ওখানে?

পর্দাটা সামান্য দুলে উঠতেই সচকিত হয়ে বলে উঠলেন রিঙ্কি রায়। নাহ কিছু না হাওয়া বোধহয়। নিজেকে

সামলে নিলেন। বড় বড় চোখ মেলে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছে্ন। টেবিলের পাশে বিছানা। টেবিলে

ছড়ানো বইপত্র। কত যে মেটিরিয়াল! কোনটার কাজ হয়ে গিয়েছে, কোনটা আধখানা। এখনো ধরাই হয়নি কিছু

ক্যাসেট, ডায়েরি, অনেকগুলো বান্ডিল করা চিঠি।

তিন যুগের কথা একত্রে লিপিবদ্ধ করতে হবে তাঁকে। একইসঙ্গে পেনড্রাইভে, সিডিতে এবং ক্যাসেটে এত

রকমের ম্যাটার। আত্মকথন। সেই যারা, হোমে থাকে, সাদা আলখাল্লা জামা পরে, আজানুলম্বিত, মাথায়

ঝাঁকড়া চুল! অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট খায়। চোখে দৃষ্টি ছিল না এই কদিন আগেও, কিন্তু হোমের সযত্ন চেষ্টায়

ক্রমশ ভাষা ফিরে পেয়েছে কেউ কেউ। বয়ান দিয়েছে ডিজিট্যাল ফরমাটে।

পঞ্চাশ বছর আগের যারা, এখন অশরীর, গলায় দড়ি দিয়েছিল অথবা মরে গিয়েছিল কোন না কোনভাবে!

“আন্ডার আন ইউজুয়াল সারকামস্ট্যান্সেস?” বাড়ির লোকের এগিয়ে দেওয়া দুধের গেলাস অথবা শশায় মাখানো

সায়ানাইড?

দুনিয়া থেকে লোপাট হবার আগে তারাও লিখে গিয়েছিল তো! বলে গিয়েছিল নিজেদের কথা। চিঠিতে ডায়েরিতে

আঁকাবাঁকা অক্ষরে এবং শিথিল অযৌক্তিক ও অসংলগ্ন ভাষায়। ক্যাসেটে বলেছিল, যে ক্যাসেট পাওয়া গেছে

ডাঁই করা। কারুর আলমারিতে, কারো সিঁড়ির নিচের ময়লা জিনিস রাখার ঘরে।

মৃতদেহের সঙ্গে যে ডকুমেন্টগুলো পুড়ে গিয়েছিল, সেগুলোর জন্য বুকভাঙা কষ্ট হয়। রিংকি জানেন, সেগুলো

ফিরে না পাওয়া তাঁর কাছে কত বড় ক্ষতি।

হান্ড্রেড ইয়ারস অফ রেপ কালচার। এমন একটা টাইটেল মাথায় ঘুরছে তাঁর। একশো বছরের ধর্ষিতাদের বয়ান

লিপিবদ্ধ করার গুরুদায়িত্ব। আজকের ২০৫০ থেকে ব্যাক টু ১৯৫০। এইভাবে পিছিয়ে। কেউ কেউ তো বিশ্বাসই

করতে চান না যে ২০০০ সালের আগেও মেয়েদের ধর্ষণ হত!

আসলে ডকুমেন্টের অভাব। যাবতীয় ডকুমেন্টেশন সহজলভ্য হতে শুরু করল ডিজিট্যাল জমানার পর থেকে।

সমস্যা একটাই। সেই কোন দূর ১৯৬০ বা ১৯৮০ সালের ডকুমেন্টের অর্ধেক স্পুল ক্যাসেটে বা চৌকো

ক্যাসেটে। ফিতেয় পোরা সেসব আত্মকথন কী করে রিঙ্কি তুলে নেবেন তাঁর খাতায়? সেগুলোকে বাজিয়ে শোনার

যন্ত্রই যে অমিল!

এখন রাত সাড়ে নটা। ক্লান্ত, অবসন্ন, সারাদিন নানা সমস্যার সঙ্গে ধস্তাধস্তিকে পর্যুদস্ত রিংকি শুয়ে শুয়ে

অন্ধকারে তাকিয়ে মাথার মধ্যে চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। একটু পরেই  চমকে, প্রায় আঁতকে উঠলেন একটা কলিং বেলের শব্দে। ক্যাঁ-ক্যাঁ করে কাকের মত ককিয়ে ওঠে তাঁর এই নতুন বেল।

সিকিউরিটির স্ক্রিনে আগন্তুকের মুখ দেখতে উঁকি দেন উঠে গিয়ে। মুখ দেখা যায় না। শুধু একটা সাদা

আলখাল্লা চকিতে সরে যায়।

কী হল ব্যাপারটা? দ্রুত ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখলেন, দরজার সামনে একটা বিশাল প্যাকেট। বোমা রেখে

গেল নাকি কেউ? আজকাল প্যাকেট বম্বের যুগ। আর এই ধর্ষিতাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েই রিংকি অনেক

শত্রু বানিয়েছেন।

নিচু হয়ে সন্তর্পণে প্যাকেট তুললেন। নাহ, কী সব খটখট করেছে। খুলতেই বেরল, একটা হদ্দ প্রাচীন ক্যাসেট

প্লেয়ার। যেরকমটা তিনি খুঁজছিলেন। একগোছা ক্যাসেট! গায়ের ময়লার আস্তরণ থেকে স্পষ্ট এগুলো সেই ১৯৮০

নাগাদের। একটা চিরকুট ঝরে পড়ল পায়ের কাছে।

আপনার সঙ্কলনে ধর্ষিতারা আছে। ধর্ষিতদেরও ভুলবেন না। ইশকুলের বড়দাদা, বাড়ির প্রাইভেট টিউটর

এবং পরে অফিসের বসের দ্বারা ক্রমান্বয়ে রেপড হয়েছিলাম আমি। এই আমার বয়ান। ইতি, শশাঙ্ক সামন্ত।

আশাকরি কাজে লাগবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন