ধারাবাহিক উপন্যাস
রূটম্যান
(১২)
কোক-পেপসি সাঁতরায় গঙ্গার জলে - পদ্মা তারে ডেকে
নেয় আপনার কোলে
নির্মলচরের
যেখানে পদ্মা গোত্তা খেয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে গেছে তার পারে বসে একটা লোক ছোট ছোট
পাথরের কুচি ও হাঁড়ি ভাঙার টুকরো দিয়ে পদ্মার
জলে ব্যাঙ নাচাচ্ছিল! গ্রামের ছেলেরা এমন খেলায় বেশ আনন্দ পায়। ব্যাপারটা দেখতেও বেশ মজার।
জলের উপর দিয়ে সেই পাথর বা হাঁড়ি ভাঙার টুকরোটা
ব্যাঙের মতোই লাফিয়ে লাফিয়ে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে টুপ করে ডুবে যায়। গ্রামের লোকেরা একে ব্যাঙ নাচানো
বলে। এই খেলাটা এক ধরনের বিনা বাজির প্রতিযোগিতা
বলা যেতে পারে। অলস সময় কাটানোর খেলা। এমন
অনেক অদ্ভুত সব খেলা রয়েছে যা শুধু মাত্র গ্রামের ছেলেরাই খেলে। তবে সব গ্রামের খেলাই কিন্তু এক ধরনের নয়।
যে গ্রামে নদী নেই সেখানে
তারা পুকুরের জলে ব্যাঙ নাচায়। আবার
পাটিয়া পাটিয়া বলে একটি অদ্ভুত
খেলাও খেলে। হয়তো একই খেলা অন্য গ্রামে ভিন্ন নামে প্রচলিত হয়ে
থাকতে পারে। মূলত শীতকালে
গ্রামের ছেলেরা এই খেলা
খেলে থাকে। খেলার বৈশিষ্ট হচ্ছে চারটে ইট দিয়ে একটি বড় আয়তক্ষেত্র
করা হয়। এক সাথে দুটো দলে বিভক্ত হয়ে অনেকেই এই খেলা খেলে থাকে। বিরোধী
দলের একজনে সামনে থেকে একজনকে একটি রবারের বা টেনিস বল ছুঁড়বে। বাকিরা সারা মাঠে ছড়িয়ে ফিল্ডিং
দেবে। যাকে উদ্দেশ করে ছুঁড়বে সে হাতে একটি কাঠের
বা বাঁশের তৈরি ছোট ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে
থাকবে। ব্যাটটির বৈশিষ্ট হচ্ছে সেটি আঠারো ইঞ্চির বেশি সাধারণত বড় হয় না।
তবে একটু
ভারী হয়। গ্রামে অনেকের
বাড়িতেই এই ধরনের ব্যাট রয়েছে। বিশেষ করে যারা নিজের বা অন্যের জমির পাট থেকে পাটকাঠি এবং পাটকে আলাদা করার কাজ করে থাকে তারা এই ধরনের ব্যাট দিয়ে জলে
জাগ দেওয়া পাট পচে যাওয়ার পরে এই ব্যাট দিয়ে সেই পাটকে পিটিয়ে
পিটিয়ে তার থেকে পাটকাঠি এবং পাটকে আলাদা
করে থাকে। আর তাই হয়তো এই খেলার নাম হয়েছে পাটিয়া পাটিয়া। আধুনিক যুগের অনেকটা
‘বেসবল’ খেলার মতো । বলটিকে ব্যাটের
সাহায্যে দূরে পাঠিয়ে
আয়তক্ষেত্রটি একবার ঘুরে এলেই সম্পূর্ণ
হয় একটি রান। এই খেলায় যেমন ক্যাচ আউট রয়েছে তেমনি বলটি ধরে বিরোধী
দলের কেউ যদি দৌড়ে এসে বা
কারোর সাহায্যে স্টার্টিং পয়েন্টের
ইটে লাগাতে পারে তাহলেও সেই খেলোয়ার আউট হয়ে
যায় । পদ্মার পারে বসে লোকটি এমনই সব গল্প করছিল।
বিকেলের
পড়ন্ত রোদে পদ্মার জলের মাথায় লালচে আভা পড়েছে। পদ্মার বিস্তৃত বক্ষে সূর্যোদয় এবং
সূর্যাস্ত দেখলে মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। জলে ভেসে চলা ছোট বড় নৌকাগুলো তখন একে
একে নিজের নিজের ঠিকানায় ফিরতে শুরু করে। জেলেরা সারাদিনের ক্লান্তির অবসাদে তাদের
বিশাল জাল থেকে একে একে মাছ ছাড়িয়ে নৌকার পেটে জমা করতে থাকে। আর মাঝে মাঝেই পড়ন্ত
রোদটা ওদের শরীরকে শীতল করে দেয়। এভাবেই সব নৌকাই ঘরে ফেরে। নদী শুধু পড়ে থাকে নিজের
মতন। তখন আর তার
কোন
দায় নেই। কারোর জন্যই তার আর দুশ্চিন্তা নেই।
লোকটি
এইটুকু বলে মুচকি হাসে। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এমন হাসির কারণ জানতে চাইলে বলে-
আচ্ছা এবার বলুন তো সত্যিই কি গঙ্গা-পদ্মার কোন দায় নেই! সন্তান একটু বড় হয়ে গেলে মা-বাবা
কি বলতে পারে যে এবার তোমারটা তুমি বুঝে নাও। ডুবলে ডোব-ভাসলে ভাসো! এ এক জটিল অঙ্ক!
তবে চোখের সামনে সন্তানের কষ্টে বা তার বিপদে আবার সেই বাবা-মাই এগিয়ে এসে তাদের হাত
বাড়িয়ে দেয়। সে অনেক সময় কু-সন্তান হলেও অপত্য স্নেহ তাদের সন্তানের কাছে নিয়ে আসে।
বহুদিনের পুঞ্জিভূত রাগ-অভিমান তখন গলে জল হয়ে যায়। কাজেই নদীর ভাগ্যে আর বিশ্রাম জোটে
না। সামান্য একটু চোখ বন্ধ হতে না হতেই গয়নার বিশাল নৌকা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় লোক
নিয়ে বয়ে যায়। আর তা দেখার দায়িত্ব তো নদী অস্বীকার করতে পারে!
আমি
কখনও লোকটির মুখের দিকে আবার কখনও নদীর দিকে তাকিয়ে বলি-আপনি কীভাবে নদীর মনের কথা
পড়তে পারেন! ও কি আপনার সাথে কথা বলে নাকি?
লোকটি
নিঃশব্দে হাসে। ঠোঁটের কোণায় এক টুকরো হাসি ঝুলিয়ে রেখে সে একই ভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে
থাকে। আমার মনে হয় সে বুঝি নদীর গভীরে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে! সে একই ভাবে আত্মলীন
হয়ে নদীর গভীরে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলে- সব কথা কি আর ধ্বনি নির্ভর হয়! অনেক কথা
শোনার জন্য বিশেষ কানের প্রয়োজন। অথবা বলতে পারেন তেমন প্রয়োজনও হয় না। মুখের দিকে
তাকালেই বোঝা যায়। তবে সবাই তা পারে বলে আমার মনে হয় না। আর আমি পারি বলেই আমার মনে
হয় নদীরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। তারও একটু সেবা-যত্নের প্রয়োজন। তার শরীরের গভীর
থেকে মাঝে মাঝে ক্লেদগুলোকে বাইরে এনে ফেলে দেওয়া উচিত। তবে দেখতে হবে সেই জমে থাকা
ক্লেদকে নির্ভর করে যে সকল জলজ প্রাণীরা বেঁচে রয়েছে তাদের যেন কোনরূপ ক্ষতি না হয়।
কিছুক্ষণ
লোকটি চুপ করে থাকে। তখন নদীর নিজস্ব ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। লোকটি
তার হাতের পাথর কুচিগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে আবার বলে- হয়তো আপনি ভাবছেন আমার মাথার ব্যামো
আছে। আসলে তা নয়। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকেই এই নদীকে নিয়েই বড় হয়েছি। তখন বাবার হাত ধরে
আসতাম। আমাকে একা আসতে দিত না। অবশ্য এই গ্রামের কাউকেই বাড়ি থেকে একা ছাড়ে না। সাথে
বড়রা থাকে। নদীর খিদে পেলেই সে যে কাউকেই টেনে নেয়। ওর কাছে কোন জাত বিচার নেই। দয়া
মায়া নেই! একটা মানুষ হলেই হল। পেটের কোথায় যে রাখে তা কেউ খুঁজেও পায় না!
-নদী
খায়, নাকি কুমিরে টেনে নেয় নিজেদের বাসায়? আমি জানতে চাই।
-আমি
কেন, আজ পর্যন্ত কেউই নদীতে কুমির দেখেনি। কোন কোন জায়গায় যথেষ্ট ঘূর্ণি থাকে।
মাঝিরা
পর্যন্ত তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বর্ষায় তো গঙ্গা-পদ্মা দু’জনে মিলে একটাই
শরীর হয়ে যায়। সাধারণ চোখে সীমানা বোঝা মুশকিল। আমরা বুঝি। আর বোঝে বিএসএফের জল পাহারার
জওয়ানরা। একটু বেচাল দেখলেই ওরা খপ করে টেনে নিয়ে জেলে ভরে দেয়।
লোকটি
সামান্য থামতেই আমি জানতে চাই- তাহলে এই চরের কী হয়?
-কী
আবার হবে! সেও ডোবে আবার ভাসে। আমরা যেমন ভাঙনে বাড়ি, জমি হারাই। চরও তেমনি বর্ষায় অনেকটাই ডুবে যায়।
কখনও বা পুরোটাই। আবার ধীরে ধীরে ওর পিঠ উঁচু হতে থাকে! সবটাই নিজের হাতের তালুর মতোই
চিনি। কোন ঘাটে জল কম আর কোন ঘাটে অথৈ তা আমাদের জানা আছে। এখন আর সব সময় নদীর কাছে
আসা হয় না। আজ একটু সময় পেয়েছি বলেই ওকে দেখতে এলাম। দেখুন না এই চরটা কতটা বেড়ে গেছে।
তবে গ্রামের অবলারা এখন সামান্য সাঁতরে ঘাসের লোভে এই চরে উঠে পড়ে। সারাটা দিন চরটাকে
একেবারে নেড়া করে ছাড়ে। তার পর কেউ কেউ তাদের ঘরে ফিরে যায়। আবার অনেকেই ফেরে না। এবার
লোকটি সামান্য হাসে।
-ঠিক
বুঝলাম না। যে সব অবলারা ফেরে না তাদের মালিকেরা রাতে চিন্তা করে না? আমি বলি।
লোকটি
এবার একটু জোরে হেসে বলে- ছোট বেলায় পড়েছেন না যে কর্তার ইচ্ছেতেই কর্ম হয়। এখানেও
ঠিক তাই। এতো আর বাড়ির বেড়াল নয় যে দূরে রেখে এলেও সে ঠিক নিজের বাড়িতে চলে আসবে। কারণ
এই সব অবলাদের না আছে ঘরের ঠিক আবার না আছে মালিকের ঠিক। আবার এদের কিন্তু বেওয়ারিশ
ভাববেন না। তবে এদের এতবার হাত বদল হয় যে ওরা নিজের মালিককে ভালো করে চেনার কোন সুযোগ
পায় না। চিনতে চিনতে আবার হাত বদল হয়ে যায়। আর ক্রমশই এরা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে
থাকে! অবশ্য এইসব অবলাদের জন্মটাই হচ্ছে নিজেদের বিলিয়ে দেবার জন্য! কখনও নিজেদের দুধ
দিয়ে আবার কখনও মৃত্যু বরণ করে! আগে এসব ভাবতাম না। ইদানীং ভাবলে অবাক হই।
-কেন
আগে ভাবতেন না! ভাবতে অসুবিধা কোথায় ছিল? আমি জানতে চাইলাম।
-ভাববার
কোন অবকাশই ছিল না। এই অবলারাই আমাদের সংসারটাকে প্রতিপালন করত বলতে পারেন। লোকটি একটু
থামল। হয়তো স্মৃতির দরজা খুলে কিছু খুঁজল।
তার পর আবার বলল- ঠিক বুঝলেন না তো। অবশ্য না বোঝারই কথা। আসলে এই অবলারাই আমাদের
সংসার চালাত। ভাববেন না যে আমরা গোয়ালা ছিলাম আর দুধের ব্যবসা করতাম। আমার বাবা ছিলেন
রুটম্যান বা লাইনম্যানও বলতে পারেন। বাবার খবরের উপরেই ব্যবসার ভালো মন্দ নির্ভর করত।
সামান্য ভুলচুক হলে লক্ষ লক্ষ টাকা ক্ষতি হয়ে যেত। কাজটা যতটা না কঠিন,তার থেকেও বেশি
গুরুত্বপূর্ণ ছিল খবরের সঠিকতা। তবে এক একটি খবরের উপরে প্রচুর টাকা পাওয়া যেত। বাবা
যে শুধু রুটম্যানের কাজই করত তা নয়। সেই সাথে অবলাদের সীমান্তের নিকটবর্তী কোন গ্রামে
গিয়ে কারোর গোয়ালে এক রাতের জন্য রেখে দেওয়া বা তেমন হলে একেবারে সীমান্ত পার করেও
দিতে হত। আমাদের তখন এতই টাকা যে বাবা অনেকেরই জমি কিনে নিত। বাড়িতে খাওয়া দাওয়া ভালো
হত। এতে সাধারণত যা হবার তাই হত। গ্রামের লোকেরা শহরের লোকের মতো নয়। তারা হুটহাট একে
অপরের বাড়িতে চলে যায়। কারোর হাঁড়ির খবর নেওয়া তাদের পক্ষে কষ্টকর নয়। ফলে তারা রীতিমত
হিংসা করতে শুরু করল। হঠাৎ করে আমাদের অবস্থার উন্নতি তাদের মনে সন্দেহের কারণ ঘটালো।
আর সেটাই হল আমাদের পতনের মূল কারণ। বাবার পিছনে শত্রু লেগে গেল। বাবাকে মেরে ফেলা
হল। লোকটি ফৎ করে এমনভাবে নিঃশ্বাস ফেলল যেন আমার মনে হল এই দীর্ঘশ্বাসটা হয়তো বহুদিন
ধরেই বুকের মধ্যে না বেরোতে পারার যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। আজ তার মুক্তি ঘটলো। আমি নদীর
দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
এসব
ঘটনার বর্ণনা চলা কালীন হঠাৎ করে বক্তা থেমে গেলে শ্রোতার তখন আর কিছুই করার থাকে না। তাকে বেশ কিছুটা সময় দিতে হয়
নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। এটাই সৌজন্য। তাই আমিও গঙ্গার ছোট-বড় ঢেউগুলো দেখছিলাম।
আর চেষ্টা করছিলাম গঙ্গার গভীরে দৃষ্টিপাত করার। অথচ আমার দ্বারা তা কিছুতেই হচ্ছিল
না। জানতাম তা হবারও নয়। কারণ আমি এই প্রথম কোন নদীর পারে বসে এতটা সময় ধরে একজন গ্রামবাসীর
মনের কথা শুনছি। হয়তো এটা শুধু তার একারই গল্প নয়। হয়তো সমস্ত সীমান্তবর্তী গ্রামবাসীদের
মনের কথাই লুকিয়ে আছে তার গল্পে।
কথকঠাকুর
আবার বলল-জানেন, আমি বাবার ভাঙাচোরা মুখটাকে চেষ্টা করেও জোড়া লাগাতে পারি না। আমার
কথা শুনে হয়তো আপনার আশ্চর্য লাগছে। কিন্তু এটাই বাস্তব।
-এ
আবার কেমন কথা! বাবার মুখ কি আপনি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন? আমি জানতে চাই।
-আপনার
অবাক হবারই কথা। আসলে বাবার শেষ মুখটা শুধু আমি কেন আমার বাড়ির কেউই আর দেখতে পায়নি।
এই গঙ্গাই তাকে কোলে টেনে নিয়েছিল। লোকটি তার মাথা নীচু করে।
-বলতে
অসুবিধা হলে নাই বা বললেন। আর যদি মনে করেন যে নিজেকে একটু হাল্কা করবেন তাহলে বলুন
আমি শুনব। আমার অন্য আর এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। তবু আমি ঠিক করলাম আজ না হয় নাই বা গেলাম।
বরং অন্যদিন যাব।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন