সিনেমার পৃথিবী – ৩০
এই পর্বে আমরা ইউরোপের মাঝের কয়েকটা প্রতিবেশী দেশের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। দক্ষিণ দিক থেকে ক্লকওয়াইজ যদি ওপরে উঠি, তাহলে পরপর দেশগুলো দাঁড়ায়ঃ হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ড।
এই লেখা আমি শুরু করব এক ছোট্ট ইতিহাস দিয়ে যা আমার পাঠক-পাঠিকারা আমার থেকেও নিশ্চয় বেশি জানেন। আসলে কেন এই চারটে দেশকে বেছে নিলাম, সেটা পরিষ্কার না করলে অনেকের ভুরু কুঁচকে থাকবে, তাই। ১৮৬৭ সালে অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি মিলে এক যৌথ মিলিটারি রাজত্ব শুরু করে যা অস্ট্রো-হাঙ্গেরি রাজত্ব বলে পরিচিত। এই যৌথ রাজত্ব ছিল ইউরোপের ইতিহাসে রাশিয়ার পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজত্ব এবং কেউ একে ঘাঁটাতে সাহস পেত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই জোট জার্মানির পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু জার্মানির হার হচ্ছে দেখে এরা সেখান থেকে সমর্থন তুলে নিতে বাধ্য হয়। তারপর ১৯১৮ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি আলাদা ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে আরো কয়েকটা দেশ তৈরি হয়, যার মধ্যে চেকোস্লোভাকিয়া (চেক ও স্লোভাক মিলে এই দেশ ছিল) ও পোল্যান্ড দুটো। কিন্তু এই চার দেশের এক সাদারন ইতিহাস আছে – এরা কোন না কোন সময় নাৎসিদের কাছে পদানত ছিল। নাৎসিদের অত্যাচার সহ্য করেছে। এরপর আরো কিছু ইতিহাস আছে, সেগুলো আমাদের তুলে আনার দরকার নেই, কিন্তু এটা ঠিক – আমাদের আজকের বাছাই এই চার দেশ সিনেমার ইতিহাসে অন্য বেশ কিছু দেশের থেকে অনেকটা এগিয়ে।
হাঙ্গেরির সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি সেই বিশ শতকের শুরু থেকেই সক্রিয়। কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ এই দেশের সিনেমায় প্রচুর প্রভাব ফেলেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাইকেল কার্তিজ (কাসাব্লাঙ্কা ছবির পরিচালক) বা আলেকজান্ডার কর্দা (দ্য থার্ড ম্যান ছবির পরিচালক) হাঙ্গেরি ছেড়ে হলিউড বা গ্রেট ব্রিটেন চলে যান। হাঙ্গেরির একনায়ক নিকোলাস হর্তি যেহেতু নাৎসিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন, ওদেশে তাই ইহুদীদের কাজের ওপর কোপ পড়ে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন একে একে প্রাইভেট স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ১৯৪৬ সালে ওখানে কোন ছবি মুক্তি পায়নি। পঞ্চাশের দশক থেকে হাঙ্গেরির ছবি আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসে।
যে যে ছবি হাঙ্গেরির সিনেমার ইতিহাসে উজ্জ্বল, সেগুলোর কয়েকটা হল - দ্য বয়েজ অব পল স্ট্রীট (১৯৬৮), দ্য উইটনেস (১৯৬৯), লাভ (১৯৭০), ক্যাট’স প্লে (১৯৭২), ফিফ্থ সিল (১৯৭৬), হাঙ্গেরিয়ানস্ (১৯৭৮), মেফিস্টো (১৯৮১), দ্য মিডাস টাচ (১৯৮৮), সাটানটাঙ্গো (১৯৯৪), সান অব সোল (২০১৫) ইত্যাদি। আজ আমরা এর মধ্যে মেফিস্টো নিয়ে আলোচনা করব।
গ্রীক দৈত্য মেফিস্টোফিলিসের গল্পটা মনে আছে? যার কাছে ফাউস্ট নিজের আত্মা বেচে দিয়েছিল? সাবো ইতভানের ১৪৪ মিনিটের ছবি ‘মেফিস্টো’ এক রাজনৈতিক ড্রামা, যা এক অপেরা অভিনেতা ক্লাউস মারিয়া ব্রান্দর-এর ফাউস্ট নাটকে মেফিস্টোফিলিসের সফল অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে। এই সিনেমায় উনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জার্মানির এক অপেরা অভিনেতা, নাৎসি নেতাদের কথামত যাকে স্টেজ অভিনয় করতে হয়। এবং মেফিস্টোফিলিসের অভিনয় করতে করতে যার নিজের সত্বা ঢাকা পড়ে গেছে। তার বন্ধুরা, তার স্ত্রী সবাই নাৎসিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে একে একে চলে গেছে। সে তবুও অক্লান্তভাবে অভিনয় করে চলেছে যাতে নাৎসি নেতাদের থেকে সে এক সামাজিক স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পারে। তাহলে ছবির নাম মেফিস্টো কেন? কারণ ক্লাউস কিছু সামাজিক উন্নতির লোভে তার নিজের আত্মাকে নাৎসিদের কাছে বন্ধক রেখেছে।
এই ছবিকে আমি এগিয়ে রাখি মূলত এর চিত্রনাট্য আর অভিনয়ের জন্য। ভাবুন, নাৎসিদের এক জেনারেল (যাকে সত্যিই মেফিস্টো বলা যায়), ক্লাউসের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপাত্মকভাবে উচ্চারণ করছে ‘actor’! আর তার পাশেই ক্লাউসের ভাবলেশহীন মুখ, অপমান সহ্য করে চলা চোখ। পরিচালক এখানে সচেতনভাবে কস্টিউম ডিজাইনের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছেন যে ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে কিছু লোক আস্তে আস্তে পোশাকের মধ্যে দিয়ে কিভাবে নাৎসি হয়ে উঠেছে। এবং কেউ কেউ কিভাবে নাৎসিদের স্তাবক হয়ে উঠেছে। এই ছবির থিম আমাকে যদি বলতে বলা হয়, আমি এক কথায় বলব ‘transformation’। এর প্রকৃষ্ট উদাহরন, ক্লাউস যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে- my name is not my name because I’m an actor।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অস্ট্রিয়া আর হাঙ্গেরি আলাদা হয়ে আলাদা রাস্তায় চলতে শুরু করার পর অস্ট্রিয়া ১৯৩৮ সালে আবার নাৎসি জার্মানির অংশ হয়ে পড়ে। ছবি তৈরি ধাক্কা খায়। যেহেতু অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জার্মানির এক ক্লোজ টাই ছিল, বেশ কিছু অস্ট্রিয়ান পরিচালক এই দেশ ছেড়ে জার্মানি গিয়ে সেখান থেকে আবার পরে আমেরিকা পাড়ি দেন। যেমন ফ্রিজ ল্যাং (মেট্রোপোলিস) বা বিলি ওয়াইল্ডার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি এদেশে সিনেমা তৈরি আবার শুরু করায়। যদিও সরকার পাশে না দাঁড়ানোয় ১৯৬৮ সাল নাগাত এখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রায় ভেঙে পড়ে। আবার ১৯৮১ সালে সরাসরি সরকারি হস্তক্ষেপে এবং আর্থিক সহায়তায় এখানকার সিনেমা আবার মুখ তুলে দাঁড়ায়। তারপর আর এই দেশকে সিনেমা নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
অস্ট্রিয়ান বিখ্যাত পরিচালকদের ছবির কথা উঠলে বলতে হয় রুজোউইজস্কি-র ‘দ্য কাউন্টারফেটার্স’ (২০০৭) আর হানেকা-র ‘আমোর’ (২০১২) অস্কার পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে এর প্রথমটা জার্মান ভাষায় আর দ্বিতীয়টা ফ্রেঞ্চ, অস্ট্রিয়ান ভাষায় একটাও নয়। বরং অস্ট্রিয়ান ভাষায় উল্লেখযোগ্য - দ্য লাস্ট ব্রিজ (১৯৫৪), দ্য ইনহেরিটর্স (১৯৯৮), দ্য সেভেন্থ কন্টিনেন্ট (১৯৮৯), মাদার্স ডে (১৯৯৩), পিয়ানো টিচার (২০০১), দ্য এডুকেটরস্ (২০০৪), রিভেঞ্জ (২০০৮) ইত্যাদি। এর ভেতর আজ আমরা দ্য এডুকেটরস্ নিয়ে কলম ধরব।
অদ্ভুত ছবি। The Edukators। কে শিক্ষা দেয়? কি শিক্ষা? কিভাবে? পুরোটাই এক সোশাল স্যাটায়ার। বার্লিনের তিনজন যুবক যুবতী – জুল, জান, পিটার। পুঁজিতন্ত্রের ঘোরতর বিরোধী। তারা মাঝে মাঝেই উচ্চবিত্তদের ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আসবাবপত্র নিজেদের মত করে ইন্সটলেশন আর্ট করে দেয়। এবং যাবার আগে লিখে রেখে যায় ‘you have too much money’। কিন্তু বাড়ির এক কণাও সংগে নিয়ে যায় না। নন-ভায়োলেন্ট। এর মাঝে আবার জুল, জান ও পিটারের ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনিও আছে।
পরিচালক হান্স উইঙ্গার্টনারের ১২৭ মিনিটের এই সিনেমা কাল্ট স্যাটায়ার তো বটেই, সিনেমার পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেও এক ধাক্কা। হাতে ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে পুরো ছবি তোলা, খুব কম বাজেটে, ফলে সিনেমাটোগ্রাফি বেশি আশা না করাই ভাল। কিন্তু অভিনয় বেশ ভাল। এখনো মনে আছে ২০০৪ সালের এই সিনেমা আইআইটি-র চাকরি শুরু করার পর ২০০৪ সালেই দেখেছিলাম, পাইরেটেড ভার্সান। বেশ ভাল লেগেছিল। আইডিয়াটা মনে ধরেছিল। তখন বয়স কম, আমরাও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ভাবতাম। এই ছবি দেখার পর বোকা মুচি ও ব্যবসায়ীর গল্প মনে পড়েছিল। বোকা মুচির কোন টাকা ছিল না, তাই তার বাড়িতে কোন দরজা জানলাও ছিল না। সেই গল্প মনে পড়ে? অনেক পরে ছবির পরিচালক উইঙ্গার্টনারের এক সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কোথাও – ‘another theme of the movie is getting rid of one’s fear. It’s important to put an end to anxiety, to stop worrying about safety and security. Freedom is more strenuous than safety… I believe that human beings are nomadic… They need to be free’। বুঝেছিলাম, আমার ভাবনাটা একদম ঠিক।
আগেই লিখেছি চেক প্রজাতন্ত্র শুরু হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়া হিসেবে। তারও আগে এর পরিচয় ছিল বোহেমিয়া হিসেবে। যাই হোক, ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়ার মত চেক প্রজাতন্ত্র-ও নাৎসি জার্মানির অংশ হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ফিরে আসে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে রাশিয়া আবার এই দেশের দখল নেয়। ১৯৮৯ সালে ভেলভেট আন্দোলন করে রাশিয়াকে হঠিয়ে চেকোস্লোভাকিয়া উদ্ধার করা হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালে বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র (ও স্লোভাকিয়া) তৈরি হয়। ১৯৪৫ সালে চেক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হওয়ায় পর থেকেই এদেশের সিনেমা আস্তে আস্তে উন্নত হতে থাকে। এমনকি নব্য বাস্তব ছবিও তৈরি হতে শুরু করে।
এখানকার যে যে ছবির কথা বলতে হয় - বাটারফ্লাইজ ডোন্ট লিভ হেয়ার (১৯৫৯), দ্য হোয়াইট ডাভ (১৯৬০), দ্য শপ অন মেইন স্ট্রীট (১৯৬৫), ডেইসিজ (১৯৬৬), দ্য ফায়ারমেন’স বল (১৯৬৭), ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস (১৯৬৭), দ্য ক্রিমেটর (১৯৬৯), কোলজা (১৯৯৬), রিটার্ন অব দ্য ইডিয়ট (১৯৯৯), গ্রিডি গাটস (২০০০) ইত্যাদি। অবশ্য এই লেখায় আমরা ফিরে দেখব ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস।
জিরি মেঞ্জেল। আমার প্রিয় পরিচালকদের একজন। ওনার ছবিতে চেকোস্লোভাকিয়ার নিউ ওয়েভ সিনেমা আন্দোলন দুর্দান্ত ফুটে উঠেছে। তার মধ্যে সেরা ছবি নির্দ্বিধায় ক্লোজলি ওয়াচ্ড ট্রেনস। এই সিনেমার মূল গল্প হলঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক তরুণ ট্রেনি মিলো জার্মানির দখল করে নেওয়া চেকোস্লোভাকিয়ায় চাকরি করছে। শান্ত স্টেশন, শুধু মাঝে মাঝে নাৎসিরা গেলে স্টেশনে হৈ হট্টগোল হয়। সে মাসা নামক এক তরুণীর প্রেমে পড়ে। তাদের দৈহিক সম্পর্ক শুরু হয়। এবং শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে এক কিশোর আস্তে আস্তে পুরুষ হয়ে ওঠে – ‘all it takes to make a man of a boy is a woman’।
সাহসী থিম। তবে আমার এই সিনেমা ভাল লাগার এক কারণ হল, এই ছবি সাবলাইম, বেশি উচ্চারিত নয় এবং এক সময় বসে দেখতে দেখতে মনে হয়, এটা মাথায় ধাক্কা মেরে বলে যাচ্ছে, জীবন মানুষকে কিভাবে গড়ে তোলে। নাৎসিদের মাঝে বসেও কোন এক কিশোর যুদ্ধ ভুলে, আশেপাশের বাধা বিপত্তি ভুলে গুটিপোকার আবরন ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, বড় হয়ে উঠতে চাইছে। এক শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সে কৌমার্য ভুলতে চায়। নিজেকে নতুন করে জানতে চায়। এর মধ্যে হতাশা এবং যৌনতা দুই মিশে আছে, তার ছোট্ট এক ঘরের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চার লুকিয়ে আছে। মাত্র দেড় ঘন্টার ছবি, কিন্তু মেঞ্জেল এর মধ্যে অনেক কিছু ফুটিয়ে তুলেছেন। এই সিনেমাকে সঠিকভাবেই আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘masterpiece of human observation’। সহজভাবে জটিল কিছু বিষয়কে দেখানো।
তুলনামূলক ভাবে পোল্যান্ডের ইতিহাস অনেক মসৃণ। এখানে প্রথম ছবি তৈরি হয় ১৮৯৯ সালে, এখানেই শুরুর দিকে ‘প্লিওগ্রাফ’ ক্যামেরা (অনেকটা প্রোজেক্টরের মত) বানানো হয়েছিল। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে নিনা নিওভিলা নামক এক মহিলা পরিচালক এখানে ছবিও বানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানেই প্রথম প্রতিবাদ দেখিয়ে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে সিনেমা বানানো হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলন তৈরি করা, ছক ভেঙে আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ইন্ডাস্ট্রির নতুনভাবে বদলে যাওয়া – এসবের জন্য পোল্যান্ড অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে।
পোল্যান্ড মানেই রোমান পোলানস্কির কথা মনে পড়বে। তবে আরো অনেক বিখ্যাত পরিচালক রয়েছেন, যাদের ছবিও মনে রাখার মত। মোটামুটি এই ক’টা ছবি এখন চোখের সামনে ভাসছে - নাইফ ইন দ্য ওয়াটার (১৯৬২), রিপালসন (১৯৬৫), ম্যাথু’জ ডেইজ (১৯৬৮), দ্য থার্ড পার্ট অব দ্য নাইট (১৯৭১), দ্য হাওয়ারগ্লাস স্যানাটোরিয়াম (১৯৭৩), দ্য সিক্রেট গার্ডেন (১৯৯৩), থ্রি কালারস (১৯৯৩-৯৪), দ্য পিয়ানিস্ট (২০০২), কার্নেজ (২০১১), ইডা (২০১৩) ইত্যাদি। আর আজ আমাদের আলোচনার সিনেমা হল ইডা।
পাওয়েল পাওলিকোস্কির অনবদ্য ছবি ইডা। এক সদ্য যুবতী ইডা সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নিতে চলেছে। যাবার আগে সে তার পুরোন গ্রামে ফিরে আসে, এক কাকিমা ওয়ান্ডা-র সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে সে জানতে পারে সেই পোল্যান্ডের সেই গ্রাম যখন জার্মানরা দখল করে রেখেছিল, কিভাবে তার বাবা-মা কে মেরে ফেলা হয়েছিল। সে আরো জানতে চায়। তখন তারা দুজন মিলে এক সফরে বের হয় তাদের অন্যান্য আত্মীয়দের দুর্দশা জানার জন্য।
৮২ মিনিটের এক টানটান মাস্টারপিস। কোথাও মনে হয়নি গতি ঝিমিয়ে পড়েছে বা এখানে একটু অন্যরকম হলে ভাল হত। সন্ন্যাসিনী হবার আগে মানুষের দুর্দশা ও যন্ত্রনা না দেখলে সে বুঝতে পারবে না দুঃখের উৎস কোথায়। তাই এই সফর। এ যেন অবধারিত। সাদা কালো এই ছবির সিনেমাটোগ্রাফি তারিফ করার মত। অভিনয় ঠিকঠাক। ১৯৪০ থেকে ৪৫-এর মধ্যে পোল্যান্ড তার প্রায় এক পঞ্চমাংশ জনসংখ্যা হারায়, যার মধ্যে প্রায় তিরিশ লাখ ইহুদি। নেপথ্যে সেই নাৎসি অত্যাচার। এ ছবি যেন সেই বর্বরতার চুপচাপ ও টানটান দলিল। ইডা ও ওয়ান্ডা – দুজনের অভিনয় যথযথ। কেউ কেউ আবার এই ছবির মধ্যে কার্ল ড্রেয়ারের ‘জোয়ান অব আর্ক’ (আগের পর্বে আলোচনা করেছি) আর ব্রেসোঁর ‘ডায়েরি অব আ কান্ট্রি প্রিস্ট’ –এর ছায়া খুঁজে পান।
সে যাইহোক, আজকের এই যে চারটে ছবির আলোচনা করলাম, ভেবে দেখুন, এর সাধারণ যোগসূত্র একটাই – নাৎসি অধ্যুষিত এলাকা এবং সেখানকার অত্যাচার। সেই কারনেই এই চার দেশকে এক মালায় গেঁথে ফেলার এক প্রয়াস। এবং এটাও উল্লেখযোগ্য, দেখুন, যে চারটে ছবি নিয়ে আলোচনা করেছি, তাদের মধ্যে কেউ হয় প্রোটাগনিস্ট, অথবা কারো মধ্যে প্রোটাগনিস্ট হয়ে ওঠার বীজ লুকিয়ে রয়েছে। নেপথ্যে সেই সামাজিক অসাম্য ও অত্যাচার।
এই লেখা লিখতে লিখতে প্রয়াত হলেন সমরেশ মজুমদার (৮ মে ২০২৩)। খুব মনে পড়ছিল তাঁর অনবদ্য চরিত্র অনিমেষ মিত্র-কে, নক্সাল প্রতিবাদী চরিত্র অনিমেষ মিত্র-কে, কালবেলার অনিমেষ মিত্র-কে। স্বাধীনতার পরে বাংলার রাজনীতিতে অনিমেষ-ও তো একজন প্রোটাগনিস্ট, তাই না?
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন