শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

পায়েল চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


রত্নাদি

 

নিভু নিভু রোদের মতো মুখ করে বসে আছে রত্নাদি। শীতের বিষণ্ণতা উলের  চাদরের মত ওর গায়ে লেগে। এই সময় কথা বলা যায় না। স্টেশনে নেমে রেডিওতে যা শুনলাম ওকে বলাটাও জরুরী।

-"রত্নাদি! কোন খবর পেলি?

আমার কথায় রত্নাদির মুখখানা শিবমন্দিরের পাশের পুকুরের মতো হয়ে গেল। সব পানা এসে জড়ো হয়েছে। রোজ বলাইদার নামে ওখানেই পুজো দিতে যায় রত্নাদি। এই শরীর নিয়েও। বলাইদার জন্য একটা উলের চাদর বুনছে রত্নাদি। 'ব' আঁকা। ওকে কথাগুলো কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।

আমি আবার প্রশ্ন করলাম।

-"বলাইদার ফোন পেলি?

উল-কাঁটার ঘস-ঘস শব্দ বন্ধ হল। আমার দিকে ফিরে পাথরের মত তাকিয়ে রত্নাদি বলল-

-" কুনো খবর নেই। ওখানে নিশ্চয়ই এতদিনে আরেকটা বিয়ে করেছে। ও ফিরে আসা পর্যন্ত আমি আর বাঁচবুনি। তুই এই চাদরটা ওকে দিস। আমার বোনা প্রায় শেষ।"

রত্নাদির কথায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। সত্যিটা বলিনি।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এই গ্রাম। শহরে কাজ করে বনগাঁ লোকালে করে যখন নামি, ইরাকে যুদ্ধের কথা শুনতে পাই। বলাইদা ইরাকে কাজ করে। যুদ্ধে মানুষ মরছে।

স্টেশনের পাশের চায়ের দোকানটাতে রেডিও চলে। ট্রেন থেকে নামার সময় আমি খবর পড়া শুনতে পাই। সঙ্গে গুলির আওয়াজ। রত্নাদির মুখটা ভেসে ওঠে। কাঁটাতার পেরিয়ে যুদ্ধের খবর ভেসে আসে বাংলাদেশ থেকেও। ও দেশের লোকেরাও ইরাকে কাজ করতে যায়।

রত্নাদির মুখটা আলো-আঁধারিতে ডুবে থাকে। ওর বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি। ছোট থেকেই দেখেছি ওকে। উলকাঁটা দিয়ে ভালোবাসা এঁকে দেয় ও। আমায়ও একটা গোলাপী সোয়েটার বুনে দিয়েছিল।

ওর আর বলাইদার বিয়ের এক বছরের মাথায় বলাইদা ইরাকে কাজ করতে গেল। ‌ রত্নাদি তখন সন্তানসম্ভবা। উলের চাদর বুনছে বরের জন্য।

প্রথম প্রথম বলাইদা নাকি খুব ফোন করতো।

বলাইদার খবর না পেয়ে কয়েক মাসেই রত্নাদি ঝরাপাতার মত হয়ে গেছে। তবুও ওর বাড়ি থেকে উলকাঁটার শব্দ ভেসে আসে।

-"জানিস আমার পেটেরটা উল-কাঁটার শব্দ না শুনলে সারাক্ষণ নড়াচাড়া করে। ওর বাপের জন্য চাদর বোনার শব্দ শুনলে তবে ঘুমোয়।"

ওর কথা শুনে আমি মুখ ফিরিয়ে নিই। রেডিওতে ইরাকের যুদ্ধের খবর শোনা যায়। ভাগ্যিস রত্নাদির কাছে রেডিও নেই!

হাসপাতালে যাওয়ার আগেই জল ভাঙা শুরু হয়েছিল রত্নাদির। আমায় কানে কানে বলল, "ওই দেশে নাকি মেশিনে বোনা সুন্দর উলের বেলাউজ পাওয়া যায়,  ও আনবে বলেছিল।"

যুদ্ধের খবর তখনো আসছে।

রত্নাদির এক মাসি ছাড়া আর কেউ নেই। রত্নাদির মৃতদেহের উপর পড়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর সদ্যোজাত বাচ্চাটাকে মাসি আমার হাতে তুলে দিয়েছিল।

বলাইদা এসেছিল। তখন ওর মেয়ের বয়স দুমাস। রত্নাদির কথা শুনে ওর চোখে ঝড় দেখেছিলাম। রত্নাদির বোনা সেই উলের চাদরটা যখন ওর হাতে তুলে দিতে গেলাম, শীতের দখিনা হাওয়ায় বলাইদার গায়ের শালটা খুলে গেল। একটা পোড়া অন্ধকার নেমে এলো। বলাইদার ডান হাতটা নেই, বাঁ হাতের অর্ধেকটা কাটা। বগলে একটা প্যাকেট। সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা উলের ব্লাউজ।

ছোট্ট দুমাসের মেয়েটাকে মায়ের বোনা চাদরে মুড়ে বাবার কোলে শুইয়ে দিলাম। আমি যখন পাশের ঘরে জল আনতে গেছি, মেয়ে আর বাপের কান্নার শব্দ আমাদের বনগাঁ সীমান্তের কাঁটাতার পার করে আকাশে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে।

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন