বর্ণমালার সাতকাহন
পর্ব ২
লুকোচুরি খেলার মেঘবালিকা
ক্লিশে
হয়ে যাওয়া গতানুগতিক ছেলেবেলা বড়বেলায় এসে হয়ে যায় সময়ের দলিল। জীবনযাত্রা পাল্টে যায়,
পরিবার সমাজ এমনকি দেশ পাল্টে পাল্টে যায়। ফিরে তাকালে আরেকটা অন্য দুর্গাপুজো।
আবার
শরৎশশী। অনেক মানুষ আর অনেক স্মৃতি ভিড় করে মনে।
ভেবেছি
যা ভুলে গেছি দেখি ফুঁ দিলেই ধুলো সরিয়ে টাটকা।
দুর্গাপুজো
এলেই মন খারাপ হয়। একটা অযৌক্তিক মন খারাপ। ট্রেনটা হুশ করে বেরিয়ে গেছে স্টেশন ছেড়ে
আর আমি এক্কেবারে একা লটবহর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে।
দুর্গাপুজো
এলেই মনে পড়ে ছোটোবেলা। আর ছেলেবেলা মানেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠা।
সারাবছর
ভোরবেলা উঠতেই হতো মায়ের নির্দেশে। কিন্তু পুজোর সময় সেই ঘুম ভাঙাটা ছিল আনন্দের।
আমাদের
বাগানে একটা বিরাট বড়ো শিউলি গাছ ছিলো। সেই শিউলি গাছের তলাটা ফুলে ফুলে একদম সাদা
হয়ে যেত। আমার কাজ ছিলো মার কিনে দেওয়া ছোট্ট বেতের রং বেরঙের সাজি ভরে ফুল, আর দূর্বাঘাস
তুলে মাকে পুজোর ঘরে দিয়ে আসা।
সেসময়
বেশ হাল্কা ঠাণ্ডা পড়ে যেত। আর ঘাসের ওপর, ফুলের ওপর হাল্কা সরের মতো হিম পড়ে থাকত।
ফুল
তোলা খুব আনন্দের ব্যাপার ছিলো। বাবা বাগানে জল দিতেন। আমাদের ছোটোবেলায় মোটামুটি আকাশে
ঘুড়ি মানেই বই পত্তর ভোকাট্টা অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজো।
আমাদের
বনেদি বাড়ির বিরাট ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো, হতো ঘুড়ির লড়াই।
ডিসেম্বর
মাসে ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা ছিলো যদিও।
আমাদের
সময় ছিল ‘দুর্গাপুজো’। সেসময় থিমপুজোর ততটা প্রচলন ছিলো না। এত রকমের স্থাপত্য ও শিল্পীর
সৃজন ছিলো না। আমাদের দুগ্গাঠাকুর মানে ডাকের সাজে মা দুর্গা বা ইয়া বড়ো বড়ো চোখওলা
মা দুর্গা যার সিংহ ছিলো একদম আসল সিংহের মতোই। একডালিয়া এভারগ্রিনের ঠাকুর সেই প্রথা
এখনো বজায় রেখেছে। আমার কিন্তু কোনোদিনই ছোটোবেলায় অসুরকে দেখে খারাপ লোক মনে হয়নি,
কী জানি কেন মনে হতো মা দুর্গার দিকে কেমন
অবাক বিস্ময়ে সে তাকিয়ে আছে যেন মা যে ছেলেকে মারতে পারেন তা ভাবতে পারেনি অসুর।
আমাদের প্যাণ্ডেলে কোনো বছরেরই খুব একটা নতুনত্ব থাকতো না।
মান্না
দে, লতা, আশা বা আরতি মুখোপাধ্যায়ের গান চলত, কিম্বা রফির ‘পাখিটার বুকে যেন তীর মেরো
না ওকে গাইতে দাও’, সর্বমোট দশ বারোটা গান এবং প্রতিবছর সেগুলো বাজতো। আমরা সারাদিন
বন্দুক ফাটাতাম, মাঠে ঘাটে খেলা করে বেড়াতাম কারণ একমাত্র এই সময়ই ‘সময়’ নিয়ে কড়াকড়ি
ছিলো না।
মা’র
নতুন শাড়ির গন্ধ বড় সিঁদুরের টিপ বিকেলে পাড়ার কাকিমা জেঠিমাদের সঙ্গে দেখতাম মার ঝলমলে
হাসিমুখ।
বিজয়ার
দিনটা সব দিক থেকে এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে।
সেদিন
সকাল থেকেই থাকত অধীর আগ্রহ। মার বরণ করা শেষ হলে ইচ্ছে মতো সিংহর কেশরে হাত দিয়ে,
পেঁচা ,ইঁদুর হাঁস সবাইকে ছুঁয়ে নিতাম নির্ভয়ে। মা দুগ্গার দুটো পায়ের পাতা খুঁজে বার
করা একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিল। জড়ির শাড়ি ফুল বেলপাতা সব কিছুর মধ্যে একটা পা সিংহর
পিঠে তো আরেকটা পা যে কোথায় সে এক বিস্ময় ছিলো, কিভাবে এমন ব্যালান্স করে দাঁড়িয়ে আছেন
তিনি! একবার এমন দিনে যেই নমস্কার করেছি আমার হাতে মা দুর্গার টিনের শঙ্খটা টুক করে হাতে খসে পড়ল। দারুন
আনন্দ হয়েছিল। কাউকে বলিনি। বাড়ি ফিরে মাকে দেখিয়েছিলাম। অনেক বছর আমার কাছে ছিল। তারপর
যা হয়...
বিজয়া
দশমীর আসল মজাটাই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলা বিজয়া করতে যাওয়া। সপরিবারে এবং
সব বাড়ি যাওয়া পাড়ায়। একটা সাসপেন্স ছিল এই নিয়ে। কোন বাড়ি কী খেতে দেবে। কেউ লুচি
বেগুনভাজা তো কোথাও বাড়িতে তৈরি নানারকম নিমকি, নাড়ু, মালপোয়া। কোনো একটি বাড়িতে ঘুঘনি
আর মিষ্টি তো কম্পালসরি সেদিন। রাতে বাড়িতে আর খাওয়ার প্রশ্নই নেই।
আমি
একান্নবর্তি পরিবারের মেয়ে ফলে এই বিজয়া দশমী একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছিলো। আমাদের এন্টালির
বাড়িতে তিনজন ঠাকুমা, জ্যাঠারা, কাকারা সকলেই ছিলেন।
বাস
থেকে নেমেই মা মাথায় ঘোমটা টেনে নিতেন কারণ নন্দর মিষ্টির দোকানেও মা নতুন বৌমাই ছিলেন
চিরটাকাল। কাকা কাকিমারা আসতেন আবার। বাড়িতে মহাসমারোহ হতো। দিদিমার বাড়িও একান্নবর্তি
পরিবারে বালিগঞ্জে। অনেক দিদা অনেক দাদু। সেদিন আর ফেরা হতো না।
নতুন
প্রজন্ম এই ব্যাপক বিজয়া দশমীর কথা জানে না। বড়োজোর মামার বাড়ি আর পিসির বাড়ি। কিন্তু
এমন সারা পাড়া ঘুরে বিজয়া দশমীর প্রথা অন্তত কলকাতা ও নিকটস্থ পাড়াগুলোয় আর দেখা যায়
না।
লক্ষ্মীপুজো
অবধি চলত এই এ বাড়ি ওবাড়ি অভিযান। আমরা ঘটি তাই আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো ছিলো না।
সুতরাং সেদিনটাও কোনো না কোনো বাড়িতে নেমন্তন্ন
থাকত আর বাড়িতে আসতো প্রচুর পরিমাণে নানাবিধ প্রসাদ।
খুব
ছোটোবেলায় সপ্তমীর সকালে ঘুম ভেঙে মাথার কাছে পেতাম মা দুর্গার উপহার। মা-বাবাই কিনে
দিতেন তা বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। কিছু মিথ্যা বড়ো নরম আর সুন্দর। তখন আমার চার পাঁচ
বছর বয়স।
পাড়ায়
মেয়ে কম ছেলে বেশি আর তারাই আমার বন্ধু , ডানপিটে ছিলাম ছোটো থেকেই। গাছ থেকে পাখির
বাসা পেড়ে আনা থেকে ছাগল ছানা ধরে এনে জামা পরিয়ে ঘরে ছেড়ে দেওয়া, পেয়ারা গাছে ওঠা,
সাপ নিয়ে খেলা এসবই দশ বারো বছরের জীবন মেতে রইল। সারা গণ্ডগ্রাম সেই গোড়ে সেই সময়
আমার বিচরণভূমি। কারো মাটির দাওয়া, মাঠ, ঝোপঝাড়ে পথে আলপথ ঘুরে লুকোচুরি খেলা হতো।
তবে শাঁখের আওয়াজ বলেই ঘরের ফেরার নির্দেশ ছিল অলংঘ্য।
সেই
সময় ‘ব্যানার্জি চ্যাটার্জি ঘোষ বোস বাগচি’ নামক কোনো শ্রেণী সচেতন বিজ্ঞাপন সৃষ্টি
হতো না।
(ক্রমশ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন