‘থিওরি’ নয়, তাঁর ভাবনার বাহন ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত
‘পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে গান, গানের সঙ্গে ছবি আঁকা, সেলাই, মূর্তি
গড়া, হাতের কাজ-- সবকিছুর চর্চা না করলে সৌন্দর্যচেতনার সার্বিক বিকাশ হয় না’ —মনে
করতেন বিদ্যাসাগর কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অতুলচন্দ্র দাশগুপ্ত। বাবার উৎসাহেই মেয়ের
গান শিখতে আসা বেঙ্গল মিউজিক কলেজে। একবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবকে
সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেছিল কিশোরী মেয়েটি— ‘মোর পথিকেরে
বুঝি এনেছে’। পরের দিন ক্লাস পরিদর্শনে এসে মেয়েটিকে নিজে থেকেই ডেকে বললেন উস্তাদজি,
‘ভারি সুরেলা গলা তোমার। খুব সে রেওয়াজ কর বেটী।’ এত বড় গুণীর মুখে প্রশংসা শুনে মেয়েটি
তো ‘আহ্লাদে আটাত্তরখানা’। মনে হয়েছিল, আরও অনেক ভালো গাইতেই হবে তাকে, না হলে এত বড়
সাধকের কথা মিথ্যে হয়ে যাবে। সেদিনের সেই মেয়েটিই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে
এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব-- সুমিত্রা সেন,
সম্প্রতি যাঁর প্রয়াণ ভারাক্রান্ত করে তুলেছে বহু সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতার হৃদয়।
অন্য ধরনের গানেও তিনি শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন শিল্পীজীবনের শুরুতে, কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী এবং শিক্ষিকা হিসেবেই তাঁর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। সুমিত্রা সেনের (দাশগুপ্ত) প্রথম রেকর্ড বেরিয়েছিল দুটি নজরুলগীতির— ‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’ আর ‘বেদনার বেদীতলে’; এছাড়াও গেয়েছেন পল্লীগীতি, আধুনিক, ভজন ইত্যাদি ধারার কিছু গানও। গানের প্রথম পাঠ মায়ের কাছেই নেন সুমিত্রা। বেঙ্গল মিউজিক কলেজের ছাত্রী হিসেবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চাও করেছিলেন, কিন্তু মন টানত কাব্যসঙ্গীতের দুনিয়া, বাণীর ভাব, লাবণ্য। বৈতানিকে ভর্তি হয়ে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন, লোকসঙ্গীতের চর্চাও। তাঁকে আকাশবাণীতে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রদ্যোৎ নারায়ণই, এবং প্রথমবার অডিশনেই সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন সুমিত্রা। তবে বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর আত্মপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল বিয়ের পর, মূলত স্বামী অনিল সেনের সহমর্মিতায়, সাহচর্যে। আইন কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অনিলবাবুর সঙ্গে তাঁর বৈবাহিক বন্ধনে সহায়ক হয়েছিল গানের প্রতি ভালোবাসার সূত্রে মনের মিল। শিল্পীর নিজের কথায়— “উনিও রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত হওয়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ‘আমার গান’ বলে গ্রহণ করাটা আরও সহজ হল।” তেমনই চলছিল প্রদ্যোৎ নারায়ণ প্রমুখ শিক্ষকদের কাছে গীত, ঠুংরি, গজল। আর
সুমিত্রা সেনের প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডে ছিল দুটি
গান, ‘ওগো সাঁওতালি ছেলে’ আর ‘দিনের পরে দিন যে গেল’। এই ধরনের ললিতমধুর চলনের,
প্রেম বা প্রকৃতি পর্যায়ের মধ্যসপ্তক-আধারিত গানে তাঁর স্বকীয়তা, স্বাচ্ছন্দ্য ধরা পড়ত সহজেই। ‘মেঘছায়ে সজল বায়ে’, ‘আমার সকল দুখের
প্রদীপ’, ‘সে কোন পাগল’, ‘তুমি একলা ঘরে’র মত গান অনেক গুণী শিল্পীই গেয়েছেন, তবু
অনেক মরমি শ্রোতার মনেই এ জাতীয় গানের সঙ্গে যেন সুমিত্রা সেনের কণ্ঠ আর মধুর
ব্যক্তিত্ব একাত্ম হয়ে গেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রসস্নিগ্ধ অভিব্যক্তিই তাঁর শৈল্পিক
বিশিষ্টতার মূল কথা। সন্ধ্যা সেনকে
দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অকপটে জানিয়েছিলেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে কোনো বিশেষ থিওরি
প্রমাণ করতে না যাওয়াই ভালো। ... বিশেষ বিশেষ গানের সভা করে যদি বলতে যাই
রবীন্দ্রনাথ এই রবীন্দ্রনাথ সেই— তাহলে তাঁর রসমূল্য অনেকটাই যেন অপচিত হয়ে
যায়। রবীন্দ্রনাথ রসের সাগর— আমার কাছে এইটেই হল তাঁর সম্বন্ধে সবচেয়ে বড়
অনুভব।’ একদিকে ‘থিওরি’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বাঁধতে না চাওয়ার সহজ সরল ভাবনা, আবার অন্যদিকে তাঁরই পরিচালিত সংস্থা ‘ত্রিবেণী’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে
উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পাশাপাশি পরিবেশন করা হত রবীন্দ্রসঙ্গীত। দুই ধারার
মধ্যে মিলনসূত্র তুলে ধরাই যেন এ জাতীয় অনুষ্ঠানের ‘থিম’। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে
হেসে উত্তর দিতেন, ‘কিছু ওস্তাদি গানের সমঝদার আছেন যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীতকে কেমন
যেন একটা অবজ্ঞার চখে দেখেন। ‘ত্রিবেণী’র অনুষ্ঠানগুলি দিয়ে আমি এ কথাই বলতে
চেয়েছি যে রবীন্দ্রসঙ্গীত কনভেনশন বর্জিত উদ্ভট কোন বস্তু নয় অথবা শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের সঙ্গে এর দূরত্বের সম্পর্কও নয়।’ এ কিন্তু শিল্পীর স্ববিরোধিতা নয়, বরং
তাঁর বিচিত্রমুখী ভাবনার পরিচয়। ব্যক্তিগত ভাবে সহজিয়া ভাবনার অংশীদার হলেও,
রবীন্দ্রভারতীতে সঙ্গীতশিক্ষক হিসেবে, একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার পরিচালক হিসেবে
নতুন নতুন ভাবনার অনুসন্ধান করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে জনমানসে
নান্দনিক ভাবনার জায়গা তৈরি করে দেওয়া— এসবের ব্যবহারিক গুরুত্বকে
তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। হয়তো এর পিছনে কাজ করেছিল তাঁর সুপ্ত দার্শনিক মনন—
বাবার মত নিজেও পড়াশোনা করেছিলেন দর্শন নিয়ে, কিন্তু বিয়ের পর গান আর পড়াশোনা দুই
দিক সামলানো সম্ভব হবে না ভেবে শেষ পর্যন্ত এম এ পরীক্ষা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন
সুমিত্রা। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে বিভিন্ন ধারার রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক-একটি নান্দনিক বা দার্শনিক
বিষয়ভাবনার আলোয় তুলে ধরার এক অভিনব
প্রয়াস শুরু করেছিল তাঁর ‘ত্রিবেণী’। ‘মেঘের পরে মেঘ’, ‘দিন দিনান্তের গান’,
‘ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ’, ‘বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ’-এর মত গীতি-আলেখ্য বা
নৃত্যনাট্যের প্রযোজনায় সাফল্যের পাশাপাশি কখনো বিরূপ সমালোচনাও শুনতে হয়েছে তাঁকে।
তাতে ব্যথা পেলেও থেমে থাকেনি তাঁর নিয়ত সৃজনশীল মন।
ছায়াছবিতে সুমিত্রা সেনের প্রথম কণ্ঠদান স্বয়ং উত্তমকুমারের উদ্যোগে। শুটিং-এর অবসরে রেডিওতে গান শুনছিলেন মহানায়ক। কাছেই ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। রেডিওতে বেজে উঠল এক মহিলা শিল্পীর মায়াভরা কণ্ঠ। উত্তমকুমার জানতে চাইলেন, কে গাইছেন? গৌরীপ্রসন্ন রহস্যের ছলে উত্তর দিলেন, ‘আমারই এক বন্ধুর স্ত্রী।’ ঘটনাচক্রে অনিল সেন ছিলেন গৌরীপ্রসন্নবাবুর সহপাঠী। এই সূত্রে উত্তমকুমার নিজেই যোগাযোগ করলেন ফোনে, ‘শুন বরনারী’(১৯৬০) ছবিতে গান গাওয়ার অনুরোধ জানাতে। গানটি ছিল ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’। কালিংড়া রাগের মিষ্টি, সুরেলা চলনে যেন শিল্পীর কণ্ঠের মেদুরতা মিলেমিশে একাকার। এই গানটির বিপুল জনপ্রিয়তার পরও প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার দিকে তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহ দেখা যায়নি, তবু বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর গাওয়া ‘আগুনের পরশমণি’ (কাচের স্বর্গ), ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’ (একই অঙ্গে এত রূপ), ‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো’(গৃহদাহ), ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে’ (নবরাগ)-এর মত রবীন্দ্রসঙ্গীত। ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার প্রসঙ্গে তাঁর মতামত ছিল নিজের সুষম, জীবনমুখী ভাবধারারই প্রতিফলন— “আমাদের জীবনের আনন্দ ও বিষাদের মুহূর্ত তাঁর সুরে ভরে উঠলে ক্ষতি কী? ছবির গল্প তো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। আমি যতগুলি গান গেয়েছি তার প্রত্যেকটি ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে হৃদয়ে সাড়া দেবার প্রেরণাতেই গাওয়া।” জীবন ও সঙ্গীতের মধ্যে এমন সহজ অথচ গভীর, সুন্দর সামঞ্জস্য রেখে চলার ভাবনাতেই নিহিত ছিল শিল্পী হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র্যের চাবিকাঠি।
তথ্য সহায়তাঃ সুমিত্রা সেনের সাক্ষাৎকার (‘সুরের আগুন’, সন্ধ্যা সেন)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন