সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

নীতা বিশ্বাস

সমকালীন ছোটগল্প

 


হৃদ-ব্যাকরণ     

সবকিছুতেই মুনিয়া কাঁদে। যেন ওর নিজস্ব দুনিয়ায় হাসির বা আনন্দের কিছু নেই। হাসতে হাসতে ওর বাবা বলে, ও একটা ছিঁচকাঁদুনে বুড়ি কোথাকার! শুনে আরও কান্না পেয়ে যায় মুনিয়ার। মনে মনে বলে, কোথাকার আবার! জানো না কোথাকার! আমি যে তোমার আর মায়ের বন্ধ ঘরের অন্ধকারের দেয়ালা, একথা জানো না তোমরা? কোনও দরকার ছিল দশ বছর পার করে আর একটা সন্তানের জন্ম দেওয়ার? না, এইরকম লব্জ তখনও শেখেনি মুনিয়া।   

এ অনেক পরের কথা, যখন আশপাশের ফিসফাস বায়োলজির রহস্যহাওয়া ওকে আরও খানিকটা বড় করে দিয়েছে মনে মনে। 'কাঁদুনে' বিশেষণ শুনতে শুনতে মুনিয়ার বড় হয়ে ওঠা। ওর এত কেন কান্না পায়,  কেউ বুঝতে পারে না। কারুর বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে ওর দশবছরের বড়দাদা এগিয়ে এসে বলে, আরে! ওর  কাঁদতেও তোমাদের অনুমতি লাগবে নাকি? হাসি কান্না এসব তো মানুষের স্বাভাবিক ফিলিংসের বহিঃপ্রকাশ! মুনিয়াও তো মানুষ!

সত্যিই তো! মুনিয়া তো মানুষ! তাহলে খুশি-আনন্দের কথায় হাসবে না কেন? ওর কি কোনও খুশি আনন্দের বালাই নেই? ওর দাদাটি ব্যাখ্যা দেয়, আনন্দেও তো মানুষ কাঁদে! এটা যার যার নিজস্ব ব্যাপার।  এতে তোমাদের এত মাথা ঘামানোর কী দরকার বলো তো? শুনে কেউ হয়তো আমিষ গন্ধ পায়। কেউ বলে, আরে যেতে দে! কে মুনিয়া! কেন হাসে না! এসব ফালতু কথা নিয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় অত নেই কারুর।

মায়ের আজকাল খুব সন্দেহ হয়। হাসির কথায়ও তো হাসে না! কেন হাসবে না! তবে কি এটা ওর কোনও বায়োলজিক্যাল গন্ডগোল! আমার কোনও ডিফিসিয়েন্সির কারণে ওর এরকম হলো? নিজেকে অপরাধী মনে হতে থাকে মুনিয়ার মায়ের। ও কি কোনোদিনই হাসতে পারবে না? একটা মেয়ে জীবনে কোনোদিন হাসবে না? ভেবে ভেবে ডিপ্রেশনে ভোগে মা। মায়ের মুখের হাসিও শেষ হয়ে আসতে  থাকে।  

এসব নিয়েই প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে উঠছে হাসিবিহীন মুনিয়া। শরীরে। মনে। এই বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বাতাস কানে এসে নিষিদ্ধ কত কিছু যে জানিয়ে দিয়ে যায় ওকে! টি۔ ভি 'র বিজ্ঞাপনগুলো তো খোলাখুলি কতকিছুই দিনের মধ্যে এক'শো বার রিপিট করে। এসব দেখতে দেখতে  রহস্যের আনন্দ  এই প্রজন্মকে  আর তেমন ভাবে কোনোদিনই শিহরিত করতে পারবেই না! এতসব কথা মুনিয়ার মায়ের চিন্তার মধ্যে দুমদাম পদচারণা করে।  কান্নার রহস্য উদ্ধার হয় না।

মুনিয়া এখন নিঃশব্দে কাঁদে। মুনিয়া এখন ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। বন্ধ দরজার ওপারে উলটো পাল্টা প্রশ্নে রেগে যায়। রেগে গিয়ে আরও কাঁদে। বুঝতে পারে কান্না ছাড়া ওর কোনও উপায় নেই! নোনতা জল ওর মুখের শ্রী'তে ছাপ ফ্যালে। কান্নাই যে মেয়ের ক্যারেক্টারিস্টিক, সে মেয়ের শ্রী কোথায়! না চোখে। না মুখের দ্যোতনায়।  

কান্না বাদ দিলে ওকে কেমন লাগবে ভাবতে ভাবতে পাড়ার ছেলে অর্ণব কখন যেন ছিঁচকাঁদুনে মুনিয়ার প্রেমে পড়ে  গেছে। ভোরবেলা ফাঁকা ছাদের নিরালায় এক্সারসাইজ করতে করতে হাসিমুখের মুনিয়াকে  কল্পনা করে ও। চোখের সামনে মুনিয়া যেন কেমন ভাবে চলে আসে। কিন্তু হাসিমুখে নয়। নির্ণিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে অর্ণব ভাবে একদিন হাসাতেই হবে মেয়েটাকে। এটা ওর নিজের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। যে মেয়ে হাসতে জানে না, তার আকাশছোঁয়া দুঃখের কথা ভেবে অর্ণব  মনে মনে দুঃখে জড়ায়। দুঃখ পেতে পেতে সে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে মেডিক্যাল জয়েন্টের পরীক্ষার জন্য। এরকম আদেখলে কান্নার কোনও মেডিক্যাল গ্রাউন্ড আছে কিনা ওকে জানতে হবে। জানতেই হবে মেডিক্যাল সায়েন্স কোনো মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিতে পারে কিনা।  

একটা সম্মোহনী হাসি দিয়েই কোনও মেয়ে কারো মন জয় করতে পারে, তিন  বছরের কলেজ কোর্সের সৌজন্যে এটা  অর্ণবের জানা হয়ে গেছে। মেয়েটা ওদের ক্লাসেরই। গজদাঁতে কাত করে অনেককিছু করিয়ে নেবার ধান্দা। হাসির মিষ্টি টুকুর সবটাই সুগারকোটিং বুঝতে পেরে আরও বেশি তৎপর হয়ে ওঠে অর্ণব। হাসির আড়ালে লোভ যদি হয়, তবে কান্নার আড়ালে কী! শুধুই অন্যের সিমপ্যাথি আদায়! উঁহু, মন সায় দেয় না ওর।

কিছু অর্জনের পাথুরে পথে হাঁটার দুর্লভ আনন্দই একদিন মুনিয়াকে স্বাভাবিক কষ্টের আনন্দ চিনিয়ে দেবে, আর তখনই স্বাভাবিক আনন্দে হাসতে পারবে মুনিয়া নামের কাঁদুনে মেয়েটা, এরকম একটা প্ৰতিপাদ্যে এসে স্বস্তি পায় অর্ণব। অর্ণব ভাবে, আসলে আমরা মানুষকে ঠিকমত পড়তে জানি না! তার অন্তর্লীন অনুভবের গভীর ব্যাকরণের দিকটা ভাবতে শিখিনি! এইসব ভাবনাগুলো এখন অর্ণবের নিত্যনৈমিত্তিক চিন্তা হয়ে উঠছে। এভাবে মেডিক্যাল ছাত্র অর্ণব ক্ৰমশ দার্শনিক হয়ে উঠছিল। হয়তো এমন কোনও ব্যথা, যা পাঁচজনের সামনে বলা যায় না! হয়তো এমন কিছু কথা যা পাঁচজনের  সাথে শেয়ার করতে পারছে না! চেপে রাখা এইসব তাকে সবসময়ে কাঁদিয়ে দেয়। এইসব অর্ণবকে ডিটেকটিভ বানিয়ে তোলে।

অর্ণব  টিয়ারগ্ল্যান্ড নিয়ে স্পেশাল পড়াশোনা শুরু করে। কর্ণিয়াকে শুষ্ক হতে না দেওয়া টিয়ারগ্ল্যান্ডের চরিত্র বিশ্লেষণে ও মত্ত  হয়ে ওঠে। এটাই এখন ওর প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে। এইভাবে ও জানতে পারে চোখে জল না এলে নাকি নারীসৌন্দর্য তেমনভাবে ফুটে ওঠে না! কেমন কনফিউসড হয়ে যায় অর্ণব। হতেই পারে, চোখের জল গ্রন্থিনিঃসৃত নোনতা তরল, যাতে প্রোটিন এনজাইম হরমোন এটসেটরা দরকারি ব্যাপার-স্যাপার আছে, কিন্তু সুন্দরীর হরিণচোখের জল নাকি পুরুষের মনের ত্রিভুবন ওলোট পালোট করে দিতে পারে! তাজমহলকে দেখে রবিঠাকুর বলেছিলেন, 'কালের কপোল তলে এক বিন্দু নয়নের জল!' কেন?

একটা মেডিক্যাল স্টুডেন্টের কাছে চোখের জলের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই কাম্য। কিন্তু অর্ণবের ভাবনা এখন তাকে নিয়ে গেছে জীবননাট্যের জীবনযুদ্ধের চোখের জলের কথায়। এদিকে রাজনৈতিক নটনটীদের চোখের জলের অভিনয় দেখে আমরা সাধারণ মানুষেরা হেসে ফেলি। তার মানে চোখের জল ক্ষেত্রবিশেষে হাসায় মানুষকে! কিন্তু কথা হচ্ছে, সেগুলো দেখেও মুনিয়া হাসে না কেন? অর্ণব জেনেছে মানুষ আনন্দেও কাঁদে।  অর্ণবের এখন মনে হয়, চোখের জলের কোনও রঙ হয় না - এটা ভুল কথা। এইসব রঙবাজ চোখের জলের গবেষণা অর্ণবকে এমন ধাঁধায় ফেলে দেয় যে ধাঁধার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ওর মেডিক্যালের ফাইনাল পরীক্ষায় আর বাসাই হয় না!

ইতিমধ্যে মুনিয়ার ষোল বছর বয়সের স্বাধীনতায় এসে মনের চেপে রাখা ঘৃণ্য কান্নার দরজায় তালা লাগিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আর সে পারছে না বইতে কান্নার ওজন। ভাবে, কেন সে একাই  জীবনভর কাঁদবে?  এবার শাস্তি পেয়ে তার দাদা কাঁদুক! ছোট মুনিয়াকে ভয় দেখিয়ে তাকে নিয়ে দাদার গোপন পাপের শাস্তি এবার দাদা পাক! দাদাকে দাদা বলতেই ঘেন্না হয় মুনিয়ার। তার থেকে দশ বছরের বড় দাদার নামে পুলিশ স্টেশনে এফ۔আই۔আর করে বাড়িতে ফিরে মুনিয়া প্রথম হাসি হাসবে। অবশ্য ও এখনও জানে না যে এটা ওর শেষ হাসিও হতে পারে! বাড়ির লোকই, যারা মুনিয়ার না-হাসা নিয়ে চিন্তিত ছিল, এফ۔ আই۔আরের কারণ জানার পরে তারাই মুনিয়ার হাসি চিরদিনের মতো বন্ধ করে দিতে পারে!

 

 

 

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন