শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আফসানা কিশোয়ার

 

মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মৃত্যুর গান – সমান্তরাল




১৯৯২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত জানা ২৩৯-জন মানুষ ইসলামী জিহাদীদের হাতে  বাংলাদেশে খুন হয়েছে, এর মধ্যে ৩৩-জনের হত্যার দায় ইসলামী জিহাদী  গ্রুপগুলো স্বীকার করেনি। প্রথম দিকে এ হত্যা ছিল রাজনীতি ঘেঁষা হত্যাকান্ড। পরবর্তীতে যারাই ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করেছে তারাই মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২০১৩ থেকে শুরু হয় ধর্ম না মানা ব্লগারদের হত্যা। ধর্মকে পুঁজি করে এই যে মানুষ হত্যা, এ কি হাল আমলের ট্রেন্ড? না তো! আর সে ইতিহাসই যেন আমরা উপন্যাসের আঙ্গিকে পড়তে শুরু করি লেখক অদিতি ফাল্গুনী'র ‘ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে’ বইটিতে।

বইয়ের শুরু সক্রেটিসের মৃত্যুর আবহ দিয়ে - তিনি কীভাবে নিঃশঙ্ক চিত্তে তাঁকে দেয়া বিষ পান করেন, সেই ঘটনার বর্ণনা আমরা পড়ি। সক্রেটিস হেমলক পান করার পর শিষ্যদের বলেন – “আমি চিরদিনই শুনে এসেছি যে একজন পুরুষ  মানুষের অন্তিম পরিণতিও এমনভাবে মেনে নেয়া উচিত, যা পরিমিত ভাষেরই আহবান জানায়, কাজেই তোমাদের অবশ্যই ধৈর্য থাকতে হবে এবং তোমরা অবশ্যই সহ্য করবে”।

জ্ঞানের লড়াইয়ে এ বিষ পান সক্রেটিসের থেমে থাকেনি - বিংশ শতাব্দীতে জ্ঞান প্রচারের লড়াইয়ে তাই আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এক অলৌকিক এম্বুলেন্স,  সেখানে আমরা আকবর আসাদের মোড়কে পাই ২০০৪-এ অধ্যাপক হুমায়ূন  আজাদ হত্যাচেষ্টার এক পোস্ট মডার্ন বর্ণনা। দুই হাজার চার-এ শুরু হওয়া  একই স্টাইল সেই বইমেলায় আড্ডা তরুণদের সাথে, সন্ধ্যা ও রাতের মাঝামাঝি সময়ে ভার্সিটি এরিয়ার আলো আঁধারে ঘাড় মাথা বরাবর চাপাতির কোপ। জীবন্মৃত হুমায়ূন আজাদ শেষ পর্যন্ত বিদেশে মারা যান, তাঁর মরদেহ আসে এম্বুলেন্সে করে। লেখক আমাদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, 'পাক সার জমিন সাদ  বাদ' বইটির জন্যই কি হুমায়ূন আজাদের হত্যাকান্ড?

স্মৃতির রেললাইনে এসে দাঁড়ান চৈতন্য - তিনি সংকীর্তন করেন, তাঁর সাথে ডোম, দরজি, পাঠান পীর, বামুন সবাই যোগ দিচ্ছে। রাজা প্রতাপরুদ্র পর্যন্ত তাঁর  সমর্থক হয়ে উঠেন। মহামন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর ভীষণ রুষ্ট হয়ে উঠেন এসব দেখে। এবং কাজে কাজেই পুরীর জগন্নাথ ধাম থেকে একদিন হারিয়ে গেলেন মহাপ্রভু। অথচ মহাপ্রভু ভূ-খন্ডে বিরাজমান অসহনীয় জাতপাতের তাপ থেকে সবাইকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন প্রেমের পরশে। মহাপ্রভুর অন্তর্ধান নিয়ে পদকর্তা লোচন দাস লিখেছেন-

“তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।

জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে”।

আবার অচ্যূতানন্দ শূন্য সংহিতায় লিখেছেন-

'কলারে কলা মিশিলা নোহিন্দ

সে বারি”।

অর্থাৎ জগন্নাথের কালো অঙ্গে শ্রীচৈতন্য মিশে গেলেন এবং তাঁর চিহ্নও আর  কোথাও থাকলো না। মহাপ্রভুর তিরোধানের পর পঞ্চাশ বছর বাংলা ও ঊড়িষ্যায় কোন কীর্তন হয়নি। আমরা অধ্যাপক মহতাবের বয়ানে শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের ৪৪৪ বছর পর জানি কীভাবে তাঁর দেহ মন্দিরেই সমাধিস্থ করা হয়েছে। তার  মানে কি ইতিহাসের ভেতর বসে ইতিহাস লেখা যায় না? সেজন্যই ব্লগার হত্যার কোন স্পেসিফিক, লজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস ভিত্তিক পূর্বাপর গবেষণা আমরা ২০১৩ থেকে আজ পর্যন্ত পড়ার জন্য পাই না!

ব্লগারদের উপর আক্রমণের আগে হরকাতুল-জিহাদ-আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি) ১৯৯৯-২০০৫ পর্যন্ত ৯৩-জনকে খুন করে, জামায়াত-উল-মুজাহেদিন  বাংলাদেশ (জেএমবি) ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত ৯০-জনকে খুন করে।

২০১৩ তে আমরা পাই আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও নিও জেএমবি। তাদের যাত্রা শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে যখন বাংলাদেশ অনলাইন এক্টিভিস্টদের ব্যানারে শাহবাগে কাদের মোল্লার ফাঁসী চেয়ে আন্দোলন শুরু হয়,  তখন। সজল হায়দায় বা রাজীব হায়দার বা থাবা বাবাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই মহোৎসব। ১৫ফেব্রুয়ারি রাজীব হায়দারকে মারা হয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এ হত্যার দায় স্বীকার করে। একই কায়দায় ২০১৩ এর জানুয়ারিতে আসিফ মহিউদ্দিনকে আক্রমণ করলেও সে কোনভাবে বেঁচে যায়। রাজীব হায়দার মারা যাওয়ার পর তৈরী হয় ফেইক একাউন্ট, ফেসবুকে তার মরদেহ পোস্ট করে জানানো হয় সে ইসলামের শত্রু, তার বিশেষ বিশেষ পোস্ট মাহমুদুর রহমানের 'আমার দেশ' পত্রিকা, জামায়াতের মিডিয়া উইং বাঁশের কেল্লা অনবরত ছাপাতে থাকে, পোস্ট দিতে থাকে অনলাইনে। মাহমুদুর রহমান, ফরহাদ মাজহার গং-দের অব্যাহত প্রচারণার মুখে দেশবাসী বিশ্বাস করতে শুরু  করে ব্লগার মানেই নাস্তিক, তারা ইসলামের শত্রু এবং তাদের চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ, পবিত্র দায়িত্ব। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রাজীবের হত্যার পর গিয়ে দাঁড়ান, তাই হয়তো রাজীব হত্যাকারীদের মধ্যে ৫জন গ্রেফতার হয় ২০১৩ এর ২রা মার্চ, ২০১৬ তে ফয়সাল নাঈম ও রেদওয়ান রানাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত ফাঁসীর শাস্তি দেন।

ভীমরাও অচ্ছুৎ বর্ণের মানুষ হয়েও পড়ালেখা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, তাঁর বয়ানে আমরা শুনি 'বাপুজি (মহাত্মা গান্ধী) ঈশ্বরাল্লার কথা বললেন অথচ সারা জীবন বর্ণাশ্রমও করে গেছেন। অদ্ভূত!'

অজেয় বা সুজেয় চৌধুরীর ছেলে শুভ্রজিৎ বা অভিজিতের হত্যাকান্ড ঘটে ২০১৫ এর ২৬ফেব্রুয়ারি, একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে। এবিটি ও AQIS (Al-Qaeda in the Indian Subcontinent) একই সাথে অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করে। অভিজিতের কসুর কী ছিলো? একের পর এক বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা-বিশ্বাসের ভাইরাস, সমকামী নামক বই লেখা। মুক্তমনা নামক ব্লগ চালানো ২০০২ সাল থেকে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তক, যুক্তিবাদী, সংশয়বাদী, নাস্তিক ও মানবতাবাদীদের এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কৃতিত্ব অভিজিতের। ফারাবী গ্রেফতার হয় ২রা মার্চ ২০১৫তে কিন্তু অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পুরো বিষয় রয়ে যায় রহস্যাবৃত। ত আদ্যাক্ষর, ও ফ আদ্যাক্ষর-এর নামগুলো সরাসরি শিবির কানেকশন থাকা সত্বেও, হত্যার পরিকল্পনায় তাদের সংযুক্তির সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স থাকা সত্বেও এরা মামলার চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পায়।

১৯৪৬ সালে ঘটে যাওয়া নোয়াখালী হত্যাকান্ড আমাদের লেখকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই রায়টে ৫০০০ হাজার হিন্দু নর নারী শিশু অক্টোবরের ১০ তারিখ রাতে মারা পড়ে, সাথে ধর্ষণ, ধর্মান্তর তো বোনাস। অক্টোবর থেকে নভেম্বর এই দুই মাস ব্যাপি চলা এথনিক ক্লিনজিং-এ ৭৫০০০ হিন্দু আগরতলা ত্রিপুরা আসামে আশ্রয় নেয়। তারা আর জন্মভূমিতে ফিরে আসতে পারেনি। ২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী মুসলমানরা এই তান্ডব চালায়। সরকারী হিসাবমতে ১০০০০ ধর্মান্তকরণ ঘটনা ঘটে। এরই জেরে ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮এ গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত হন। আমরা বইটির পড়তে পড়তে এভাবে ইতিহাসের পথ ধরে হাঁটতে থাকি আর দেখতে পাই শুদ্ধ ও ভুলের লড়াই বহমান। কেউ পিতা হারা কেউ সন্তানহারা কেউ বন্ধুহারা ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে। উপমহাদেশে এ যেন প্রতিদিনকার এক ছক। সেই ছকে এসে পড়েন আমাদের কুচ্ছিত হাঁসের ছানা বা ওয়াশিকুর রহমান বাবু বা বইয়ের মোস্তাফিজুর। যে একটি ট্রাভেল কোম্পানিতে জব করে, আর ব্লগ লেখে। তার ছদ্মনাম ছিল বোকামানব। ৩০ মার্চ ২০১৫ তে এই বোকামানবের শ্বাস থেমে যায় চাপাতির কোপে; কসুর? মাত্র ৫২ পর্বে 'অযৌক্তিক ধর্মীয় বিশ্বাস' নামে সিরিজ লিখেছিলো আমাদের বোকা ছেলেটা। যেমন লিখতে চেয়েছিলো কালবি সেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার যুগে। যেখানে কালবিকে তার শতবর্ষীয়া দাদী জিজ্ঞেস করে-'আল-কালবি!' আমাকে কি এই জীবনে কোন প্রতিবেশীর সাথে কলহ করতে দেখেছ? কারো হক কেড়েছি? সাধ্যমতো এতিম-মিসকিনদের দান করি নাই? কারো মনে দাগা দিয়েছি?'

কালবি 'না' সূচক উত্তর দেয়।

কালবিকে দাদী বলেন, তাহলে আমার সালাত নিয়ে তোমার এত ভাবনা কেন? সালাত আদায় করেও তো কত মরদ বা আওরত ঝগড়া করে, অন্যের ক্ষতি করে, গরীবকে তার হক দেয় না?'

বেদুইনদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা শুরু করে কালবি, কিতাব আল আনাম্ম সেই বইয়ের নাম। আল-লাত, আল-উজ্জাত ও আল-মানাত আল্লাহর তিন কন্যা ছিল আরবের মানুষের প্রতিদিনের হৃদয়দেবী। মানুষের মন কেমন হওয়া উচিৎ বলে আমাদের মনে হয়? এখানে এসে আমরা হঠাৎ শাহবাগের ফুল বিক্রেতা সূর্য আলী ও তার পাতানো ভাগ্নে রিপনকে পাই। যে ফুল বিক্রেতা রিপনের মামা লাবলু রিপনকে মাদ্রাসায় ভর্তি করতে চাইলে খেঁকিয়ে উঠেন- "মাদ্রাসায় গিয়া কী হইব? ভালো কাম পাবে কোনো? গরীবের বাচ্চা হইলে যেন মাদ্রাসায় যাওয়াই নিয়ত।"

লেখক মীরা বাঈয়ের চোখ দিয়ে আমাদের দেখান আমাদের সমাজ পরিবার রাষ্ট্র কেউ কোন ব্যতিক্রম মেনে নেয় না। সেই ১৫৪৭ সালেও শুধু একজন মানুষ ঈশ্বর প্রেমে ভক্ত ও ভজন রচনা করে গায় বিধায় তাকে তার দেবর ননদ রা মিলে অনার কিলিং স্টাইলে হত্যা করে। সেই ধারাবাহিকতা শেষ হয়? হয় না। দেশে দেশে আদতে ক্ষমতার লিপ্সাকে ধর্মের আবরণে ঢেকে কতিপয় ধূর্ত ব্যক্তি সামষ্টিক চেতনাকে উসকে নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে সাধারণ মানুষের কাঁধে বন্দুক রেখে।

চট্টগ্রাম হাসপাতালে তাই ত্রিশ বছর ধরে নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর শুধু হিন্দু এ কারণে মেট্রনের পদটি উপন্যাসের সিন্ধুসারদা তো হারানই, চির পরিচিত শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হন কারণ তিনি কমন রুমকে নামাজের স্থান বানানোতে অন্য সহকর্মীদের যে সমস্যা হচ্ছে তা শিবির সমর্থক নার্সদের বলেন, তিনি বলে ফেলেন নার্সদের যে ইউনিফর্ম তার উপর হিজাব জড়ানোর আলাদা করে কোন মানে নেই।

শিবাজি কোন হতা? গোবিন্দ পানসারের সামনে রাখা টাইপরাইটারে খটখট করে ফুটে উঠতে থাকে অক্ষররাজি 'শিবাজি ভোঁসলে, যাকে আজ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ বলা হয়, ছিলেন একজন ভারতীয় যোদ্ধা সম্রাট এবং মারাঠি ভোঁসলে গোত্রের সদস্য। ১৬৪৭ সালে রায়গড়ে প্রথম তাকে ছত্রপতি বা সম্রাট আখ্যা দেয়া হয়। হিন্দুত্ববাদীরা আজকে যতই তাকে হিন্দু নৃপতি হিসেবে পরিচয় দানের জন্য মেতে উঠুক না কেন, একটি সুশৃংখল সেনাবাহিনী ও সুগঠিত প্রশাসনের মাধ্যমে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন একটি দক্ষ ও প্রগতিশীল বেসামরিক শাসনব্যবস্থা। শিবাজির আলাপে ঢুকেছি কি ঢুকিনি তাকে তার বসবাসের কম্পাউন্ডেই স্ত্রী উমাসহ গুলি করা হচ্ছে এমন সময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস বা উপন্যাসের চরিত্র সুতীর্থ। যে কিনা জাফর ইকবাল বা ওয়াসিক বাহারের মতো পদার্থবিজ্ঞানীকে স্থানীয় এমপি চাবুক পেটা করতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়। সে ব্লগার অভিজিৎ, ওয়াশিকুরের হত্যা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে অফিসে যাবার পথে মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১২ই মে ২০১৫ তে সিলেটেই খুন হবে নিজে কি জানতো! অনন্ত বিজয় দাস কি করেছিলো? মানুষের বিবর্তন নিয়ে লেখা বই অভিজিৎ এর বাবা অজয় এর সাথে বঙ্গানুবাদ করেছিলো। যুক্ত ছিল সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের সাথে।

আশামণি বা সন্ধ্যামণি কেন যেন নীলাদ্রি চক্রবর্তী অরফে নিলয় নীল বা হিমের সাথে একসাথে থাকতে শুরু করেছিলো ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে মানুষ পরিচয়ে? কারণ প্রেম। হাজার বছর ধরে মানুষ যে বোধের জন্য অন্য প্রাণীর চাইতে আলাদা সেই অনুভবে তারা মুসলমান সন্ধ্যামণি ব্রাক্ষ্মণ হিম বা নীলের সাথে থাকতো ঢাকার গোরান এলাকায়। পবিত্র শুক্রবারে নিলয় নীলকে লালে ভাসিয়ে দেয় জিহাদীরা, সেদিন ছিল ৭ই আগস্ট ২০১৫। অথচ নিলয় নীল অনবরত পুলিশকে নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়েছে। পুলিশ কিছুই করেনি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির দর্শনের ছাত্র নীলাদ্রি চক্রবর্তী চাপাতির আঘাতে মুক্তমনা হবার দায় চুকান জীবন দিয়ে। বরাবরের মতো আনসারুল্লাহ আল ইসলাম বাংলাদেশ এবং আল কায়েদা গ্রুপ এ হত্যার দায় স্বীকার করে।

হত্যার পর পুলিশ এসে যা জিজ্ঞেস করে বাড়িওয়ালাকে তা হলো আশামণি মুসলমান ও নীলাদ্রি হিন্দু এবং তারা যে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ নয় তা বাড়িওয়ালা জানে কি না। বাড়িওয়ালার মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল, 'ছেলেমেয়ে দুইটা সত্যিই ভালা আছিল। কত মানুষ আমারে কত রকম কথা কয়। কেউ কয় ওরা নাস্তিক। কেউ কয় ওরা হিন্দু-মুসলিম হইয়া, কেউ কারো ধর্ম না বদলায়ে একসাথে থাকছে। আমি হাজ্বী মানুষ, আমার মাথায় কাঁঠাল ভাঙছে। আমি বুঝি সবাই তো কোন না কোন বাপ মায়ের সন্তান। পোলাটা কত অল্প বয়সে মারা গেল! আর দোষ বা অন্যায় যদি ওরা কইরা থাকে, তার বিচার আল্লাহই করব। আমি বিচার করার কে? আল্লাহ মালিক!' বাড়িওয়ালা হোসেনউদ্দিনের মতোই হওয়া উচিৎ ছিল আমাদের ভাবনার জগৎ। কিন্তু আমাদের ভাবনার জায়গাটাই একদম আটকে দেয়া। আমরা একের পর এক নৃশংস হত্যার সাক্ষী হয়ে থাকলাম বছরের পর বছর।

যুক্তি ও মুক্ত চিন্তার সাথে চলতে থাকে রক্তের হোলিখেলা হাতে হাত ধরে। ব্যাঙ্গালোরে গৌরী লঙ্কেশ নামক এক্টিভিস্ট যখন হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কলম তুলে নেয়ায় খুন হচ্ছেন তখন খোদ রাজধানী শহরে চাপাতির কোপের নীচে ভেসে যাচ্ছেন আমাদের প্রকাশক টুটুল বা লেখকের চরিত্র রাতুল। রাতুল বা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে প্রকাশক টুটুল তাঁর লালমাটিয়ার অফিসে কাটা মুরগীর  মতো তড়পাচ্ছেন তার বন্ধু রণদীপম ও তারেক রহিমসহ সেদিন ছিল ৩১শে অক্টোবর ২০১৫। লেখক এই যে সময়ের ক্রনোলজি না রেখে এক কালের সাথে আরেককাল মিশিয়ে দিচ্ছেন এখানেই তাঁর মুন্সিয়ানা, কারণ গৌরী লঙ্কেশ খুন হয়েছেন ২০১৭ এর সেপ্টেম্বরে। টুটুলের সমস্যা? অভিজিতের বই ছেপেছেন।

এই ৩১শে অক্টোবর ২০১৫ আমাদের জন্য ছিল এক গ্রহণের দিন। একই দিনে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন, বা লেখকের উদ্দীপন চরিত্রটি আজিজ সুপার মার্কেটে নিজের ব্যবসার অফিসে চাপাতির কোপ খেয়ে পড়ে থাকেন, দোকানের শাটার নামিয়ে লক করে চলে যায় হত্যাকারীরা। দীপন অভিজিতের বই প্রকাশ করেছিলেন। অভিজিতের বন্ধু ছিলেন ছেলেবেলার। অভিজিৎ হত্যার পর প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন দীপন।

জঙ্গীরা কি কাউকে ছেড়েছে? তাদের ধর্ম ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে যদি মানুষ যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে চলা শুরু করে। তাই কেউ তাদের চাপাতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। জুলহাস মান্নান ও তনয়ের মতো নির্বিরোধী মানুষরাও প্রাণ হারায় ছুরি চাপাতির নীচে-জুলহাস 'রূপবান' নামক ম্যাগাজিন বের করেছিলেন সমপ্রেমীদের নিয়ে। তনয় ছিল জুলহাসের পার্টনার। আমাদের পাশেই 'চিত্রাঙ্গদা' মুভি হয় কিন্তু আমরা একটা রূপবান মেনে নিতে পারি না। লেখক এখানে যে শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তা পড়ে মনে হয়েছে এ নিয়ে তার গবেষণা কম ছিল-কারণ তিনি মাদ্রাসায় ঘটা ছেলে শিশু বলাৎকারকে সমপ্রেমের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। ধর্ষণ বা বলাৎকার একটি যৌন নিপীড়ন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, অন্যদিকে সমপ্রেম  দুজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যখন নিজের জেন্ডারের মানুষের সাথেই মনোদেহ দিয়ে বাঁধা পড়েন সেই প্রেম ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। সেই ভালোবাসার কারণে ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল জুলহাস ও তনয় প্রাণ হারান। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সরকারের এক মন্ত্রীর কাজিন হওয়ার পরেও জুলহাস-তনয় হত্যার সুবিচার আজও দেশের আইন আদালত নিশ্চিত করতে পারেনি।

রাজশাহী ইউনিভার্সিটির শিক্ষক তাহেরের মতোই কুপিয়ে হত্যা করা হয় শিক্ষক রেজাউল করিমকে। রেজাউল করিমের ভুল ছিল গান বাজনা করা, ছাত্র ছাত্রীদের সংস্কৃতমনা করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা। রেজাউল করিম বা ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে-এর চরিত্র আজিজুল রহিম তাই লুটিয়ে পড়েন চাপাতির  কোপে নাস্তিকতার ট্যাগ মাথায় নিয়ে, রাগ পুরিয়া ধানেশ্রির বন্দিশ 'পায়েলিয়া ঝঙ্কার মেরি ঝনন ঝনন বাজে ঝঙ্কারি, পিয়া সমঝাত নাহি সাস ননদ মোরি দেগি গালি।' হারিয়ে যায় মতিহার চত্বরে।

শিয়াদের হোসেনি দালানে আশুরা উৎসবে বোমা মারা? এসেছে তো হত্যার গানে। আচ্ছা, পাইরুজ যেন কেন খলিফা উমরকে হত্যা করেছিলো? কারণ উমর পাইরুজকে করেছিলো ধর্মান্তরিত, নিজ মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত ও মেনে নিতে হয়েছিলো পাইরুজের দাসের জীবন। এমন কি নিজের নামটি পর্যন্ত পাইরুজের বদলে গিয়েছিলো। মানুষের ধর্ম জোর করে বদলে দিলে, নাম বদলে দিলে ভেতরের মানুষটাও কি বদলে যায় আমূল? না তো। সেই উপলদ্ধি থেকে খলিফা উমর মৃত্যুকালে নিজের ভুল বুঝতে পারেন, সাথীদের বলেন মুহাজিরুন ও আনসারদের প্রতি সদয় হও হে বিশ্বাসীগণ!

বিদেশী হলে কি ছাড় আছে মৃত্যুর তালিকা থেকে? না,ভিনসেন্ট বা তাভেল্লা খুন হন গুলশানে, তিনি ছিলেন এনজিও কর্মী। খুন হয়ে যায় জগন্নাথের ছাত্র সামাদ বা আরিফ ৬ই এপ্রিল ২০০৬ এ, চাপাতি চুমু দেয় ঘাড়ে মাথায় সবখানে। বাউল, সাধক, গির্জার পাদ্রি, এনজিও কর্মী কাওকে ইসলামিস্ট জঙ্গীরা ছাড় দেয়নি। রংপুরের জাপানী হোসি কোনিওর মতো ধর্মান্তরিত মুসলিমকেও ছাড়ে না তারা। সে আকিমাসা হয়ে মারা যায় আমাদের লেখকের কলমে। মুন্সিগঞ্জ সিপিবির নেতা শাহজাহান বাচ্চু পঠিত উপন্যাসে জাহাঙ্গীর বাবলু হিসেবে আবির্ভূত হন। যে মুন্সিগঞ্জে গিয়েছিলেন ঢাকাকে নিরাপদ মনে না করে সেই মুন্সিগঞ্জেই তাকে হত্যা করে জঙ্গীরা।

ব্লগার হত্যায় কিছুটা হলেও যবনিকা পাত ঘটে আদতে গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার পর। বিদেশী নাগরিক বিশেষ করে অধিক সংখ্যক ইতালীয় ও জাপানীদের মৃত্যু সরকারকে বাধ্য করে তিন বছর ধরে চলা হত্যার মহোৎসবের রাশ টেনে ধরতে। হোলি আর্টিজানের হৃদয়বিদারক ঘটনা যে কোন শিমারের চোখেও জল নিয়ে আসবে-সন্তানসম্ভবা ইতালীয় নারী, ভারতীয় নাগরিক তরিশি জৈনকে সর্বাধিক আঘাত করে এই জঙ্গীরা। ২৪ জন মানুষকে নির্বাসরা একরাতে খুন করে। তাদের সহযোগী ছিল নর্থ সাউথের শিক্ষক হাসনাত রেজাউল করিম ও অপর এক শিল্পপতির ছেলে তাহমিদ। এই দুইজন সন্দেহভাজনকে নানা নাটক করে মুক্তি দেয়া হয়। হাসনাত করিমের ওয়াইফ ২রা জুলাই মিডিয়ার সামনে এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে সে হিজাব পরা থাকায়, কোরান থেকে সুরা বলতে পারায়, তাকে মুসলমান হিসেবে জঙ্গীরা কিছু করেনি। এমন কি তাদেরকে সেহরীও খেতে দিয়েছে। আমাদের মিডিয়া ও গান্ডু দেশবাসী আরেকটু হলে এই সেন্টিমেন্টে ভেসে যেত যদি না বিদেশী একজনের ছাদ থেকে ভিডিওতে দেখা যেত হাসিখুশি হাসনাত ও তাহমিদ আনন্দের সাথে জঙ্গী নিবরাসদের সাথে দাঁড়িয়ে রিল্যাক্স মুডে সিগারেট টানছে। এ আক্রমণে কোল্যাটারাল ডেমেজ ঘটে ট্রান্সকম গ্রুপের ফাইয়াজের। যাকে নিয়ে কাল্পনিক এক বীরত্ব গাঁথা লিখে ফেলেন প্রথম আলোর উপ সম্পাদক আনিসুল হক। ইশরাতের মতো নির্বিরোধী শিল্পমনা মেয়ে বা ল্যাভেন্ডারের নাতনি অবন্তির জন্য প্রাণ না কাঁদলেও আমাদের ডেইলি স্টারের গায়িকা এলিটা তাহমিদের জন্য ফ্রি তাহমিদ হ্যাশট্যাগ চালু করেন পর্বত আরোহী ওয়াসফিয়া নাজনীন সহ।

'ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে' প্রকাশিত হয়েছে সংবেদ প্রকাশনী থেকে। উপন্যাস কোন ঐতিহাসিক গবেষণার দলিল নয়। তাই লেখক এখানে আধুনিক লেখকদের যে ধারা সেই ধারায় ডকুফিকশন ঘরানায় মুক্তিযুদ্ধে ভূ-খন্ড জিতে নেয়া একদেশের মানুষ কিভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চার যুদ্ধে চাপাতির নীচে বিলীয়মান হয়ে যাচ্ছে-ধর্ম, রাজনীতি ও আশেপাশের দেশের ঘটনার প্রবাহের কারণে তার এক নিরপেক্ষ বয়ান তুলে ধরেন আমাদের সামনে। তিনি ইসলাম ধর্ম,হিন্দু ধর্ম, চার্চ, মন্দির, মসজিদ, শিয়া-সুন্নি, বাউল, বৈষ্ণব কোনদিকে আলোকপাত করেননি?

আফসানা কিশোয়ার

পাঠক হিসেবে আমি অভিভূত এ কারণে যে এক মলাটে আমাদের দুঃসময়ের এমন বর্ণনা সেই ২০১৩ থেকে এই ২০২২ পর্যন্ত কেউ লেখেনি। বইটি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া অত্যন্ত জরুরী।  মানবতার উপর যে আঘাত সর্বকালে এসেছে তার এক প্রমাণ দলিল এ বই।

অদিতি ফাল্গুনী 


অদিতি সব সময় পরিশ্রমী লেখক। এই বইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সেই মধ্যযুগ থেকে শুরু করে সব কাল যেভাবে তিনি অক্ষরে অক্ষরে গেঁথেছেন তা মাধুর্যময়, বই শেষ করে বুকে থম ধরে থাকবে। মনে হবে মানুষ হিসেবে আমাদের অর্জন কী? কেন আমরা মনুষ্যত্বের চর্চা করতে পারলাম না! তারপর মনে হবে আলো ও আঁধার সৃষ্টির প্রথম থেকেই পাশাপাশি হেঁটেছে, টি এস এলিয়টের মতো তাই আমরা দিনশেষে বলে ফেলব- But if you kill me,I shall rise from my tomb/To submit my cause before God's throne.

 

বই - ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে

প্রকাশক - সংবেদ

মূল্য - ৪২৮টাকা           

লেখক - অদিতি ফাল্গুনী

 

বই কেনা যাবে বাতিঘর থেকে

https://linktr.ee/baatighar

রকমারি থেকে

https://www.rokomari.com/book/199677/kromagoto-hottar-serenade

 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন