সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

যুদ্ধ ধর্ষণ আন্তর্জাতিক আইন ও পিতৃতান্ত্রিক প্যাঁচপয়জার




আমাদের সমাজে বহুকাল ধরে বহুকথিত একটা কথা আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। কথাটা যুদ্ধ সম্পর্কে এবং ধর্ষণ সম্পর্কে যতটা খাটে, তেমনটা বোধহয় আর  অন্য কোন কিছুতেই ততটা খাটে না। কথাটাকে একটু পালটে নিয়ে আমরা এভাবে বলতে পারি, ‘পুরুষে পুরুষে যুদ্ধ হয় আর নারীরা সব ধর্ষিত হয়’। এখন কেউ হয়ত কথাটা শুনে বলতেই পারেন- ‘কেন? যুদ্ধ তো হয় একটা দেশের সঙ্গে অন্য আর একটা দেশের। শুধু তাইই নয়, একটা দেশ তো আর শুধু পুরুষের নয়। একটা দেশ তো আসলে সমান ভাবে নারীরওতাহলে যুদ্ধের বেলা শুধু পুরুষের কথা  উঠছে কেন? নারীর কথাও তো সমান ভাবে বলা চাই’। কথাটা ঠিকই। তবে কিনা এক্ষেত্রে তাতে একটু সমস্যা আছে। এমন কি যদি কোন দেশের প্রধান পুরুষ না হয়ে নারীও হন, তাহলেও। আধুনিক পৃথিবীতে কোনও কোনও রাষ্ট্রে যে নারী প্রধান নেই বা ছিলেন না তেমনটাও নয়। এই তো মাত্র কয়েক দশক আগে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।  সে সময় কি আর কোনও যুদ্ধ হয়নি, না সেসব যুদ্ধে কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি? কথাটা আসলে তা নয়। কথাটা আসলে এই  উত্তর –মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে আজ অব্দি পিতৃতন্ত্রে যত যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে সেনাবাহিনীর কাজে সবসময়ই থেকেছে পুরুষ। সেই হিসেবে দেখতে গেলে যে কোনও যুদ্ধই পুরুষে পুরুষে হয়। তার চাইতেও বড় কথা ওই যে একটু আগেই ওপরে বললাম – পিতৃতন্ত্র। সেই পিতৃতন্ত্রে নারীরা যুদ্ধে না গেলেও নারীকে ধর্ষণ করাটা যুদ্ধের একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বারবার। দুটো দেশে যুদ্ধ লাগলে জয়ী দেশ পরাজিত দেশের নারীদের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে ধর্ষণ, গণধর্ষণের উপোর্যপরি তাস পেটাতে থাকে মাসের পর মাস এমনকি  এইভাবে ধর্ষণের ফলে নারীরা গর্ভবতী পর্যন্ত হন এবং এইভাবে যুদ্ধশিশুদের একটা প্রজন্ম অব্দি গড়ে ওঠে যারা সমাজের চোখে জারজ শিশু হিসেবে একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খুব সামান্য কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টার বিধ্বংসী রূপ এবার আমরা চটজলদি দেখে নেব যুদ্ধে ধর্ষণের এই খতিয়ান একেবারে শুরু করব আমরা আমাদের নিজেদের ঘর থেকে অর্থাৎ বাংলা বা ভারতের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র থেকে প্রথমে এবং তারপর আমরা আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানগুলো দেখে নেব এবং এটা শুধু এইজন্যেই যে একসঙ্গে ধর্ষণের এই ভয়াবহতা যাতে খুব সহজেই আমাদের মর্মে প্রবেশ করতে পারে

১৭৪২ থেকে ১৭৫৯ অব্দি মারাঠা নেতা রঘুজীর সৈন্যরা বারবার বাংলা আক্রমণ করে যার ফলে প্রচুর বাঙালি নারী ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়। ১৭৫৭ সালে আফগান সম্রাট আহমেদ শাহ আবদালী মুঘল শাসিত ভারত আক্রমণ করে যার ফলে বহু সংখ্যক হিন্দু-মুসলমান নারী আফগান সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত হয় শুধু নয়, আরও বহু সংখ্যক নারীকে অপহরণ করে তারা নিজেদের দেশে নিয়ে যায়।  সম্ভ্রমহানির হাত থেকে বাঁচতে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল সেই সময়। বক্সার বিদ্রোহের সময় আট জাতির জোটের সেনারা চীনা জনসাধারণের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক চৈনিক নারীদের ধর্ষণ করে। তার বাইরে আরও হাজার হাজার নারী অসম্মানের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার  পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। এ বিষয়ে লুয়েল্লা মাইনার লিখেছেন যে রুশ ও ফরাসী সেনাদের আচরণ ছিল বিশেষভাবে নিষ্ঠুর। সেই সময়ের ফরাসী সেনাপতি ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে তুচ্ছ হিসেবে আখ্যায়িত করে শুধু নয়, ফরাসী সেনাদের বীরত্ব হিসেবে সেগুলোকে দেখান। ১৯০৪ থেকে ১৯০৫এর রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশ সেনারা বহু চৈনিক নারীকে ধর্ষণ করে এবং বাধা দিলে মেরে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯৩৯ সালে জার্মান পোল্যান্ড আক্রমণ করে ১৯৪৪ সাল অব্দি নিজেদের দখলে রাখার সময় জার্মান সেনারা অসংখ্য পোলিশ ইহুদি নারীদের ধর্ষণ করে। এমনকি ইহুদী ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার পোলিশ নারীকে ধর্ষণ করে গুলি করে মেরে ফেলে। ১৯৪১ সালে জার্মানী ও মিত্র রাষ্ট্রসমূহ সোভিয়েত আক্রমণ করলে সোভিয়েত সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত হাজার হাজার মহিলা ডাক্তার, সেবিকা ও ফিল্ড মেডিকাল কর্মীরা সেনাদের হাতে ধর্ষিত ও নিহত  হন। কের্চ শহরে জার্মানরা এত নৃশংস অত্যাচার চালায় মেয়েদের ওপরে যে শহরটি মুক্ত হবার পর সেখানে তরুণী মেয়েদের ছিন্নভিন্ন দেহের একটি গণকবর পাওয়া যায়। বিষেশজ্ঞরা মনে করেন জার্মানীর এই সোভিয়েত আক্রমণের সময় এক কোটিরও বেশি সংখ্যক সোভিয়েত নারী জার্মান সেনাদের দ্বারা  ধর্ষণের শিকার হয়েছিল যার ফলাফল হিসেবে ৭৫০০০০ থেকে ১০০০০০০ যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। ১৯৪৪ সালে সোভিয়েত বাহিনী পোল্যান্ড থেকে জার্মানদের বিতারণ করার সময়ে ও সেই সময় থেকে ১৯৪৭ সাল অব্দি এক লক্ষেরও বেশি পোলিশ নারী সোভিয়েত সেনাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৪৫ সালে যখন সোভিয়েত হাঙ্গেরী দখল করে তখন ২০০০০০ হাঙ্গেরীয় নারী  সোভিয়েত সেনাদের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। হাঙ্গেরীয় মেয়েদের অপহরণ করে সোভিয়েত সেনা  ঘাঁটিগুলোতে নিয়ে যাওয়া হত, যেখানে তাদের বারবার ধর্ষণ করা হত শুধু নয়, কখনও কখনও তাদের খুনও করা হত। ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে সোভিয়েত সেনারা জার্মান অধিকৃত অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা দখলের পর পরই সেনারা অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করে।

১৯৪৮ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে হায়দ্রাবাদ শহর দখল করার পর ভারতীয় সেনারা অসংখ্য স্থানীয় মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করে। ভারতীয় সেনারা হায়দ্রাবাদে ধর্ষণকে যুদ্ধের এক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। একটি ঘটনায় ৬ থেকে ৭ হাজার ভারতীয় সেনা ও পুলিশ বরাঙ্গল জেলার  গ্রামগুলোতে হানা দেয় এবং তিনশত নারীকে ধর্ষণ করে। এদের মধ্যে ৪০ জনকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়। ১৯৫২ সালে এগারো মাস ব্যাপী সময়ে উত্তর কোরিয়ায় অবস্থানরত ১১০০০০ সদস্য বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ৪১ জন সদস্যকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ চলা কালে পাকিস্তানি  সেনা ও তাদের সহযোগী আধা-সামরিক বাহিনীগুলোর সদস্যরা ২০০০০০ থেকে ৪০০০০০ বঙ্গনারীকে ধর্ষণ করেছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার দখলদারিত্বে পুর্ব তিমুর থাকাকালীন সেখানকার হাজার হাজার নারী ইন্দোনেশীয় সেনা ও পুলিশদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। পুর্ব তিমুরীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্ত্রী, নারী বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নারী সহযোগীরা ছিলেন ধর্ষিত নারীদের একটা বড় অংশ। অনেক সময় ইন্দোনেশীয় সেনা বা পুলিশরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের না পেয়ে তাদের স্ত্রী, বোন বা অন্যান্য নারী আত্মীয়দের ধর্ষণ করত। বন্দী নারীদের অর্ধনগ্ন করে তাদের ওপর নির্যাতন ও ধর্ষণ চালানো হত এবং তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হত। ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত চলাকালে বাংলাদেশের সেনারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৫০০এর বেশি  উপজাতি নারীকে ধর্ষণ করে। কবিতা চাকমা ও গ্লেন হিলের মতে, উপজাতীয় নারীদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার মাত্রা ব্যাপক। এই সময় বাংলাদেশি নিরাপত্তারক্ষীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্ষণকে যুদ্ধের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সালে আফগানিস্থান দখলের সময় সোভিয়েত সেনারা যেসব আফগান নারীদের  ধর্ষণ করেছিল তাদের পরিবার তাদের অসম্মানিত মনে করেছিল বলে তাঁরা সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হন।

১৯৮০ সালে ইরাক ইরান যুদ্ধে বহু সংখ্যক ইরানি নারী ধর্ষিত হয়েছিল ইরাকি সেনাদের হাতে।  ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে অসংখ্য তামিল নারী ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। আবার ১৯৯০-৯১ অব্দি ইরাকি দখলদারির সময় প্রায় ৫০০ হাজার কুয়েতি নারী ইরাকি সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হন। এবং ওই একই সময় উপসাগরীয় যুদ্ধ  চলাকালে মার্কিন বিমানবাহিনীর ফ্লাইট সার্জেন্ট রোন্ডা কর্নাম এক হেলিকপটার দূর্ঘটনার পর ইরাকি বাহিনীর হাতে বন্দী অবস্থায় তাদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। আবার ১৯৯৫ সালে গৃহযুদ্ধের সময় আফগান যোদ্ধারা কাবুলের হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ করে। ১৯৯১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে সংঘটিত সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ধর্ষণ, যৌনদাসত্ব এবং জোরপুর্বক বিবাহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিদ্রোহী আর ইউ এফ সদস্যরা বহুসংখ্যক নারীকে অপহরণ করে যৌনদাসী কিম্বা যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করে। এরা বেসামরিক নারীদেরও ধর্ষণ করত। এই দলের নারী সদস্যরা এখানকার পুরুষ সদস্যদের যৌনসেবা দিতে বাধ্য থাকত। গণধর্ষণ ও একক ধর্ষণ ছিল দৈনন্দিন ঘটনা। পি এইচ আর-এর প্রতিবেদন অনুসারে এই যুদ্ধের সময় ধর্ষণের  ৯৩%  আর ইউ এফ  সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল। এক হিসেব অনুযায়ী সিয়েরা লিয়নের গৃহযুদ্ধের সময় ২১৫০০০ থেকে ২৫৭০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের  রিপোর্ট বলছে ৬০০০০ এর বেশি নারী  সিয়েরা লিয়ন যুদ্ধে ধর্ষিত হয়েছিলেন এবং ৪০০০০ এর বেশি নারী লিবেরিয়া (১৯৮৯ – ২০০৩),  ৬০০০০ নারী সাবেক যুগোস্লাভিয়া (১৯৯২-১৯৯৫) এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ডেমোক্রাটিক রিপাব্লিক কঙ্গোতে কম পক্ষে ২০০০০০ নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। এমন কি রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্ট থেকে জানা  যাচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হবার পরেও যৌনসহিংস্রতার প্রভাব চলছিল, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ, যৌনতাবাহিত সংক্রমণ  এবং কলঙ্ক ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে। রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, যুদ্ধের পরেও জীবিতদের চাহিদা পূরণ — স্বাস্থ্যসেবা, এইচ আই ভি চিকিৎসা, মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য, অর্থনৈতিক সাহায্য এবং আইনী প্রতিকার – এই সবের জন্য প্রচুর সম্পদের দরকার হয় যেটা বেশির ভাগ সংঘর্ষ-উত্তর দেশগুলোর থাকে না।

(ক্রমশ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন