সমকালীন ছোটগল্প |
পিছিয়ে দেওয়াল
‘তপু দরজাটা বন্ধ কর’! কথাটা কানে গেলেও তপু তখন জানলা দিয়ে পাশের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। পুকুরটা বড় নয়, তবে চারদিক অসংখ্য বড় বড় তাল আর খেজুরগাছ। ওখানেই সকাল দিকে ক্যাওট পাড়ার অবনী দুটো ট্রাকের টিউবে একটা পাটা বেঁধে মাছ ধরে। তারপর বড় বড় বাঁশের কাঁটা সারা পুকুরে ফেলে দেয়। তপুর বাবা পুকুরটার নাম বলেছে,‘নিমাই দিঘী।’
‘দিঘী তো অনেক বড় হয়, এটা তো ছোট।’ ক্লাসে দিদিমণি পড়া বোঝানোর সময় এই কথাগুলোই তার মনে আসে। বুঝতে পারে না, কাউকে জিজ্ঞেস করলেও সঠিক জানতে পারে না, খুব মুশকিল। তপু জানলাতে পা ঝুলিয়ে মাছ ধরা দেখে। মা তখন অন্য পুকুরে স্নান করতে যায়। কিছুটা রান্না করে নেয়, বাকিটা এসে করে। বাবা সকাল আটটাতে খেতে বসে, সাড়ে আটটায় অফিসে বের হয়। তপুর পৃথিবী মানে এই জানলা আর তার সাথে লাগানো বিছানা। এখানেই শুয়ে শুয়ে দুপুরে আকাশও দেখে। সকাল দিকে উল্টো দিকের নাপিত পাড়ার বৌগুলো পুকুরে আসে। পায়খানা করে, স্নান করে, এই সময় তপু জানলা থেকে সরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। ভয় লাগে, ‘কেউ যদি দেখে ফেলে!
একতলাতে বড়জ্যাঠা থাকে, বড় জেঠিমাকে তপু ‘বৌমা’ বলে। বৌমা সকাল থেকে সারাটা দিন রান্নাঘরে থাকে। তপু একবার জানলা থেকে নিচে পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল। বৌমা সব্জি ধুচ্ছিল। গায়ে না পড়লেও চিৎকার করছিল। তপু কী করবে, দুপুর বেলাতেও যে তার ভয় করে!
বাবা বলেছে, ‘দুপুরে কোনদিন নিমাই দিঘীর দিকে যাবি না, বিজয় মামাদের বাহাদুরটা দুপুর বেলাতেই ওখানে ডুবে মরে গেল, তাও গ্রীষ্মকালে, সেরকম জল ছিল না।’
দুপুরে তপুর ঘুম আসে না, পাশে মা ঘুমায়, তপু পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, তালগাছ দ্যাখে, খেজুর গাছ দ্যাখে, আর নাপিত পাড়ার ছেলেগুলোকে দ্যাখে। ওরা কী সুন্দর দুপুরে পুকুর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ঝোপে হাত দিয়ে হাঁসের ডিম খোঁজে, পেলে কুড়ো জ্বালিয়ে ডিম সেদ্ধ করে। তপুর খুব তাদের মত ঘুরতে ইচ্ছে করে, ডিম সেদ্ধ খেতে ইচ্ছে করে, মা বকে, দরজা বন্ধ করে, চাবি নিজের বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়। তপু দুপুরেই ছাদে ঘুরতে চলে যায়। একদিন হনুমান তাড়া করেছিল। তপু ছুটে ঘরে চলে এলেও দরজা লাগায় না, একটা হনুমান ঘরে ঢুকে যায়। তপু চিৎকার করে। মায়ের ঘুম ভেঙে যায়, বিছানায় উঠে বসে, বিছানার নিচে হনুমান। মা চিৎকার করে ওঠে। হনুমান মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে খোলা বারান্দা দিয়ে পালায়। মা আবার তপুকে বকে, ‘কতবার বলেছি দরজা বন্ধ করবি, দেখলি তো কেমন হনুমান ঢুকে গেল! ’
মায়ের এই কথাগুলোই তপুর দু’কানে ঘোরাফেরা করে। এমন অবস্থা দুপুরে বন্ধ জানলার পাশে বসে থাকে, ভয় লাগে হনুমান যদি জানলাতেও এসে যায়! একদিন তো এসেছিল, তপু সেদিন জানলাতে দুটো পা ঝুলিয়ে সকালে টিফিন খাচ্ছিল। সামনে বিজয় দাদুদের রান্না ঘরের চালে হনুমান আসছে, নামছে, লাফাচ্ছে, উঠছে, পড়ছে। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ তপুর টিফিন খাওয়া দেখে একটা হনুমান এক লাফে জানলার দুটো লোহার রড ধরে ঝুলে পড়ল। তপু টিফিনের বাটি ফেলে বিছানার উপর বসে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল। মা সেই সময় নিচে বৌমার সাথে কী একটা দরকারে বৌমার রান্নাঘরে গেছিল। তারপর পুজোর ছুটিতে পিসির ছেলে পিন্টু এল, তপুরই বয়সী, কিন্তু বেশ চাবুক ছেলে। এসেই সারাটা দিন পুকুরের পাড়ে বসে থাকত। তপুকেও থাকতে হত, পিন্টু একক্লাস উঁচুতে পড়ত। তপু সিক্স, পিন্টু সেভেন। তপু তাও দাদা বলত না। পুকুর পাড় থেকে তার পাশের রমাদিদের বন্ধ থাকা একতলা বাড়ির ছাদে উঠে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। সেই সময় পিন্টু ঐ বয়সে বিড়ি ধরিয়ে তপুর মুখে গুজে বলে ওঠে, ‘নে এবার সুখটান দিয়ে পুকুরে মাগীদের স্নান দ্যাখ, এই সব আমাদের ওখানে পাওয়া যায় না।’
পিন্টুদা ঐ বয়সেই বাসে চেপে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা ভিডিওহলে অসভ্য সিনেমা দেখতে যেত। একবার পুলিশে রেড করেছিল। হলের পিছনের দরজা দিয়ে দৌড়। অনেকটা গিয়ে তারপর বাসস্ট্যাণ্ড পেয়েছিল। তপুর এই সব ঘটনা মাথার উপর দিয়ে যায়। তখনই নিজেকে খুব ছোট লাগে। এমন একটা জায়গায় থাকে, এতটা বড় হ্ল, কিছু জানে না। পিন্টু’দা ছেলেদের স্কুলে পড়ে, তাও সময় অসময়ে মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা গার্লফ্রেণ্ডও বাগিয়ে নিয়েছে। আর তপু নিজে…
‘তুই চিরটাকাল মায়ের ভয়েই মরবি, ফুলশয্যার রাতেও বৌয়ের পাশে শোওয়ার আগে মায়ের ভয়ে প্যাণ্টে মুতে ফেলবি।’ কথাগুলো সত্যিই। তপু ভাবে, আর চোখের সামনে পিন্টুদার বিড়ির ধোয়া মেঘের মত আকাশের বুকে ছড়িয়ে যায়। তপু পিন্টুদার হাত থেকে বিড়িটা নিয়ে টানতে যায়, এমন সময় ছাদের দরজা খুলে যায়। রমাদি তপুর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘তাই তো ভাবি, ছাদে এখন কে থাকবে, তোরা এই বয়সে এখানে বিড়ি ফুঁকছিস?’ তপু ভয়ে কাঁপতে থাকে, কিছু কথা বলতে পারে না। রমাদি তপুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি আজই কাকিমাকে বলছি।’
পিছন ফিরে দ্যাখে পিন্টু ততক্ষণে ছাদ থেকে প্রাচীর ডিঙিয়ে নিচে নেমে গেছে। তপুর সামনে রমাদি? নাকি যমের স্ত্রী’লিঙ্গের কেউ?
(২)
–তোমার যত সব বেশি বেশি, আরো তো সবাই আছে, কে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
–কেউ যাচ্ছে না বলে আমরাও যাবো না, সেটা তো হতে পারে না। তাছাড়া তপু বড় হচ্ছে, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনা কিছুই হবে না। এই তো বিড়ি ফোঁকা শুরু করেছে, কদিন পরে আরো কিছু আরম্ভ করবে। তোমাদের পাড়ার কেউ তো পড়াশোনা করে না, সারদিন খালি ঘুরে বেড়ায়, আর একটু বড় হলেই প্রেম করতে আরম্ভ করে। এখানে থাকলে তপুর কোনদিন ভালো রেজাল্ট করতে হবে না। তপু কিছু বলতে পারে না, মায়ের উপর বাবাও কথা বলতে পারে না, তপুও তো নয়ই। মা স্কুল আর টিউশন ছাড়া তপুকে বাইরে বেরোতে দেয় না। তপু তাও টিউশনে থেকে মাঝে মাঝেই একটু দেরি করে ফেরে, মাঠে তার বয়সী ছেলেটা খেলে, গাছে চড়ে, সাঁতার কাটে। তপু তাদের কাছে গেলেই তারা মজা করে বলে ওঠে, ‘কিরে, তুই এখানে কেন, যা শুয়ে শুয়ে মায়ের দুধ খা, বাইরে বেরোলে তোর মা এক্ষুণি আমাদের পর্যন্ত বকতে আরম্ভ করবে।’
তপু বাড়ি ফিরে মায়ের উপর রেগে যায়, কিন্তু বলতে পারে না, ‘আমি গাছে চড়ব, সাঁতার কাটব, খেলব।’
প্রাইমারী স্কুলে পড়বার সময় হেডস্যারের এক নাতি স্যারের বাড়িতে থাকত। কী সুন্দর মোষের পিঠে চেপে স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াত! তপু তার দিকে একঠায়ে তাকিয়ে থাকত, পড়াতে মন বসত না। কথাগুলো বাড়ি ফিরে মাকে বলতেই মা পরের দিন হেডস্যারের সাথে দেখা করে টিঙ্কার নামে কি সব বলে আসে। হেডস্যারের নাতি চলে যায়।
(৩)
–নতুন জায়গায় এসেও মায়ের কিছু পরিবর্তন হয় না, বরং এখানে এসে বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যায়। অফিস যেহেতু কোয়ার্টার দিয়েছে তাই বাবার তিন শিফ্টে কাজ আরম্ভ হয়। মা সব কিছু সামলে তপুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলে নিয়ে যায়, টিউশনে নিয়ে যায়, এমন কি বিকেলে একটা জায়গায় বাবা ফুটবল খেলা শেখার জন্যে ভর্তি করেছে, সেখানেও মা নিয়ে যায়। যতক্ষণ খেলা শেখে মা বসে থাকে। সবাই হাসে, এমনকি টিউসনের মেয়েগুলো পর্যন্ত বলে, ‘হ্যাঁরে, তোর মা কি এখনও তোকে ছুঁচুও করে দেয়।’ অথবা ‘তোর তো বেশ ভালো, বাড়ি যাবি মায়ের দুধ খাবি, ঘুমিয়ে পড়বি।’
তপু শুনে যায়, কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে জল পড়ে, গালে আসার আগেই তপু চোখের জল মুছে দেয়, মায়ের চোখে পড়লে এক্ষুণি চিৎকার আরম্ভ করবে। মেয়েগুলোকে বকবে, তাদের মায়েদের সাথে ঝগড়া আরম্ভ করবে। তপুর খুব খারাপ লাগে, প্রতিদিন বাবাকে বলে, বাবা মাকে বললেও কাজের কাজ কিছু হয় না। উল্টে মা বাবাকে বোঝাতে আরম্ভ করে, ‘এক্ষুণি কিছু হয়ে গেলে কে দায়িত্ব নেবে? তুমি!’
-তা বলে ছেলেটাকে ভ্যাঁদাকান্তের মত করে মানুষ করবে? ওকে একা ছাড়ো, পৃথিবীটাকে দেখুক, চিনুক, খারাপ লোক ভালো লোকের পার্থক্য বুঝুক।
-বাড়িতে থাকতে তো একা ছেড়ে দিয়েছিলাম, কী হল, তোমারই বোনের ছেলে তপুকে বিড়ি খাওয়া শেখাচ্ছিল।
–আরে ও যদি শেখে তুমি বারণ করলে কিছু করতে পারবে? এখন ক্লাস নাইন, মাধ্যমিক, হায়ারসেকেণ্ডারি, তারপর তো কিছু প্রফেসেনাল কোর্স করাতে হবে। তুমি কি সেখানেও যাবে?
(৪)
এই বছর থেকে একা একা পড়তে যাচ্ছে। বাবা বহু কষ্টে একটা সাইকেল কিনে তপুকে শেখাল। তাও প্রথম দিকে বাবা রেগে যেত, তপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠত, ‘লোকে কী বলবে, এই বুড়ো ভাম, এখন সাইকেল শিখছে। চারদিকে দ্যাখ, তোর বয়সি আর কে সাইকেল শিখছে। সবাই এই সময় বাইক চালাচ্ছে, একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
তপু
বলতে পারে না এতে আমার কি দোষ, আমি তো সব কিছু করতে চাইছিলাম, মা বারণ করে এক্কেবারে
শেষ করে দিল।’
সাইকেল চালায়, রাস্তায় ধাক্কা লাগে তারপর কাঁপা হাতে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যায়। পাশের পাড়া থেকে সুমনা নামে একটা মেয়ে যায়। তপুর মা তার সাথে তপুকে পড়তে পাঠায়। সারাটা রাস্তা সুমনা তপুর উপর চিৎকার করতে করতে যায়। টিউশনে বাকি ছেলেমেয়েরা তপুকে প্যাঁক মারে, ‘তুই কি বসে বাথরুম করিস?’ ‘তোরটা কাটা না গোটা?’ ‘গোটা থাকলে দাঁড়ায়?’
তপু বাড়িতে এসে এবারেরও কাউকে কিছু বলতে পারে না। মায়ের ওপর রাগ হয়, কিন্তু মায়ের মুখের উপর কোন কথা বলতে পারে না। পিসির ছেলে পিন্টুর কথা মনে আসে, কয়েকটা দিন পিন্টুর সাথে থাকলে…। পিসির কথা শুনলেই মা রেগে যায়। বাবাকে বলে, ‘না, ওদের এখানে আসতে হবে না। বাড়ি গেলে ওখানে যেতে বল।’ কিন্তু বাড়ি কীভাবে যাবে? বাবা তো শুধু একাই যায়।
(৫)
রাত হলেই একটা জঙ্গল তপুকে যেন গিলে খেতে আসে। তপু আর মায়ের কাছে শুতে চায় না, একটা ঘরে একা শোয়। তপু ভয়ে চোখ বন্ধ করে। তাও জঙ্গলটা এগিয়ে আসে, সব গাছ থেকে হাত বের হয়, তপুকে জাপটে ধরে তপু ঘামে, সারা শরীরে একটা শিরশিরে হাওয়া বয়ে চলে, কেমন যেন অস্বস্তি হয়, তপু চোখদুটো বন্ধ করে দেয়। সেই সময়েই বারমুড়ায় টান লাগে, ভিজে যায়, চাদরেও দাগ লাগে। পরের দিন বিছানা গোছানোর সময় দাগে মায়ের চোখ যায়। তপুর দিকে তাকায়, কিছু বলতে পারে না, তাও কেমন যেন অদ্ভুত লাগে, মাকে জঙ্গল মনে হয়, মায়ের শরীরে পাতা, ডালপালা, তপু আর পিছিয়ে যেতে পারে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন