সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

তানিয়া গুহ মজুমদার

 

সমকালীন ছোটগল্প




ভোরের আলো

নরম তুষের মত অন্ধকার ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঘরে ঢুকে পড়ছে রোদ। কার্তিক শেষ হয়ে আসছে। এই মাসে দুর্গাপুজো। ঘরে এসির হালকা শব্দ আর পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর। ঘুম ভেঙে যায় অধুনার। কিন্তু তখনই যে উঠে পড়ে, তা নয়। আজ রবিবার। তাই গড়িমসি করতে থাকে। উঠবো উঠবো করেও বিছানা ছেড়ে একদমই উঠতে ইচ্ছে করে না। সহেল ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকলেও ডান পা-টা অধুনার পায়ের সঙ্গে জড়ানো। সরাতে একটুও মন চাইল না। বরং সহেলের কাঁধের কাছটা আলতো করে চাপ দিয়ে ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। অবোধ শিশুর মত ঘুমোচ্ছে সহেল। ওর এক রাশ ঘন চুলের মধ্যে বিলি কাটতে থাকে অধুনা।উপুড় হয়ে ঠোঁটের চারপাশে খুব সাবধানে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ঘরে তখন কেবল নৈঃশব্দ আর অধুনার বুকের ভিতর অজস্র ডিনামাইট ফেটে যাওয়ার শব্দ। এক শিশুর মত সহেলের মাথাটা ঠিক বুকের মাঝখানে চেপে ধরে অধুনা।

আস্তে আস্তে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। এর যেন অন্য এক রূপ আছে। হেমন্তের ঠান্ডা মিঠে দিনবড়ো পূর্ণ মনে হয় নিজেকে। খুব সন্তপর্ণে নিজেকে মিশিয়ে রাখতে ইচ্ছা করছে অধুনার সহেলের সঙ্গে। কিন্তু এই অমূল্য মুহূর্তসব সহেল যেন টের না পায়। এসব তার একান্ত নিজস্ব। যে সাতরঙা স্রোত উথলে উঠেছিলে তাদের জীবনে একদিন, তার স্রোত যেন এই অন্য রকম একটা সকালে নিরবচ্ছিন্ন টের পায় অধুনা আবার তার শরীরে।

আচমকা কী যে হয়ে গেল তাদের জীবনে। সব কিছু ওলটপালট। ঘোর অন্ধকারের স্তুপ চারপাশে কেবল। একই বিছানায় দুজন অপরিচিত মানুষ যেন। নাচতে নাচতে এগিয়ে চলা জীবন হঠাৎ নুড়িতে বাধা পেয়ে রুদ্ধ হয়ে গেলকেন যে ছন্দটা কেটে গেল, অধুনা এখনো বুঝতে পারে না। যদিও বাইরে থেকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না এই সংসারে এখন আর সুরতালছন্দ কিছুই নেই। এখনো অনেকেরই ঈর্ষার পাত্র তারা। অথচ এখন কিছুতেই সুরে মিলছে না সুর। তার ছিঁড়ে গেছে যেন। সহেলের মনের মধ্যে যে শঙ্কা, যে ঘৃণা জমেছে, তার তাপ পেতে একটুও অসুবিধে হয় না অধুনার। স্মৃতিতে জমে থাকা সত্যি আর বাস্তবকে মেলাতে তার কষ্ট হচ্ছে। অধুনা খেয়াল করেছে, সহেলের কাছে গেলে সে অপ্রয়োজনে নিজেকে কাজে ব্যস্ত করে তোলে। তার কোন কাজে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবু সহেল যেন ক্রমশ এক রহস্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার এই আচরণের রহস্য ভেদ করার জন্য অনেক সময় অধুনাকে নির্লজ্জ হতে হয়েছে। শালীনতার বাঁধও যে ভাঙে নি, তাও নয়। পারে নি সহেলকে সেই দুর্ভেদ্য ঘর থেকে বের করে আনতে। আজ দু মাস যাবত নিজেরা নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে বারবার। পরিস্থিতি এখন এমনই জটিল যে কেউ কারো কাছে আর ধরা পড়তে চায় না। অধুনার একটুও বুঝতে অসুবিধে হয় না সহেলের ভিতরের তোলপাড়ের কথা। সহেলও নিশ্চয়ই টের পায় তার অস্থিরতা। অথচ কেউই খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। এ কেমন সম্পর্কহীন এক জীবন! দীর্ঘদিন ধরে তারা তাদের অস্তিত্বের সবটুকু রঙ মিশিয়েই তো তৈরি করেছিল এক রামধনু! সেই রঙে ছুপিয়েই তো তৈরি করেছিল পারস্পরিকে প্রবেশ পথ! মোরামে বিছানো রাস্তা নয়, হাজার স্বপ্নের ছটা ছড়িয়ে তৈরি হয়েছিল রাস্তা। হাজারো স্বপ্নের বীজ রোয়া হয়েছিল সে পথে। তাদের সেই স্বপ্নের ঘরে বসতো স্বজনের সমাবেশ। হয়ত সে সমাবেশে কখনও ছিল সামান্য ঈর্ষা, কখনও বা নির্মল আনন্দের। এমনটাই ছিল জীবন, যেন অশেষ এক স্বপ্ন। অথচ এখন কী এক অস্থিরতার মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে সব।

সেই কোন ছেলেবেলা থেকে দুজনে দুজনের পরিপূরক। তবে এখন কেন জীবন মরণের সমস্যা তাদের ঘিরে ধরেছে! অধুনা ছটপট করতে করতে নেমে আসে খাট থেকে। ব্যালকনির চেয়ারে গিয়ে বসে। ডান হাতের করতল চোখের সামনে তুলে ধরে। এমন কেন হল! এ সব কিছুর জন্য কি সে-ই দায়ী? এত উচাটনের দিনযাপন তো আর সহ্য হয় না। অথচ সহেলের হাসি তো তারও হাসি ছিল, অধুনার বিষন্নতা ওকেও বিব্রত করে তুলতো। অথচ এই দুমাসে কতকিছু বদলে গেল সব!

আবার এসে দাঁড়ায় বিছানার পাশে। সহেলের লোমশ শরীর ছুঁয়ে অধুনা আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায় ওর কপালে, বুকে। তারপর খুব সন্তপর্ণে উঠে খাটের নিচে রাখা স্যান্ডেলএর এক পাটি পায়ে গলিয়ে ডান পা বাড়ায় অন্য চটির জন্য। হঠাৎ নাইটিতে টান পড়ে। চোখ বুজেই সহেল অধুনার বাঁ হাতটা ধরে কাছে টানে। অধুনা আছড়ে পড়ে সহেলের বুকের উপর। হু হু কেঁদে ওঠে অধুনা।

বুকের উপর দুহাত আছড়ে অধুনা বলতে থাকে, কি হয়েছে তোমার! আমার অপরাধটা কোথায়? বলো তুমি, বলতেই হবে তোমাকে। তোমার কি হয়েছে? কিচ্ছু শুনতে চাই না, তোমাকে বলতেই হবে।

-যদি বলি, তোমার জন্য? তাহলে খুব কিছু ভুল বলা হবে না বোধহয়। বিশ্বাস ব্যাপারটা এমনই যে একবার হারিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।

-তাঁর মানে! কি বলতে চাইছো তুমি? কি এমন করেছি, যার জন্য বিশ্বাস নষ্ট হয়েছে তোমার?

সহেলের দু হাত চেপে ধরে অধুনা।– বলো। বলতেই হবে তোমাকে।

অপমানে লজ্জায় অধুনার সারা মুখ কালো হয়ে যায়।

সহেল শান্ত গলায় কেটে কেটে বলে, শোনো, আমি ভুলতে পারি নি সে ঘটনা। অন্যের চোখে না, অন্যের কাছেও নয়। নিজের চোখে দেখা। শরীরটা ভাল লাগছিল না বলে আমি সেদিন দুপুরেই অফিস থেকে বাড়ি চলে আসি। তোমার জন্যেও কেন জানি না মনটা উচাটন করছিল। এসে কি দেখলাম!  যা দেখেছিলাম, তার জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না।

-কি ? কি দেখেছ তুমি? বলো? চিৎকার করে ওঠে অধুনা।

-থামো। চিৎকার করে নিজের দোষ চাপা দেওয়ার চেষ্টা কোরো না।

অধুনা খুব শক্ত করে ঠোঁট চেপে রাখে।

-এসে দেখলাম, আমার এই আচমকা এসে পড়ায় তুমি খুব উচ্ছল বা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলে না। অথচ সেটাই স্বাভাবিক ছিল না কি? তোমার চোখে মুখে কেমন যেন সন্ত্রস্ত ভাব। বেশ বিব্রত যেন। আমার পড়তে একটুও অসুবিধে হয় নি। দরজাটা খুলেই দ্রুত পায়ে এ ঘরে চলে এসেছিলে, যা তোমার স্বভাববিরুদ্ধ। তোমার ঐ যাওয়ার মধ্যে যেন কিছু গোপন কাজ সারার তাগিদ ছিল। তুমি বোধহয় মাথায় রাখো নি, ঘরের ঠিক মাঝখানে মানুষ-সমান একটা আয়না আছে। যেটা গত বিবাহবার্ষিকীতে তোমাকে দিয়েছিলাম। সেই আয়নাই যে তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তা তুমি টের পাও নি। তাতেই তো দেখেছিলাম, খুব দ্রুত ত্রস্ত হাতে সামনে রাখা মাটির লাফিং বুদ্ধের পেটের ভিতরে কিছু ঢুকিয়ে রাখছো। তারপরেই কিছু স্বস্তি নিয়ে তুমি যেন এসে দাঁড়িয়েছিলে আমার সামনে। মনে পড়ে? মনে পড়ে তোমার? যদিও জানি, এসব কথা এই মুহুর্তে তোমার মনে পড়বে না।

অধুনা অপেক্ষা করতে লাগলো। ওর জন্য সহেলের আরো কিছু বলার আছে কি! অচেনা মানুষকে দেখলে অচেনাই লাগে। কিন্তু চেনা মানুষ যখন অচেনা হয়ে যায়, তখন হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে কি!

-বেশ। তোমার বলা বোধহয় শেষ হয়েছে। এবার একটু ছাড়ো। আমি এক্ষুনি আসছি।

কপালে ছড়িয়ে থাকা চুল দুহাতে সাপটে পিছনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে এগিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের দিকে। দুহাতে সযত্নে ঈষৎ বাদামী রঙের বুদ্ধমুর্তিটিকে তুলে আনে। সহেল খাটের ধারে দুপা ঝুলিয়ে বসে। তার সামনে দাঁড়িয়ে করুণ চোখে সহেলকে একবার দেখে নেয় অধুনা। তারপর বুদ্ধমুর্তিটিকে দু হাতে মাথার উপরে তুলে আছাড় মারে মেঝের উপর। খান খান ছড়িয়ে পড়ে মাটির টুকরোগুলো। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে হলুদ ইনল্যান্ড আর এনভেলাপ। লালচে হয়ে এসেছে সব। তার মধ্যে থেকে আস্তে তুলে নেয় একটা খাম। খুব সন্তর্পণে অধুনা টেনে বের করে একটা চিঠি। আবছা গোলাপগুচ্ছে ছাপা নীল কাগজ। মেলে ধরে সহেলের চোখের সামনে। তাঁর গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছেফোঁটা ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে চিবুকে। তিরতির কাঁপতে থেকে তাঁর দুই ঠোঁট। কাঁপা গলায় বলে ওঠে, মনে আছে সহেল তোমার, আমাদের বৌভাতে আরো কিছুর সঙ্গে তোমাদের পাড়ার ছেলেরা আমাকে এই চিঠি দিয়েছিল। দ্যাখো, এখনো কাগজে লেখা, “সহেলদা আর বৌদিকে- আমরা ক’জন, ১১ই শ্রাবণ...”আর এর অতিরিক্ত যা কিছু, তারা শুধু আমার, শুধুই আমার, সহেল। একান্ত আমারই। যখন একা থাকি, একদম একা, এরাই আমার সঙ্গী তখন। ওই মুর্তির ভিতর থেকে বের করে এদের সঙ্গে কথা বলি, এদের সঙ্গে হাসি। এরাই সব জাগিয়ে রাখে আমাকে। এরাই তো আমার একান্ত আপন তখন। এদের জন্যেই আমি আর আমার জন্যেই এরা। তাই সেদিন চাইনি, এই গোপনচারিতা তোমার নজরে আসুক। তাই সেদিন বোধ হয় তুমি আমাকে কিছু এলোমেলো দেখেছিলে।

অধুনার নিজের বলতে কিছুই আর থাকলো না। বুক ভেসে যাচ্ছে শুধু চোখের জলে।

সহেলের মাথা নিচু হয়ে যায়। নিজের অজান্তে মাথা নিচু করতে গিয়ে চোখ পড়ে খুলে যাওয়া একটা চিঠির উপর। ‘প্রিয়ভাষিণী’। বুঝতে পারে বিয়ের আগে পরে সহেলের লেখা সব চিঠি ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময় এখন। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে। ঘরের মাঝখানে দুই স্থির শরীর ঘিরে এই হেমন্তের সকালে কথাময় চিঠিগুলো শুধু উড়ছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন