সমকালীন ছোটগল্প |
দ্রৌপদীর পাঁচ
এই গল্পে একটা জুতো আছে। একটাই পাটি। কুকুর মুখে করে অন্যটা দরজা থেকে নিয়ে চলে গেছে। এই গল্পের একটা জুতো যে দরজায় রাখা আছে, সেই দরজাটা আমড়াকাঠের বলে, বাতাস বইলে দরজার নিজস্ব টক্ টক্ গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য গন্ধটা বাড়ির বাইরে যায় না। তবে যাবেনা, একথা জোরের সাথে বলা যায় না। ঝড়বাদল আসলে আমড়াকাঠের দরজা যদি ভেঙে যায়, তবে তো সেদিন টকগন্ধ এই বাড়ি ছাড়িয়ে পাড়া ছাড়িয়ে সারা দেশেই ছড়িয়ে যাবে! দরজার পাল্লা দুটো চৌকাঠের সাথে কব্জা করা আছে ভেতর থেকে। তাই, বাড়ির মালিক এবং একাকী বাস করা কালো রংএর জীবনের লুৎফর রহমান-এর একসময়ের ভোগ্যা ও পরবর্তীতে স্ত্রী, রাবেয়া বেগম তার বক্তব্যকে এইভাবে পেশ করছেন।
তাঁর বক্তব্যে -
আমি আছি। বেশ আছি। লুৎফর-এর দাফনের পরে মূলতঃ আমি একাই। এই যে একটা বাড়ি, আর, সদরের আমড়াকাঠের দরজা থেকে টোকো গন্ধে ম্ ম্ করা অন্দরমহলে মৃত স্বামী লুৎফর, আমি রাবেয়া বেগম, কন্যা সন্তান কবরী সহ আমাদের নিজেদের একটি পারিবারিক ছবি ঘরের দেওয়ালে টাঙানো আছে, সেখানে ধুলো জমে। আমি নিজের হাতে প্রতিদিনই ধুলো মুছি ফটোফ্রেম থেকে। আমার আবার ডাস্ট এলার্জি আছে। কখন যে, হাঁচি শুরু হয়ে যাবে, সে বিষয়েও সংশয়ে থাকি!
গল্পের আড্ডা চলছিলো বুনিয়াদপুরের ঈশান ক্যাফেতে। আয়োজক সংস্থা ঈশান ক্যাফের প্রতিমাসের এমন গল্পের আড্ডায় পঠিত গল্পগুলোকে বইমেলা সংখ্যায় ‘বাছাই ঈশান গল্পপাঠ’ নামে এক দুই তিন করে প্রকাশিত হয়। তারপর সেগুলো বহু মননশীল পাঠকের হাতে হাতে জেলা ছাড়িয়ে উপজেলা, সদর থেকে ভিনরাজ্যে পাঠকের আদরণীয় হয়ে ওঠে।
এই যেমন, এই মুহূর্তে রাবেয়ার অ্যালার্জি-টেস্টের পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্টের ওপর চোখ বোলাচ্ছেন ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক, কবি ও ঝুরোগল্পকার কাজল সেন। উনি পেশায় অণুজীব চিকিৎসক বলেই হয়তো ধরতে পারলেন যে, রাবেয়া আসলে বহু সংশ্রবের পুরুষদের একজন নারী, যে মুসলিম জনজাতি অংশের সৃষ্টি হলেও, অদ্ভুত রকমের রহস্যময়ী!
ঠিক, এই অংশটিতে এসে কাজল সেন লুৎফর রহমান-এর স্ত্রী-কন্যা সহ পারিবারিক ছবিটি থেকে এডিট করে রাবেয়ার ছবিকে আলাদা করে নিলেন। এরপরে সাদা রং-এর বেলকুঁড়ির মালাকে খোঁপা থেকে আলগোছে তুলতেই ঢল নামলো রাবেয়ার চুলের। এই সেই কেশ - এতটাই দীর্ঘ যে, তা একটা পথ হয়ে মহাভারতের একশো কৌরবের হাতে নিগৃহীতা দ্রৌপদীর অন্দরমহলে ঢুকে গেলো।
অতএব, সম্পাদক কাজল সেন, তিনি পথহীন-দেশে দেশে ঘুরে এই মুহূর্তে তাঁর হাতের পাওয়ারফুল আতসকাঁচে অণুজীবীয় বংশগতিবিদ্যার ধারক ও বাহকদেরকে ধরতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রাবেয়া আবারও একটা জোরে হেঁ…চ্চো করে হাঁচি দিলো। আর ওমনি কাজল সেন, কবরের মাটির ভেতরে শায়িত হিমশীতল মৃত লুৎফর রহমানের শরীরের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে বাস করা পঞ্চপাণ্ডবকে ধরে ফেললেন।
এখন গভীর রাত। বিদুষী নারী রাবেয়ার অণুজীবীয় চলনকে পর্যবেক্ষণ করবার জন্য কাজল সেন লুৎফর ও রাবেয়ার বেডরুমের পাশের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে চুপ করে বসে আছেন। বাইরের বাগানের ঘুমন্ত গাছগুলোর সবুজ রং ঠিকরে এসে ধরা দিয়েছে তার হাতে ধরা পুরু আতসকাঁচে। বসে থাকতে থাকতে যা হয়, ওই ওয়াশরুম-টুম আর কী!
মিনিট তিনেক কী চারেক! ফিরে আসতে আসতেই ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক, কবি ও ঝুরোগল্পকার কাজল সেন দেখলেন যে, লুৎফর রহমানের ঘরের সদরে আমড়াকাঠের দরজার বাইরে মহাভারতীয় চরিত্র যুধিষ্ঠিরের একপাটি জুতোকে একটি কুকুর মুখে করে নিয়ে দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে। আর ফটোফ্রেম থেকে বে্রিয়ে অন্যটিকে হাতে নিয়ে মৃত লুৎফর রহমান বাইক স্টার্ট করছে। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে চারধার।
কাজল সেনের একহাতে ওয়ারেন্ট, অন্য হাতে কলম।
গর্জে
উঠলেন তিনি - হ্যান্ডসআপ!
আর,
ওমনি কাজল সেনের এডিট করা রাবেয়া ঘরের ভেতর থেকে হেঁ…চ্চো দিয়েও কুকুরকে চিৎকার করে
অভিশাপ দিয়ে ফেললো -
তোর
ওপেন সেক্সুয়াল লাইফ দশজনা দেখবে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন