কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৬ |
তেজস্ক্রিয়তা
ওয়ার্ড বি’ তে এই আই সি ইউর রুমে ঢুকতেই সুশোভনের চোখ সবুজে ধাঁধিয়ে গেল। বেড বালিশ পর্দা চপ্পল সব সবুজ, ডিসপজেবল। এরআগে যিনি ছিলেন, তাঁর লাশ সবুজ কাপড়ে মুড়ে কাপড় চোপড় যাবতীয় ব্যবহৃত নিয়ে গেল। মড়া শুদ্যু পুড়িয়ে ফেলবে। এটি একটি তেজস্ক্রিয় ঘর। অবশ্যি সুশোভনের আত্মবিশ্বাস, তার পরপারে যাওয়া এখনি নয়। যে থেরাপি ডাক্তার তার উপরে করবে সেটা বিদেশে এইবছরেই লঞ্চ হয়েছে। শরীরের ভিতরে মহা উগ্র অবাধ্য দুর্দম ক্যান্সার রোগের জন্য একটি মহা তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরের ভিতরে ঢোকাবে, তাদের বহিরাবরণ গলিয়ে ফেলবে ও কমজোর করে ফেলবে। বলেছে সুশোভন, এম আই আ গিনিপিগ নাউ? নিউক্লিয়ার মেডিসিন ডক্টর জোস জবাব দিয়েছিল, লেটস ট্রাই। সেইমুহুর্তেই সুশোভনের দিদিকে মনে পড়ে গেল। রায়টের সময় একদল উগ্রবাদী উন্মাদের মত ঘরে ঢুকে দিদিকে ধর্ষণ করেছিল। কোনোমতে বেঁচে তো গেল, কিন্তু সে গর্ভবতী হয়ে গেল। নানারকম জড়িবুটি আয়ুর্বেদিক এলোপ্যাথি ওষুধ ওটাকে খালাস করার করতে দিদি ব্যবহার করেছিল, কিছুতেই কিছু হয়নি। পেটের ভিতরে দিব্যি বেড়েই চলেছে। এক সার্জন ডাক্তার বলেছিল, লেটস ট্রাই।
সুশোভন ভাবল, আমারও তো সেই অবস্থা। পেটের ভিতরে অবাধ্য টিউমার ছড়িয়ে পড়ার মুখে। কেমোথেরাপি রেডিয়েশন ওষুধ কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা।
এটেণ্ডেণ্ট নার্সের হেঁড়ে গলায় চমক ভাঙলো তার। এখুনি টয়লেট যাবার থাকে তো সেরে ফেল। বারো ঘণ্টা একদম নড়া চলবে না। সুশোভনের হাতে লাগানো ক্যাথিটার সেলাইনের ছুঁচ। ঘণ্টা দুই পরে একটা মেশিনে ফিট করা ইঞ্জেকশনের সিরিন্জ সেটাতে লাগানো হলো। পি পি ই জ্যাকেট পরা এক ডাক্তার বলল, এটা একঘণ্টা ধরে চলবে।
সুশোভনের বন্ধ চোখে শুধু দিদির ছবিই ভাসতে লাগল। দিদির পেট, পেটের ভিতরে শয়তানী ভ্রূণ, তার সাথে সাথে তার পেটের টিউমারের নিঃশব্দ আর্তনাদ। নাকি অট্টহাসি? সুশোভন গুঙিয়ে উঠল। রুমের ভিতরে ডাক্তার নার্স যেই আসছে, তারা পিপিই জ্যাকেট পরে আসছে। একজন একটা ক্যামেরার মত যন্ত্র এনে তার তেজস্ক্রিয়তা মাপল। সে বলল আপনার সাথে কেউ দেখা করতে এলে সে যেন দুমিটার দূরে থাকে। আপনি নিজেই তেজস্ক্রিয় হয়েগেছেন। এখন কোনো গর্ভবতী মহিলা আপনার কাছে এলে তার গর্ভপাত হয়ে যাবার সম্ভাবনা। অন্তত দু সপ্তাহ ওদের কাছাকাছি আসবেন না। আঃ বারবার গর্ভবতী দিদিকে মনে পড়ছে কেন? কেন কেন আমি জানতে পারলামনা, দিদির গর্ভ খালাস হয়েছিল কি না? আমার পেটের টিউমার কি আদৌ খালাস হবে?
পরদিন সুশোভনের ডিসচার্জ হলো। না, কোনো রিয়েকশন হয়নি। কিন্তু কেমন যেন ঘোরঘোর ভাব। পথ চলতে সুশোভনের পা টলতে লাগলো। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দেখে অজস্র মহিলা। তাদের ক্লান্ত বিষন্ন চোখে ঘৃণা ও প্রতিবাদ। সবার মুখের আদলে দিদির মুখ বসা। সুশোভন মাথা ঝেড়ে ফেলতেই এই মোহটি অদৃশ্য হলো বটে, কিন্তু মনেহলো যেন পথচলতি প্রত্যেকটি মহিলা গর্ভবতী। ওরা কাছে ঘেঁষছে কেন? সুশোভন কোথায় সরে দাঁড়াবে ভেবে পেলনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন