কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৪ |
ভুবনমেলা
জন
রান্নাঘর। রান্না করতে করতে দশজনের চোখে বিষন্নতা। পরস্পরে দেখে নিচ্ছে কে কতটা আশায়
নিরাশায় অসহিষ্ণু। অজানা একাকীত্বের ভয়। যাকে এখানে আনা তার দিন গোনার পালা কারোর।
কাটোয়াবাসিনী
গ্যাসচুল্হায় ভাত বসিয়ে বাংলাদেশ খুলনার সোহরাববিবিকে জিজ্ঞেস করে, কী সমস্যা?
-আমার
বাচ্চা হয়নি গো! বারো বছর।
-ও
তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছ? ও কিছু না গো! এই হাসপাতালে সব সম্ভব।
সোহরাববিবি
মাথা নাড়ে।
-তা
কী করে হয়? আমার স্বামীর যে নিচে ক্যান্সার। আচ্ছা তোমার কী গো?
-আমার
স্বামীর লিভারে। ডাক্তার জবাব দিয়েছে। বলেছে দুচারদিন থাকো। ঈশ্বরের প্রার্থনা করো।
চেষ্টা করছি।
পাশের
থেকে শ্যামবাজারবাসিনীর জবাব - আরে আমারও তো তাই। তবে ডাক্তার বলেছে আশা হারিও না।
তোমার স্বামীর বোন ম্যারোর সাথে আমেরিকার একজনের ম্যাচ করেছে। সে স্বেচ্ছায় দান করবে।
প্রার্থনা করো যেন টাইমলি পৌঁছয়। বাঁচবে, আমার স্বামী বাঁচবে।
মণিপুরী
বৌ বলে উঠল - আমি কাল ঘর ফিরছি গো! আমার অসুখ সেরে গেছে। আজ রাতে সবাইকে মাংস রান্না
করে খাওয়াব।
সিমলার
লোকটি পরাঠা সেঁকছিল, বলে উঠল – ভাবিজি, আমার বাচ্চার দোয়া করুন। কাল যেন টেস্টে নেগেটিভ আসে। ওর ফুসফুসে টিউমার।
আমার এই ষাঠ বছরে আই ভি এফ এ এই সাধের ধন। আমি ওকে হারাতে চাই না।
রাজস্থানের
জয়পুরবাসী মহিলা শিলনোড়ায় মশলা বাঁটছিল - আমার স্বামীর গত পরশুদিন ডায়লিসিস ছিল
আর আমার দুদিন পর কেমো হবে। ব্রেস্ট ক্যান্সার। না না। আমার কিন্তু কোনো দুঃখ নেই।
এখানে প্রত্যেকের রোগ নিয়ে মরণ যন্ত্রণা। কিন্তু দেখ, আমরা যেন সবাই পিকনিকের মুডে।
হিমাচলি
টুপি পরা লোকটা হঠাৎ নাচতে নাচতে কাংড়া গেয়ে উঠল - ওও চম্বে মিজরা দে মেলে / গল সুন
কমলো / মিজো ছ্যাল লগদি।
ভূবনেশ্বরবাসিনী
বলে উঠল - এর মাথা খারাপের চিকিৎসা মনে হয়।
-না
গো। আমার স্বামীর আর পাঁচদিন পর গলার অপারেশন। তারপর এ জন্মের মত কথা বলা গান সব শেষ।
সেসময়
হঠাৎ বোলপুরবাসিনী গেয়ে উঠল - আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ দহন লাগে / তবুও শান্তি তবু
আনন্দ তবু অনন্ত জাগে।
কেঁদে
ওঠে সে। জিজ্ঞেস করতেও সে কষ্টের কথা বলে না।
পরিবেশ শোকস্তব্ধ। এমন সময় হাতে কুকার খুন্তি দিয়ে বাজিয়ে গাইতে গাইতে এক গোয়ানিজ বৌ ঢুকল - উই শ্যাল ওভারকাম সাম ডে। তখন প্রত্যেকে সুর মেলায়। পরিবেশ উচ্ছ্বল হয়। ঐ সময় একজন রান্নাঘরে ঢোকে। হাতে মাস্ক।
-পাঁচ
রুপয়া, পাঁচ রুপয়া। একটু দয়া করুন। একটা মাস্ক কিনুন। আপনাদের কাজের।
-এখানে
মাস্ক বিক্রি করতে এসেছ? বাঙালি? কোথাকার তুমি?
-আমি
পূর্ব মেদিনীপুরের। আমার একমাত্র ছেলের বোন-টিউমার। এখানের হাসপাতাল দয়া করেছে। বলেছে মাত্র পাঁচশো টাকা জোগাড়
কর। তোমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দেব। ওরাই এই মাস্ক বিক্রি করতে দিয়েছে। আমার ছেলেকে বাঁচান।
একটা করে মাস্ক কিনুন। মাত্র পাঁচটাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন