রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২২

কাজল সেন

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৩


মীনাকুমারীর মৃত্যু  


মীনাকুমারীকে সবাই মনে করেছিল, সে মরে গেছে। মানে হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স সবাই। কেননা মীনাকুমারীর পাল্‌স পাওয়া যাচ্ছিল না। ছোট ডাক্তারের পর বড় ডাক্তার এসে আরও কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করলেন, সত্যিই ‘সী ইজ নো মোর’। সুতরাং বাড়ির লোকদের খবর পাঠাও। তারা এসে হাসপাতালের বাকি বিল মিটিয়ে দিয়ে ডেডবডি নিয়ে যেন তাড়াতাড়ি চলে যায়!

তা বাড়ির লোকেরা এবং কয়েকজন পাড়া-পড়শি মীনাকুমারীর মৃত্যুর খবর পেয়েই দৌড়ে এলো হাসপাতালে। খবরটা পেয়ে অফিসের কোলিগরাও হাসপাতালে ছুটে এলো। ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল হাসপাতালের চৌহদ্দিতে। কারও অভিমত, মরে যাবার আদৌ কোনো কথা ছিল না। ডাক্তার-নার্সদের চিকিৎসায় অবহেলাই এই মৃত্যুর একমাত্র কারণ। কেউ কেউ মত প্রকাশ করলেন, কী আর করা যাবে, মানুষ জন্মমুহূর্তেই তার মৃত্যুর তারিখ ও  সময় কপালে লিখে নিয়েই ভূমিষ্ট হয়। আহা, ললাটলিখন!

মীনাকুমারী কিন্তু বুঝতে পারছিল, তখনও পর্যন্ত সে মারা যায়নি। তবে শরীরের  কলকব্জা যেভাবে ঝিমিয়ে আসছে, বোঝাই যাচ্ছে, মৃত্যুমুহূর্ত ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। আর তখন সে সত্যিই মরে যাবে।

ঘন্টা চারেক পর যখন তার বডি হাসপাতালের লনে নিয়ে আসা হলো, মীনাকুমারী লক্ষ্য করল, তাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্য পর্যাপ্ত লোকজন জুটে  গেছে। অবশ্য হাসপাতাল থেকে সরাসরি শ্মশানে নয়, বরং তার আগে তাকে শেষবারের মতো ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হবে তার বাড়িতে। বাড়ির ভেতরে অবশ্য ঢোকানো হবে না, হয়তো দোতলা বাড়ির বাগানে, অথবা বেশি হলে একতলার বারান্দায়। তা মীনাকুমারী যা যা ভেবেছিল, মোটামুটি তাই তাই হলো। তবে তার নিজেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, মরে যাবার আগে বাড়িটা একবার দেখে আসতে। মীনাকুমারী কিছুটা আভাষ পাচ্ছিল, তার হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে। যখন তাকে ডাক্তার-নার্সরা মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন, তখন সকাল দশটা বেজেছিল। তার বডি বাড়ির লোকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল দুপুর দুটো নাগাদ। বাড়ি আসতে আসতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। এখন তার বডি নিয়ে কতক্ষণ যে শাস্ত্রের নিয়ম মেনে কতকিছু করা হবে, হয়তো শ্মশানে নিয়ে যেতে সাড়ে ছটা-সাতটা বেজে যাবে। তার বেশি দেরি করা ঠিকও হবে না। কেননা শ্মশানে ডেডবডির লাইন কত দীর্ঘ হবে, টার্ম আসার পর বডি পুড়তেও প্রায় চুয়াল্লিশ মিনিট মতো লাগবে। তারপর আরও কিছু নিয়মকানুন সারতে হবে। ঘরে ফিরতে সবার মাঝরাত হয়েই যাবে। তবে মীনাকুমারী নিশ্চিত, চুল্লিতে ঢোকানোর আগেই তার বডি ডেড হয়ে যাবে।  

কিন্তু এই যে শরীরের পাল্‌স না পাওয়ার মুহূর্ত থেকে মীনাকুমারী যতটা সময় তার সেন্স ধরে রাখার সুযোগ পেয়েছিল, খুব আশা করেছিল, নিশীথের সঙ্গে ঠিক দেখা হয়ে যাবে, হয় হাসপাতালে, নয়তো বাড়ির বাগানে, অথবা শ্মশানে।  একবার শেষ দেখা দেখতে নিশ্চয়ই আসবে নিশীথ। আর সেই আকাঙ্ক্ষাতেই তো মীনাকুমারীর এতটা সময় সেন্সকে সজীব করে রাখা! একটা সময় এই শরীরটাকেই যথেচ্ছ ভোগ করেছে নিশীথ, সেই শরীরের মরে যাওয়া দেখতে তো আসতেই হবে তাকে!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন