ধারাবাহিক
উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(৩৫)
অপেক্ষা করছে দেবার্ঘ্য, ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছে মাথা থেকে, মন থেকে।
আগে এমন বেশ কয়েকবার তার সম্বন্ধ দেখা হয়েছে, জোড়া লাগেনি। সেও দু-দিনে ভুলে গেছে।
এবারে কেমন টান বুকের মধ্যে, অদ্ভুত কিছু সন্ধিসমাস। শুকনো মুখ, রুক্ষ চোয়ালের রাগী
মেয়ের চোখদুটোতে ঘন বিষাদের ছায়া লেপ্টে থাকে—ছবিটা গোপনে
বুকে জমা রেখেছে সে। তার মা আশাহত হওয়ায় বিরক্ত, বারবার উপরোধ করছেন অন্যত্র যোগাযোগ
করতে। দেবার্ঘ্য প্রত্যুত্তর করেনা, দু-একবার শুধু বলেছে,
“আগে
এই ব্যাপারটা পুরো এণ্ড হতে দাও। তারপর ভেবে দেখছি।”
ব্যক্তিত্বময়ী মা কথা বলেন কম। অনেক ঝড়ঝঞ্ঝায় বড় করেছেন সন্তানদের—তাঁর
কথা ঠেলতে খারাপ লাগে দেবার্ঘ্যর। এমনি এমনিই আরও সম্বন্ধ আসছে এদিক-ওদিক থেকে, প্রত্যেকটা
কলকাতার। দেবার্ঘ্য উৎসাহ পায় না। সেকারণে সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে মরিয়া হয়ে মেসেজ করে
ফেলেছে শ্রুতিকে, জবাব আসে নি। অভিমান হয়েছে, এতই বুঝি গুরুত্বহীন সে? একেবারে ফালতু?
শ্রুতি হ্যাঁ-না কিছু জানায়নি দেবার্ঘ্যর মেসেজের জবাবে। কলকাতায় নিজের
ঘরের পাশে পেয়ারা গাছটার দুলুনি ছায়া হয়ে চশমার কাচে ভেসে এসেছে, মনে পড়েছে ফেলে-আসা
শহরটা। সম্প্রতি তার চোখে অল্প পাওয়ার হয়েছে, মুখের সঙ্গে মানানসই বড় ফ্রেমের চশমা
নিয়েছে। নিজের ঘরে বিছানায় বসে ল্যাপটপের কী-বোর্ডে অন্যমনস্ক আঙুল বোলায়। বিনীথাম্যাডামের
ব্যবহার ভালো হলেও ব্যবসায়ী মানুষ, পি-জির অর্থ সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব আয়। বেশ ক-বার
রেন্ট বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন।
শ্রুতি বিমনা আছে নানা কারণে, একেবারে সম্প্রতি তাদের কম্পানির বেশ
ক’জন
কর্মীকে প্রায় বিনা নোটিসে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামী মাস থেকে
আর প্রয়োজন নেই। খবর আছে বহু নামী কম্পানি এমনকী বিদেশের কম্পানিগুলো পর্যন্ত এই কাণ্ড
করছে। মানুষের দাম ক্রমশঃ আরও কমছে, ভোগবাদী পৃথিবী জুড়ে ভয়ানক মন্দা আর মুদ্রাস্ফীতির
কুফল! চিন্তিত হয়ে আছে শ্রুতি, আশঙ্কায় মাথা ভার। যদিও অফিসে তার কাজের রেকর্ড ভালো,
ভাবে আপাতত স্যালারি-হাইক না হলে না হোক, চাকরি বজায় থাক।
দেবার্ঘ্য আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করে থাকে, তারপর এক রাতে হঠাৎ ফোন করে।
শ্রুতি ঘুমের সাধনা করছিল, ঘুম বেশ পাতলা হয়ে গেছে। ক্লান্ত ঘুম-ঘুম গলায় ফোন ধরে,
“হ্যালো
কাকে চাই?”
“শুক্রবার
সন্ধেবেলা পৌঁছাবো। দেখা করে রবিবার ফিরবো।”
“মানে?”
“অনেক
দাম দিয়ে টিকিট করেছি। ‘দেখা করবো না’ বলে নখরা কোরো না!”
শ্রুতি কথা বলার আগে ফোন কেটে দেয় দেবার্ঘ্য। নীরব ফোনের দিকে গনগনে
চোখে তাকিয়ে থাকে শ্রুতি। অথচ বুকের মধ্যে অদৃশ্য কোনো জলতরঙ্গ টুং করে ওঠে, আগে কোনওদিন
‘তুমি’ সম্বোধন করেনি তো লোকটা।
চোখ জুড়ে নেশার মতো ঘুম নামে, শ্রুতি ঘুমিয়ে পড়ে।
বাবুলের অফিসে একটি মেয়ে সদ্য জয়েন করেছে, ঊর্বী রায়। বাবুলের চেয়ে
অনেক জুনিয়ার, আপাতত তার টিমে আছে। মেয়েটির সি-ভি নাকি দারুণ বলছিল বাবুলের এক কলীগ,
অথচ মেয়েটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই। চেহারা মোটার দিকেই, গোলমুখ, ঝামুর-ঝুমুর কোঁকড়া
চুল বেশীর ভাগ সময়ে ক্লাচারের বাইরে ঝুলতে দেখা যায়। কথায় কথায় হেসে ওঠে, বকুনি খেলে
দশ-বিশবার স্যরি বলতে বাধে না। একটা কাজ বোঝানোর দরকারে লাঞ্চ-ব্রেক-এ অফিস ক্যান্টিনে
ডেকেছিল হর্ষ। কাজের বিষয়ে হর্ষ অতিরিক্ত সিরিয়াস। খানিকটা সময় ধরে মন দিয়ে বুঝল ঊর্বী,
তারপর গোমড়া মুখে বলল,
“খিদে
পেয়েছে আমার। খিদে পেটে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারিনা।”
হাসল হর্ষ,
“ও-কে
ফাইন। কী খাবে বলো?”
“এনিথিং
স্যর।”
হর্ষ অর্ডার দিয়ে নিজের ল্যাপটপে মন দিল, ঊর্বী গলা উঁচু করে ডাকল,
“হ্যালো
স্যার, আমি কি উঠে যাবো?”
বিরক্ত হল হর্ষ,
“নো
নট্ অ্যাট অল্। খেয়ে নাও, তারপর নেক্সট্ পার্ট্ উই উইল ডিসকাস।”
ঊর্বী নিজের দাঁতে-কাটা ছোট্ট নখগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে লাগল।
অল্পক্ষণ পরে অধৈর্যভাবে বলল,
“দূর
বাবা, আমি উঠে যাচ্ছি। খুব দেরী করছে খাবার আনতে!”
হর্ষ হেসে ল্যাপটপের ঢাকা বন্ধ করল। ঊর্বী বলল,
“অফিসের
লোকগুলো কেমন যেন।”
“কেন?”
“হাসে
না, আড্ডা মারে না, খালি কাজ করে।”
হর্ষ ভালো করে তার মুখের দিকে তাকায়, চোখের তারায় চিকচিক করছে কৌতুক।
স্বচ্ছ আলোর মতো মুখ, ঈষৎ গোলাকৃতি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। ঊর্বী বলে,
“একটা
কথা বলবো স্যার?”
“কী?”
“আপনি
জিম করেন?”
“নট্
রেগুলারলি। কেন?”
“না
আই থট্ যে—এনিওয়েজ্,
আচ্ছা আপনাকে স্যার না বলে অন্য কিছু বলতে পারি? হর্ষদা?”
দু-প্লেট গরম ছোলে-ভাটুরে নিয়ে এসে টেবিলে রাখে ক্যান্টিন বয়। জবাব
না দিয়ে খাবারে মন দেয় হর্ষ। ঊর্বী একটু একটু করে খায়, আপনমনে হাসে। খানিক খেয়ে ঢকঢক
করে জল খায়,
“উঃ
কী ঝাল!”
হর্ষ মুখ তুলে তাকায়, মেয়েটার কি মাথার গণ্ডগোল আছে?
অফিস ফেরত ইদানিং আর দু-জনের সঙ্গে একটা পুল-ক্যাবে সে যাতায়াত করছে, খরচ বেশ খানিকটা কম পড়ে, সময়ও বাঁচে। কম্পানি বদলানোর চিন্তা আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে রেখেছে। গ্লোবাল পরিস্থিতি সুবিধের নয়, এসময়ে কাজ দেখিয়ে টিকে থাকা জরুরী। মা’র কাছে সমস্ত বলে দেওয়ার পরে মন একেবারে হালকা হর্ষর, সে এখন সিঙ্গল, সিঙ্গলই ছিল। মাঝে প্রায় অজানিতে অদিতি জুড়ে গিয়ে বদলে যাচ্ছিল চলার পথটা। তাকে হারিয়ে ফেলার কষ্টটুকু অজান্তে হঠাৎ ফিরে আসে, ছুঁয়ে যায় কখনো। তা ছাড়া নিজের আনন্দে সে দিব্য আছে। মা-বাবার সঙ্গে রোজই একবার সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা হয়।
ল্যাপটপে সিনেমা দেখল নেটফ্লিক্সের, চোখ জুড়ে আসছিল ঘুমে। শুয়ে পড়েছিল,
পাশে রাখা মোবাইলে মেসেজ ঢুকল,
“আর
ইউ অ্যাওয়েক?”
“হু
আর ইউ?”
“আমি
শাম্ভবী।”
“হাউ
ডিড্ ইউ গেট্ মাই মোবাইল নাম্বার?”
“দ্যাটস্
নট আ ডিফিকাল্ট জব। আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন? খুব আর্জেন্ট।”
“কী
ব্যাপারে?”
“কাল
আপনার অফিসে একবার যেতে পারি?”
চমকে উঠল হর্ষ, অফিসে কেন? এমনিতে ঊর্বীর ছেলেমানুষিতে মাথা প্রায়
খারাপ হওয়ার জোগাড়। হর্ষ লিখল,
“নো
নো, নট্ ইন্ অফিস।“
“ও-কে!
তাহলে বলুন কোথায়?”
“লেট্
ইউ নো টুমরো মর্নিং। ফর নাউ গুড নাইট।”
ফোন বন্ধ করে চোখ বুজল সে, আবার কোন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে কে জানে!
ঊর্বীর মুখটা ভেসে এল, দিনদুই আগেই জিজ্ঞেস করছিল,
“মে
আই আস্ক আ কোয়েশ্চেন? আর ইউ সিঙ্গল?”
জবাব দেয়নি, কোনওরকম অভিব্যক্তি না ফুটিয়ে বলেছিল,
“পুট্
ইন্ মোর এফোর্টস্ ইন্ দিস্ জব।”
এত রাতে ঘুমচোখে মুখটা মনে পড়ল, মিষ্টি গন্ধটা পেল। কী যেন একটা আছে
মেয়েটার মধ্যে, পাশে বসলে মনখারাপ সেরে যায়।
এয়ারপোর্ট থেকে শ্রুতির পি-জির অবস্থান অনেকটা দূর, অচেনা জায়গায় খুঁজে
পাওয়াও সহজ নয়। শ্রুতি লিখেছিল,
“ওয়েট করবেন, আমি পৌঁছে যাবো।”
অনন্ত অপেক্ষা যেন, মনে হচ্ছিল দেবার্ঘ্যর। শ্রুতি কোথায় আছে জানে না, অনিশ্চিতের আশঙ্কা কাজ করছিল মনের মধ্যে, যদি শেষ পর্যন্ত আসা বাতিল করে দেয়! শ্রুতি একবারের জন্য তাকে ডাকেনি, সে নিজে আগ্রহ করে—! ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অচেনা মুখগুলোর ওপরে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে ভেতরে আশ্চর্যবোধ হচ্ছিল, এমনও হয় তাহলে?
শ্রুতি আসছিল হন্তদন্ত হয়ে, চোখে পড়ল দেবার্ঘ্যর। বুকের মধ্যে ডানা
ঝাপটে উঠল কয়েকশো পাখি। শ্রুতি তার মুখের দিকে না তাকিয়ে ব্যস্তস্বরে বলল,
“আসুন
এদিকে, ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। লাগেজ কই?”
হাসিমুখে পিঠ ঘুরিয়ে ব্যাকপ্যাক দেখাল দেবার্ঘ্য, তারপর অনুসরণ করল
শ্রুতিকে। একটু বোধহয় রোগা হয়েছে, আরও টানটান, হাঁটাচলাতে ব্যক্তিত্ব। ক্যাবে বসল দু’জন,
ব্যাকপ্যাক জায়গা দখল করল মাঝখানটাতে। খুব চওড়া রাস্তা, সাঁইসাঁই ছুটছে গাড়ি, আলোকোজ্জ্বল
উন্নত শহর। বেশ ইতস্তত করে শ্রুতি জিজ্ঞেস করে,
“হঠাৎ
এতদূরে পাড়ি দিলেন যে?”
“এই
এমনিই—,”
লাজুকমুখে আসল কথাটা চেপে রাখল দেবার্ঘ্য।
“ও,
আচ্ছা। আপনার হোটেলের কাছাকাছি এসে পড়েছি প্রায়, একটু দূরই হল এয়ারপোর্ট থেকে।”
“ট্যারিফ?
পকেট কাটবে না তো? দামী শহর?”
“ওটা
আমার তরফে গিফট, বিরাট কিছু নয় অবশ্য। আমার সাধ্যমতো আমি বুক করে রেখেছি।”
“আরে!
এই সারপ্রাইজ রিয়েলি আনএক্সপেক্টেড ছিল। কেন এই খরচা করা হল?”
“অ্যাস্যুম
ইট্ -- আপনি আমার গেস্ট বলে করলাম, ফ্লাইট-ফেয়ার আপনার নিজের। আর, প্যাসিভ ভয়েস ছাড়াও
কথা বলা যায় আই থিঙ্ক!”
দেবার্ঘ্য হাসল, অভ্যাসবশতঃ মাথা-ঘাড় চুলকোতে লাগল।
হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল ক্যাব। ছোটো হোটেল, তবে পরিচ্ছন্ন।
শ্রুতি বলল,
“আমার
পি-জি এখান থেকে হাফ-এন্ আওয়ার। আপনি ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে রেস্ট নিন। আমি কাল আসবো
সকালে।”
ধীরে-ধীরে মাথা দোলাচ্ছিল দেবার্ঘ্য–ইচ্ছে
নেই, মন থেকে একটুও চাইছে না শ্রুতির চলে যাওয়া। শান্ত গলায় বলল,
“ডিনার
একসাথে সেরে তারপর ফিরে গেলে হয় না?”
ঘড়ি দেখল শ্রুতি,
“এগারোটার
আগে ঢোকা কম্পালসরি, একটু দেরী হয়ে যাবে আসলে।”
“এক্ষুণি
আসছি, দেরী হবে না। তুমি অর্ডার দিয়ে বোসো।”
‘তুমি’ শব্দটা কানে ঢুকল শ্রুতির, দেবার্ঘ্যর দিকে তাকিয়ে হাসল। দেবার্ঘ্য দেখে
উদ্ভ্রান্ত বিষণ্ণচোখের কলকাতার মেয়ে অনেক পালটেছে ক-মাসে। চশমার ফ্রেমের পেছনে আত্মবিশ্বাসী
চোখ ঘিরে নিখুঁত একজোড়া ভ্রূ।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন