ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩৭)
কিছুদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না শোভনের শরীর, বারবার একটা না একটা উপসর্গ উপদ্রব করছে। অনিদ্রা, পেটের গোলমাল, হাঁপানির টানের মতো—। দুশ্চিন্তায় আছে লিপিকা, ভয় পাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। দিল্লী থেকে ফিরে আসার পর থেকেই কেমন যেন! বাইরে থেকে দেখলে ভালোই আছে বোধ হয়। হয়ত লিপিকার আশঙ্কা অমূলক। একটা ছবি আঁকতে শুরু করেছে শোভন, ছোটোবেলায় দেখা মেলার ছবি। ওদের ওখানে যেমনটা দেখত। এমন মেলা লিপিকা নিজেও দেখেছে তার বাল্যে, কলকাতা শহরে বসেই। এখন মেলার চরিত্র অনেক বদলে গিয়েছে। বাচ্চারাও আর সহজে সন্তুষ্ট হয় না, ভেলকিবাজিতে চটজলদি বিশ্বাসও করেনা। শোভন ঘুমোচ্ছিল কাত হয়ে, লিপিকা পাশ থেকে খাতাটা তুলে নিল। কয়েকটা সোজা-বাঁকা লাইন স্কেচ করেছে, নাগরদোলার মতো যেন দেখায়। চার উচ্চতার চারটি মানুষ, ওরাই চারজন। লিপিকা নিঃশ্বাস ফেলে খাতা নামিয়ে উঠল। অলস ফাঁকা-ফাঁকা বিকেল, বাইরে বেরিয়ে খানিক ঘুরে এলে ভালো লাগত। কিন্তু শোভনকে ঘুমন্ত রেখে যেতে ভরসা হয়না। নীচে যতীন বলে ছেলেটি জামাকাপড় ইস্তিরির গুমটি খুলেছে। বাজারে ওর বাবার সবজির দোকান। বেশ ভদ্র-সভ্য ছেলে, রোজ দেখে লিপিকাকে, হাসে। হঠাৎ দরকারে ওকে ডেকে নেওয়ার প্ল্যান করে রেখেছে মনে মনে।
দেওরকে ফোন করে শোভনের বিষয়ে জানাতে ইচ্ছে করে, নিজেরও অনেক জিজ্ঞাস্য
আছে। তারপর মনে হয়—কী দরকার অন্যকে ব্যস্ত করে!
রঞ্জন বেশী সময় হস্টেলজীবন কাটিয়েছে, হয়ত তখন থেকে বাড়ির সঙ্গে মানসিক দূরত্ব তৈরি
হচ্ছিল। তার ওপরে তিনভাই তিন জায়গায় জীবনের প্রধান অংশ কাটিয়েছে। দূরত্বের জন্য সম্পর্ক
যথাযথ, সুস্থ অথচ ঢিলেঢালা। ভালো কথা বা ‘কেমন আছো? আমাদের এখানে বেড়িয়ে যাও’ ইত্যাদির বাইরে ব্যক্তিগত সমস্যার আলোচনা হয়না। এমনিতেও এখন অন্যের ব্যাপারে
বেশী খোঁজখবর নেওয়া লোকে অপছন্দ করে। কারো কাছে না খুলতে পেরে লিপিকার বুকের মধ্যে
হাঁপ ধরে যায়। থাকার মধ্যে আছে এক বাবুল। ছেলের ওপরে অবোধ্য অভিমান জমে উঠেছে, অনেকটা
ক্ষোভ। সে বড়ো হয়ে গেছে, ত্রিশের কোঠায় বয়স, যথেষ্ট উপযুক্ত সবদিক দিয়ে। বাবা-মা’র
মানসিক দুশ্চিন্তা বুঝে নেওয়া উচিত, তার বদলে লিপিকার আধখানা মন উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে
তারই জন্য।
নিঃসাড়ে ঘুমোয় শোভন, লিপিকা আলতো হাতে দরজা টেনে ঘরের বাইরে আসে। আনচান
করছে শরীর, কপালে ঘাম জমছে। মেনোপজে হয়েছে ক=বছর যেন, তার পর থেকে এরকম। ছোটো ফ্ল্যাটে
এঘর-ওঘর—সমস্ত
নিঝুম, নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে দুপুরভর। শব্দ বলতে জীবন্ত মাছেদের নড়াচড়া। আজকাল শোভনকে
দেখেও ভারী বিরক্তবোধ হয়। শুধু ‘ভালোমানুষ’ নিয়ে জীবন কাটানো যায়? ভালো-মন্দ, দায়-কর্তব্য, চিন্তা সব একার ঘাড়ে বয়ে?
এমন কী সে নিজে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেও আজ পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। লিপিকার কষ্ট হতে
থাকে, বুকের মধ্যে জ্বালাধরা। স্বভাবজ সংযম হারিয়ে বাবুলের নম্বর ডায়াল করে। বাবুল
ফোন তোলে ঠিক কেটে যাওয়ার আগে,
“কী
হল মা?”
লিপিকা অস্বস্তিতে পড়ে, বোঝে কাজটা হঠকারিতা হয়েছে। সবে বুধবার, বাবুলের
অফিস চলছে। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ধীরে ধীরে বলে,
“না-রে,
কিছু না। হাত লেগে গিয়েছিল। অফিসে আছিস তো এখন।”
“আজ
ঘর থেকে কাজ করছি। এখন একটু ফ্রি। বলো।“
“তুই
বল কী খবর?”
“কিসের?”
“তোর।”
হর্ষ অবাক হয়, রবিবারই অনেক কথা হয়েছে মা-র সঙ্গে। আজও হয়ত রাতের দিকে
কল করত সে। কিছু অনুমান করে জানতে চায়,
“সব
ঠিকঠাক তো মা? বাবা?”
“তার
একটা না একটা লেগেই থাকে। আর পেরে উঠি না রে, আমারও যে বয়স বাড়ছে, না কি? তার ওপরে
তুই নিজেও কিছু—,”
হর্ষর কানে মা-র স্বর অচেনা ঠেকে, তাল কাটছে কোথায় যেন। হর্ষ কথা বলছে
না দেখে লিপিকা নিজেই বলে,
“তোর
বাবা আজকাল কেমন সব কথা বলে! সেদিন বলল এবারে বউমা আসবে। তুই কি শাম্ভবীর সঙ্গে কন্টাক্ট
করেছিস আবার?”
“বাবা
বলছে?”
“হ্যাঁ!
অদ্ভুত কথা বলে মাঝে-মাঝে। শাম্ভবীর ফোটো প্রথম যখন মোবাইলে দেখাই, বলেছিল এ নয়, আর
কেউ!”
“কেন?”
“কী
করে জানব?”
“মা,
এক্ষুণি কল আছে একটা, ফোন রাখছি।”
লিপিকা উত্তর দেওয়ার আগেই হর্ষ ব্যস্তভাবে ফোন কেটে দেয়।
কিছুদিন ধরেই লিপিকাকে বলবে ভেবেছে হর্ষ, আবার সেই দ্বিধা! নিজের মন আর ভাবনা নিয়ে সে-ও আর পেরে ওঠে না। বেশ লাগছে তার ঊর্বীকে, হালকা আকর্ষণ। মনের ভেতরে ঝুলন্ত পর্দা সরিয়ে সে বুঝি পা রেখেছে, ঘরে আসার জন্য তৈরি। রাতের বেলা ঘর অন্ধকার করে বিয়ারের ক্যান নিয়ে একা বসে হর্ষ ভেবেই যাচ্ছিল। ভেতরে অদিতির আবছা ছায়া কি রয়ে গেছে এখনো? বেশীদিন আগের ঘটনা তো নয়। ঊর্বীর সঙ্গে সে ‘বস’সুলভ সৌজন্যমূলক নির্মোহ গাম্ভীর্য বজায় রাখে। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে উঠতে হয়ত ঊর্বীও তাকে ভুল বুঝে সরে যাবে। চমৎকার মেয়ে, এমন মেয়েরা বেশীদিন এক কম্পানিতে থাকেও না। হয়ত একদিন বিদেশে পাড়ি দেবে, সেটল করে যাবে সেখানে। হর্ষ নিজেকে বলে,
করুক না হোয়াটেরভার শী লাইকস্, আমার কী? আমার মতো একটা বাজে কনফ্যুজড
ছেলেকে পছন্দ করতেই হবে নাকি? অথচ ঊর্বী তাই করছে! সোও স্ট্রেঞ্জ!
মা-কে বলে ফেলবে সে এসব, হালকা হবে। মা যা পরামর্শ দেবে, মেনে নেবে
সে।
শাম্ভবীর কথা জিজ্ঞেস করল কেন? মা-বাবা কি এখনও পজিটিভ আশা করে আছে?
উইদ্ দ্যাট পেটাইট ইন্টেলেকচ্যুয়াল গর্ল—নাঃ হর্ষর জন্য
সে নয় এবং উল্টোটাও অবশ্যই অ্যাণ্ড দ্যাট উড বী নেভার পসিবল। মা-কে ওসব জানানো হয়নি
কিছুই।
শাম্ভবী নিজে থেকে দেখা করেছিল তার সঙ্গে, তার ফ্ল্যাটে ক-দিন থাকতে
চেয়েছিল। বাড়িতে প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হচ্ছে বিয়ের জন্য। লিপিকা ও হর্ষ ‘না’ করে দেওয়ার পরে শাম্ভবীর বাবা নিজে একজন এন-আর-আই ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক
করছেন। ছেলেটিও সপরিবারে দেখেশুনে গেছে। সাধারণ পরিবারের ব্রিলিয়্যান্ট ছেলে, রীতিমতো
সুদর্শন, জার্মানিতে আছে। শাম্ভবী ছেলেটিকে জানিয়েছিল, তার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব।
কেন সম্ভব নয়, তার আভাস দিয়েছিল। ছেলেটি নাছোড়বান্দা ধরণের, বারবার শাম্ভবীর সঙ্গে
যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শাম্ভবী চেয়েছিল বাড়িতে না জানিয়ে বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে
রেজিস্ট্রি করে নিতে। এখানে সে ছোট্ট মিথ্যাচার করতে চেয়েছিল, হর্ষ এবং সে পরস্পরকে
পছন্দ করছে এবং অল্প কিছুদিন লিভ-ইন্-এ থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
হর্ষ সমস্ত শুনে-টুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। বিস্ফারিত চোখে বলেছিল,
“সোও
ডেয়ারিং! তোমাকে দেখে এরকম ভাবা যায় না!”
“লীভ
দ্যাট। উড ইউ অ্যালাও মী টু শেয়ার ইওর ফ্ল্যাট ফর আ শর্ট টাইম?”
হর্ষ আমতা-আমতা করছিল, পরিষ্কার করে বলতে পারছিল না যে এসব উটকো ঝামেলা
মাথায় নেওয়ার ইচ্ছে তার নেই। শেষে বলেছিল,
“তোমাকে
বলা হয়নি মানে বলিনি আয়্যাম অলসো ইন আ রিলেশনশিপ। অফেন শী কামস টু মাই প্লেস, দেন
...। অবশ্য তুমি যদি চাও আমি এদিকে তোমার জন্য অন্য ফ্ল্যাট ম্যানেজ করে দিতে পারি।
কিন্তু তোমার অফিস অনেক দূর পড়ে যাবে।”
কয়েক মুহূর্ত হর্ষর মুখের ওপর সোজা চোখ রেখেছিল শাম্ভবী—সত্যি-মিথ্যা
যাচাই করছিল। হর্ষ অস্বস্তিতে ঘামছিল ভেতরে, নিজের পিঠে গোপন চাপড় মারছিল খুশীতে—ভাগ্যে
মাথায় চমৎকার অজুহাত খেলে গেল! খানিক পরে শাম্ভবী সামলে নিয়েছিল,
“ও-কে,
কুল। অ্যাকচুয়্যালি আমি এখন ডেসপারেট, বাড়িতে যা প্রেশার আসছে, ইউড্ নেভার নো! তোমার
দিকটা আমি ভেবেই দেখিনি, স্যরি ফর দ্যাট।”
“কুউল্।
স্যরির কী আছে? উই ক্যান বী ফ্রেণ্ডস।”
“আমি
আসছি।”
শাম্ভবী বিদেশী কায়দায় আলগা ‘হাগ্’ করেছিল হর্ষকে। সে চলে গেলে হাঁপ ছেড়েছিল হর্ষ, মেয়েটির তীক্ষ্ণ দৃঢ় ব্যক্তিত্ব
তাকে মুগ্ধ করেছে। অদিতির মধ্যে যদি এর দশভাগও থাকত!
লিপিকাকে এর কিছুই জানায় নি হর্ষ, জানানোর কথা মনেও হয়নি।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন